ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

রেড নোটিস জারি হলেও ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ

৮৯ মোস্ট ওয়ান্টেড আসামির হদিস জানে না ইন্টারপোল

প্রকাশিত: ১১:৩৪, ১২ মার্চ ২০২০

৮৯ মোস্ট ওয়ান্টেড আসামির হদিস জানে না ইন্টারপোল

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধুর খুনী, শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গী সন্দেহে নিখোঁজ ও সর্বশেষ অর্থ পাচার করার অভিযোগ আছে এমন ৮৯ জনের নামের তালিকা ঝুলছে আন্তর্জাতিক পুলিশী সংস্থার (ইন্টারপোল) রেড নোটিসে। এর মধ্যে মঙ্গলবার যুক্ত হয়েছে ক্যাসিনো কা-ে বিদেশে অর্থ পাচারকারী ৭০ জনের তালিকা তৈরির পর ৮ জনের নাম ইন্টারপোলের কাছে রেড নোটিস জারি করে বিদেশ থেকে ফেরত পাঠাতে অনুরোধ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে বিদেশে অবস্থানরত মোস্ট ওয়ান্টেড আসামিদের ফেরত পাঠাতে অনুরোধ করা হলেও কুখ্যাত খুনীদের কাউকেই ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ হচ্ছে সংস্থাটি। এমনকি ৮৯ বিদেশে পলাতক আসামির মধ্যে অর্ধশতাধিক আসামি কে কোথায় আছে তারও হদিস পাচ্ছে না ইন্টারপোল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে তিন বছর ধরে জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত পুলিশের সন্দেহভাজন নিখোঁজ রয়েছে এমন ৪০ ব্যক্তির নাম আন্তর্জাতিক পুলিশী সংস্থার (ইন্টারপোল) রেড নোটিসে নেই। ইন্টারপোলের রেড নোটিসের তালিকায় বাংলাদেশের মোট ৮১ জনের নাম আছে। গত মঙ্গলবার আরও ৮ জনের নাম যুক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন ৮৯ জনের নাম আন্তর্জাতিক পুলিশী সংস্থার রেড নোটিসে ঝুলছে। ক্যাসিনো কা-ে জড়িত ও বিদেশে অর্থ পাচারকারী এমন ৭০ জনের তালিকা তৈরি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক)। এর মধ্যে ৮ জনের একটি তালিকা আন্তর্জাতিক ইন্টারপোলকে দিয়েছে তারা। যেই ৮ জনের নামের তালিকা দেয়া হয়েছে তাদেরকে ধরে ফেরত পাঠানোর জন্য ইন্টারপোলের কাছে সহায়তা চেয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। ইন্টারপোলের রেড নোটিসের তালিকায় যাদের নাম আছে তার মধ্যে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পলাতক আসামি, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও পলাতক পুরনো মামলার আসামি জঙ্গীদের নাম রয়েছে। তবে গত বছর গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পর নব্য জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠীর পলাতক সদস্য রয়েছে যারা জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত হয়ে বিদেশে চলে গেছে এমন সন্দেহভাজন নিখোঁজদের কারও নাম ইন্টারপোলের রেড নোটিসভুক্ত হয়নি বলে জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গী সন্দেহে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ইন্টারপোলের রেড নোটিসে না হওয়ার কারণ সম্পর্কে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পুলিশী তদন্তে নিখোঁজের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর জঙ্গী তৎপরতায় সন্দেহভাজন নিখোঁজ যারা রয়েছে তদের খুঁজে বের করবে পুলিশ। প্রয়োজনে ইন্টারপোলের মাধ্যমে এদের খোঁজ করা হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু নিখোঁজের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর প্রায় বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত নিখেঁজ ব্যক্তিদের নামের তালিকা ইন্টারপোলের রেড নেটিসে স্থান পায়নি। এই নিখোঁজ ব্যক্তিরা কোথায় আছে, কি করছে, এই বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের কাছেও কোন সুর্নিদিষ্ট তথ্য নেই। তবে নিখোঁজদের সন্ধান করা হচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গীরা কথিত হিযরতের নামে ঘর ছেড়েছেন এমন অন্তত অর্ধশতাধিক এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। এদের মধ্যে গত তিন বছরে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে দেশ ছেড়েছেন অন্তত ৩৫ জন। হিযরতের নামে বাড়িঘর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ২০জন সিরিয়া বা ইরাক বা ভিন্ন দেশে চলে গেছেন। এদের মধ্যে আবার বিভিন্ন সময়ে ৪ জন ইরাক বা সিরিয়ায় নিহত হয়েছেন বলে মৃত্যু সংবাদসহ তাদের ছবি প্রকাশও করেছে আইএস। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার পর নিখোঁজ, যাদের বিরুদ্ধে আল-কায়েদা সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে। আরও কয়েকজন দেশ ছাড়ার খবর পাওয়া গেছে, তারা ঠিক কোন্ দেশে গেছেন, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তদন্ত করছে পুলিশ। অথচ তিন বছর ধরে হিযরতের নামে নিখোঁজ হয়ে জঙ্গী তৎপতরায় জড়িত সন্দেহভাজন হলেও তাদের কারও নাম ইন্টারপোলের তালিকায় নেই। পুলিশ সদর দফতরের ইন্টারপোল ডেস্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা জানান, ইন্টারপোলের রেড নোটিসে হালনাগাদ তালিকাধারীদের নাম ও পরিচিতি রয়েছে। তবে কয়েকজন নিখোঁজ ব্যক্তির নাম ইন্টারপোলের রেড নোটিসের তালিকায় রয়েছে, যারা কেউ জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে জড়িত আছে কিনা সেই বিষয়ে সঠিক তথ্য নেই। যাদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারি করা হয়, তারা সবাই শীর্ষ অপরাধী ও পলাতক। এদের অবস্থান ও গ্রেফতারে ইন্টারপোল চেষ্টা চালায়। সন্ত্রাসীকে গ্রেফতারের পর নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। প্রায় অর্ধশত নিখোঁজ ব্যক্তির কারও নাম ইন্টারপোলের রেড নোটিসে নেই। তবে ইন্টারপোলের রেড নোটিসে যাদের নাম আছে তাদের মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত আসামি, প্রায় অর্ধযুগ আগের জঙ্গী হামলার মামলার আসামি রয়েছে। ইন্টারপোলের রেড নোটিসে তালিকাভুক্ত এখন ৮৯ বাংলাদেশী। আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন মামলার আসামিদের তালিকা বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারপোলের সদর দফতর ফ্রান্সের লিয়নে। তাদের ছবি, মামলার নথি এবং কেন তাদের ইন্টারপোল নথিভুক্তি করবে তার সমস্ত প্রমাণ পাঠানো হয়েছিল সদর দফতরে। ওই তালিকায় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনীদের নাম। এছাড়া রয়েছে শীর্ষ সস্ত্রাসী, গডফাদার ও যুদ্ধাপরাধ মামলার দ-প্রাপ্ত পলাতক আসামি। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ইন্টারপোলের সদস্য পদ লাভ করে। ইন্টারপোল আসামিকে গ্রেফতারে কোন বাহিনী পাঠায় না বা কোন দেশকে চাপও দিতে পারে না। তারা শুধু এ সংক্রান্ত তথ্য সদস্যভুক্ত ১৯০টি দেশ ও সেদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন বিভাগকে অবগত করে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিসে যাদের নাম রয়েছে তারা হলোÑ কানাডায় অবস্থানরত নূর চৌধুরী, আমেরিকায় অবস্থানরত চৌধুরী এএম রাশেদ। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর খুনী পলাতক খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, আবদুল মাজেদ ও খান রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন। রয়েছে জঙ্গী নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, যুদ্ধাপরাধ মামলার পলাতক আসামি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, জাতীয় পার্টির নেতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বার, জাহিদ হোসেন, গোপালগঞ্জের আশরাফুজ্জামান খান, ফেনীর মইনউদ্দিন চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাসান আলী ও সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন। রয়েছেন আলোচিত ও সমালোচিত হারিছ চৌধুরী। এছাড়াও রয়েছে দেশের টপটেরর প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আমিনুর রসুল, হারিস আহমেদ, জাফর আহমেদ, নবী হোসাইন, জিসান, শাহাদাত হোসাইন, মোল্লা মাসুদ, সুব্রত বাইন, কালা জাহাঙ্গীর, খন্দকার তানভীর ইসলাম জয়। রয়েছে রফিকুল ইসলাম, নবী হোসাইন, তৌফিক আলম, মিন্টু, আতাউর রহমান, নাসির উদ্দিন রতন, চান মিয়া, প্রশান্ত সরদার, সুলতান সাজিদ, হারুন শেখ, মনোতোষ বসাক, আমিনুর রহমান, আহমেদ বাবু, সৈয়দ মোহাম্মদ হোসাইন, জাহিদ হোসেন খোকন, সুরত আলম, সাজ্জাদ হোসেন খান, হাসেম কিসমত, মোঃ ইউসুফ, নাঈম খান, মকবুল হোসাইন ও সালাহউদ্দিন মিন্টু, আনজুম ফারজানা, খান মোহাম্মদ শহীদ উদ্দিন, অশোক কুমার দাস, চন্দন কুমার, সুজন শহীদ কামাল, আলী আকবর ভুট্টো, আমান উল্লাহ শফীক, সাজ্জাদ হোসাইন খান, হুসাইন মকবুল, মজনু আহমেদ, দিপু নুরুল, গোলাম ফারুক অভি ও শহীদ সুলতানের নাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বন্দী বিনিময় চুক্তি না থাকাসহ নানা কারণে রেড নোটিস জারি থাকলেও এসব আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তবে যেসব দেশের সঙ্গে বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই তাদের সঙ্গে চুক্তি করে অথবা আইনী প্রক্রিয়ায় বিদেশে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিদেশে পলাতক আসামিদের মধ্যে কে কোথায় আছে তা জানার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্স বিদেশে পলাতক আসামিদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তায় বিদেশে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
×