ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী;###;৩০ মিনিটে ঢাকা থেকে মাওয়া ;###;ঢাকা-ভাঙ্গা চার ঘণ্টার রাস্তা লাগবে ৪৫ মিনিট

প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের দ্বার খুলছে আজ

প্রকাশিত: ১১:২৬, ১২ মার্চ ২০২০

প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের দ্বার খুলছে আজ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ কোথাও থামবে না গাড়ি। নেই ট্রাফিক সিগন্যাল বা ইন্টার-ক্রসিংয়ের ঝামেলা। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া যানবাহন একই গতিতে পদ্মা সেতু হয়ে পৌঁছাবে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত। এতে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ছোট-বড় যানের জন্য আছে আলাদা আলাদা লেন। লেন ধরে একদিকেই সব গাড়ির চলাচল। ক্রসিং এড়াতে রয়েছে ওভারপাস। আন্ডারপাস সহ আধুনিক ট্রাফিক সুবিধার সবকিছুই। রয়েছে ইন্টারচেঞ্জের সুবিধাও। এমন পরিকল্পনায় নির্মাণ করা হয়েছে ঢাকা-ভাঙ্গা ছয় লেনের মহাসড়ক। দৃষ্টিনন্দন দেশের প্রথম ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েটি এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। আজ বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সড়কটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। এর মধ্য দিয়ে আধুনিক সড়ক যোগাযোগে আরেকধাপ অগ্রগতি হলো। তেমনি এক্সপ্রেসওয়ে যুগে প্রবেশ করলো বাংলাদেশ। উদ্বোধন শেষে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়কটি জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। ফলে এখন ঢাকা থেকে মাওয়া যেতে সময় লাগবে আধা ঘণ্টার কম। যেখানে লাগত দুই ঘণ্টার বেশি। আর ভাঙ্গা যেতে সময় লাগবে ৪৫ মিনিট। সব মিলিয়ে চার ঘণ্টার রাস্তা মাত্র ৪৫ মিনিটে সহজেই অতিক্রম করা সম্ভব হবে। তবে এই মুহূর্তে মাওয়া পর্যন্ত যাওয়ার সুবিধা পাওয়া যাবে। পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে বাকি সুবিধা পাবেন যাত্রীরা। সব মিলিয়ে বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে এই সড়কের পুরোপুরি সুফল পেতে শুরু করবে অন্তত ২২ জেলার মানুষ। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগে শুরু হচ্ছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাই সড়কটি উদ্বোধনের খবরে দক্ষিণাঞ্চলে বইছে আনন্দের বন্যা। সড়ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন গোটা দক্ষিণের মানুষ। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতু হলে তার সর্বোচ্চ সুবিধা যাতে দেশের মানুষ পান, সেজন্য আধুনিক মহাসড়কের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রেখে তৈরি করা হয়েছে এই এক্সপ্রেসওয়ে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, এটি সত্যিকার অর্থে অসাধারণ। আজ উদ্বোধন হলেও বেশ কিছুদিন ধরেই সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। চালকরা জানিয়েছেন, নিরাপদ সড়ক বলতে যাকে বোঝায় এটি তাই। কোন যানজট ছাড়াই আমরা গন্তব্যে যেতে পারছি। গুলিস্তান থেকে একটানে এখন মাওয়া যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। এই সড়ক নির্মাণে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এখানে রয়েছে ৪৪ কালভার্ট, ১৯ আন্ডারপাস, চারটি বড় সেতু, ২৫ ছোট সেতু, পাঁচটি ফ্লাইওভার, তিনটি ইন্টার চেইঞ্জসহ চারটি রেলওয়ে ওভারপাস রয়েছে। সব মিলিয়ে ছোট বড় ৩১ সেতু আছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, সব মিলিয়ে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন একটি সড়ক। আমার মনে হয়, ইউরোপের অনেক দৃষ্টিনন্দন সড়ককেও হার মানাবে। এত চমৎকারভাবে এটি করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দায়িত্বে ছিল। মহাসড়কটি এশিয়ান হাইওয়ে করিডোরের অন্তর্ভুক্ত। সড়ক ও জনপদ অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল। স্থানীয় ও ধীরগতি সম্পন্ন যানবাহনের জন্য এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে দুটি পরিসেবা লেন রাখা হয়েছে, যাতে দ্রুতগামী যানবাহনগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে রাস্তায় চলাচল করতে পারে এবং এইভাবে দীর্ঘপথের যাত্রীদের ভ্রমণের সময় কমে আসে। পদ্মার সেতুর সুবিধা নিতে এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এই সড়ক ইউরোপের অনেক সড়ককে হার মানাবে। এই সড়ক বাংলাদেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে, চার লেন নয়, দুদিকে পাঁচ মিটার করে সার্ভিস লেনসহ এই এক্সপ্রেসওয়ে ছয় লেনের। এক্সপ্রেসওয়ের দুটি অংশ পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে সংযুক্ত হবে, যা বর্তমানে নির্মাণাধীন রয়েছে। দেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতুর চার কিলোমিটার মূল সেতু নির্মাণে গত মঙ্গলবার ২৬তম স্প্যান বসানো হয়েছে। সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গেলে ভাঙ্গা থেকে ঢাকা আসা-যাওয়ায় এক ঘণ্টাও লাগবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। উদ্বোধনের একদিন আগে ঢাকার পোস্তগোলা থেকে মাওয়াঘাট পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের যাত্রাবাড়ী-মাওয়া অংশে দিনভর ব্যস্থতা দেখা গেছে সংশ্লিষ্টদের। উদ্বোধনের আগে নিরবচ্ছিন্ন দ্রুতগতির রাস্তায় শেষ মুহূর্তের কাজ সমাপ্ত করছিলেন শ্রমিকরা। সড়কের দুই পাশে সবুজায়নের জন্য বৃক্ষরোপণ করা হয়, লাগানো হয় বর্ণিল পতাকা। ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়ের প্রথম অংশ ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার, আর পদ্মা সেতুর ওই পাড়ে পানছার থেকে ভাঙ্গা-পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ। সব মিলিয়ে ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বাসিন্দাদের রাজধানী ঢাকায় যাতায়াত সুগম হবে। পদ্মার ওপার থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণ কাজ আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাকি ছিল ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার অংশের কাজ। বরিশাল বিভাগের ছয় জেলা, খুলনা বিভাগের ১০ জেলা এবং ঢাকা বিভাগের ছয় জেলাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২২ জেলার মানুষ সরাসরি এই এক্সপ্রেসওয়েতে উপকৃত হবেন বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। ২০১৬ সালে প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। নানা জটিলতায় সময়মতো কাজ শেষ হয়নি। অর্থাৎ গত বছর ২০১৯ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। দ্বিতীয় দফা চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের সময় বৃদ্ধি করা হয়। সব মিলিয়ে তিন মাসের বেশি সময় আগেই প্রকল্পের কাজ শেষ হলো। প্রকল্পটি আগামী ২০ জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তিন মাস আগেই তা শেষ হয়েছে বলে সড়ক পরিবহন মন্ত্রী জানান। এক্সপ্রেসওয়ের পাঁচটি ফ্লাইওভারের মধ্যে একটি ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার কদমতলী-বাবুবাজার লিংক রোড ফ্লাইওভার। অন্য চারটি ফ্লাইওভার করা হয়েছে আবদুল্লাহপুর, শ্রীনগর, পুলিয়াবাজার ও মালিগ্রামে। এক্সপ্রেসওয়ের জুরাইন, কুচিয়ামোড়া, শ্রীনগর ও আতাদিতে চারটি রেলওয়ে ওভার ব্রিজ এবং চারটি বড় সেতু রয়েছে। এরই মধ্যে এই এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা পাচ্ছেন জানিয়ে গুলিস্তান থেকে মাওয়া রুটের ইলিশ পরিবহনের চালক আখতার। তিনি জানান, এই সড়ক তো এক্সপ্রেসওয়ে। যাকে নিরাপদ সড়ক বোঝায়। এই সড়কটি ব্যবহারে কোথাও গাড়ি থামানোর সুযোগ নেই। একটানা গুলিস্তান থেকে আমরা মাওয়া যাচ্ছি। অপর চালক জুয়েল জানালেন, গুলিস্তান থেকে মাওয়া যেতে আগে সময় লাগত প্রায় তিন ঘণ্টা। এখন সর্বোচ্চ ৪৫ মিনিটে আমরা যেতে পারছি। তাছাড়া সবচেয়ে বড় বিষয় হলো স্থানীয় যানবাহন মূল সড়কে ওঠে না। ফলে দুর্ঘটনা কম হবে। অপর চালক পলাশ জানালেন, আমরা যানজট থেকে মুক্তি পেয়েছি। এখন যাত্রীরা যেমন খুশি। আমরাও গাড়ি চালিয়ে মহাখুশিতে আছি। দ্রুত আসা যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। ফলে আয়ও বেড়েছে আমাদের। এক্সপ্রেসওয়ের পোস্তগোলার যে অংশে রেলপথ এড়িয়ে যান চলাচলের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে আগে এখানে যানজট লেগেই থাকত। এখন তো সব গাড়ি ওপর দিয়েই যাবে। দূরের গাড়ি ঢাকায় ঢুকতে এখানে দীর্ঘসময় আটকে থাকত, এখন আর এই এলাকায় যানজট থাকবে না। এই এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে টোল দিতে হবে সব ধরনের যানবাহনকে। এক্সপ্রেসওয়েটি চালু হলে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা যেতে সময় লাগবে মাত্র ৪২ মিনিট। ঢাকা থেকে মাওয়া যেতে সময় লাগবে মাত্র ২৭ মিনিট। এক্সপ্রেসওয়েটি চালু হওয়ার খবরে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মাঝে আনন্দের বন্যা বইছে। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পে প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬ হাজার ২৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। পরে সংশোধিত ডিপিপিতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৮৯২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর বাইরে মূল প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়নি এমন কিছু কাজের জন্য ২০১৮ সালের জুনে চার হাজার ১১১ কোটি টাকার আরেকটি পৃথক ডিপিপি অনুমোদন করে সরকার। এ ডিপিপি অনুযায়ী কাজের মেয়াদ ধরা হয় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। দুটি ডিপিপি মিলিয়ে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে মোট ব্যয় হচ্ছে ১১ হাজার ৩ কোটি টাকা। মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুল ইসলাম জানান, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েটি ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করবেন। এক্সপ্রেসওয়েটি উদ্বোধন উপলক্ষে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি এক্সপ্রেসওয়েটি চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে। পদ্মা সেতু চালু হলে এ স্বপ্ন শতভাগ পূরণ হবে। পদ্মা সেতুর গোড়ার লৌহজংয়ের মেদিনী ম-ল ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ হোসেন খান বলেন, সবচেয়ে সুন্দর ও প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের ঢাকা-মাওয়া অংশ উদ্বোধনের খবরে আমি সত্যিই আনন্দিত। দীর্ঘদিন স্থানীয় মানুষের এই সড়ক নির্মাণে দাবি ছিল। সড়কটি চালু হওয়ায় এখন ঢাকা থেকে মাওয়া আসতে তিনঘণ্টা লাগে না। মাত্র ৪০ মিনিটেই আসা সম্ভব হচ্ছে। তাছাড়া পুরো সড়কটি এখন যানজটমুক্ত, দুর্ভোগমুক্ত হয়েছে।
×