ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ইমপিচমেন্ট সঙ্কট ॥ নিক্সন অধ্যায়ের না জানা কথা

প্রকাশিত: ০৯:০০, ১০ মার্চ ২০২০

ইমপিচমেন্ট সঙ্কট ॥ নিক্সন অধ্যায়ের না জানা কথা

(গতকালের পর) আরব-ইসরাইল যুদ্ধের অব্যবহিত পর ১০ নবেম্বর ব্রেজনেভ নিক্সনকে লেখা এক ব্যক্তিগত পত্রে আশা প্রকাশ করেন যে, সব রকমের জটিল পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে তিনি সফল হবেন। তিনি আরও বলেন, মার্কিন সোভিয়েত সম্পর্কোন্নয়নের চূড়ান্ত পথ ধরে আরও অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে আমাদের সঙ্কল্প মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলীর কারণে হ্রাস পায়নি।’ ব্রেজনেভের এই বার্তায় নিক্সন অভিভূত হন এবং রাষ্ট্রদূত ডোব্রিনিনকে ঘরোয়াভাবে তার সঙ্গে দেখা করার আমন্ত্রণ জানান। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ডোব্রিনিনের মাধ্যমে তিনি সোভিয়েতদের আশ্বাস দেন যে, তিনি এখনও দাঁতাতের প্রতি নিবেদিত। তারপর যেন পরিস্থিতি সম্পর্কে কেজিবির যে বিশ্লেষণ সেটাকে সমর্থন করে তিনি মার্কিন-সোভিয়েত সম্পর্কোন্নয়নের যে কোন উদ্যোগের বিরোধিতা করার জন্য ইসরাইল ও মার্কিন-ইহুদী সম্প্রদায়কে দোষারোপ করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নিক্সন নিজে ইহুদীবিরোধী ছিলেন। দাঁতাতের, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে দাঁতাতের সমর্থক অন্যান্য দেশও ছিল। আরব দেশগুলো আশা করেছিল যে, মার্কিন প্রশাসন যত বেশি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্ত হবে তত বেশি তারা ইসরাইলের কাছে ছাড় আদায় করতে পারবে। অন্যদিকে ইসরাইল আশা করেছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র তাঁর সীমান্তে শান্তির ব্যাপারে আরও জোরালো অঙ্গীকার আদায় করবে এবং ওই অঞ্চলে সোভিয়েত প্রভাব দুর্বল করবে। কিন্তু ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কারণে নিক্সন ইমপিচমেন্টের আশঙ্কায় থাকায় মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত নিক্সন ও সম্ভবত কিসিঞ্জার দৃশ্যপট থেকে হটে যাওয়ার আগেই মার্কিন মধ্যস্থতার সুযোগ নেয়ার জন্য অন্যান্য আরব নেতাকে বিশেষ করে সিরিয়ার হাফিজ আল আসাদকে বুঝিয়েছিলেন। আরব-ইসরাইল সংঘাত অবসানে কিসিঞ্জারের দূতিয়ালিতে সাদাত তার অপরিহার্য অংশীদার হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নিক্সনের সার্বিক অনুমোদনক্রমে কিসিঞ্জারের পরিচালিত এই দূতিয়ালি ছিল সেই সময় পর্যন্ত কোন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সবচেয়ে কঠিন সংলাপ। এই শাটল ডিপ্লোমেসি বহুলাংশেই ইমপিচমেন্ট নাটকের বাইরে ঘটেছিল। তুলনামূলকভাবে এটা অবিতর্কিত ছিল। এর ফলাফলও ছিল চিত্তাকর্ষক। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে মিসর ও ইসরাইল যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছে। কিসিঞ্জারের এই উদ্যোগে সৌদিরা এতই মুগ্ধ হয় যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় সিরিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে একই ধরনের চুক্তি হলে ওপেক যুদ্ধের সময় আরোপিত তেল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে। যুক্তরাষ্ট্র এতে রাজি হয়। তবে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে, ওই নিষেধাজ্ঞা আগে তুলতে হবে। এটাকে দামেস্ক আলোচনার জিম্মি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। ১৯৭৪ সালের মার্চে সৌদিরা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং কিসিঞ্জার ৩৫ দিনে ২৬ দফা বৈঠক শুরু করেন। নিক্সনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের নেপথ্যে কিন্তু ইমপিচমেন্ট সঙ্কট গভীরতর হয়ে ওঠায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে, পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যের জন্য তিনি কিসিঞ্জারকে কতটুকু কৃতিত্ব দিতে ইচ্ছুক তার একটা সীমা থাকা দরকার। ১৯৭৪ এর বসন্তে নিক্সন টের পেলেন তার প্রেসিডেন্ট পদ ভয়াবহ বিপদের মুখে। তখন তিনি কিসিঞ্জারের মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতির ওপর নিজের ভাসা ভাসা কমান্ড জাহির করার চেষ্টা করেন। অথচ কিসিঞ্জারকে দেয়ার মতো কোন উল্লেখযোগ্য পরামর্শ তার ছিল না। তবে নিক্সনের মনে হয়েছিল কিছুটা ভাল জনসংযোগ তার এখন একান্তই প্রয়োজন নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য। আর সে কারণেই তিনি সিরিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে চুক্তি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্পাদনের জন্য কিসিঞ্জারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেন। ১৯৭৪ সালের ৯ মে প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যালঘু রিপাবলিকান নেতা জন রোডস নিক্সনকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দেন। একই দিনে কিসিঞ্জার হেগকে জানান যে, সিরিয়ার সঙ্গে ইসরাইলের যে চুক্তি হতে যাচ্ছে তার প্রকাশ্য কৃতিত্ব নিক্সন পাবেন এবং বর্তমান আলোচনায় প্রেসিডেন্টের ভূমিকা উল্লেখের প্রতিটি সুযোগকে তিনি কাজে লাগাবেন। কিন্তু হোয়াইট হাউস আরও বেশি কিছু চাইছিল। নিক্সন অনুভব করছিলেন স্বদেশে তার সমস্যাবলী থেকে সবার দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য তার চমক লাগানো কোন সফরে যাওয়া প্রয়োজন এবং দেখিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে, কেবলমাত্র নিক্সনই যেমন চীনে যেতে পেরেছিলেন, তেমনি কেবল নিক্সনই দামেস্কে যেতে পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা মস্ত সমস্যা ছিল। ১৯৭৪ সালের মে বা জুন মাসে নিক্সনের মহাসাড়ম্বরে মধ্যপ্রাচ্য সফরে যাওয়ার ব্যাপারটা সিরিয়া-ইসরাইল চুক্তিতে উপনীত হওয়ার ওপর নির্ভর করছিল। অথচ সেই চুক্তি সম্পাদন মিসর-ইসরাইল চুক্তির চাইতেও কঠিন হয়ে উঠেছিল। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের প্রথমদিকে সিরিয়া প্রাথমিক সাফল্য পেলেও ইসরাইল সিরীয়দের গোলান মালভূমির সীমান্ত ছাড়িয়ে তাদের নিজস্ব ভূখ-ের গভীরে ঠেলে দেয়। সিরিয়া এখন ইসরাইলের কাছ থেকে এই যুদ্ধে দখলে নেয়া ভূখ-ই শুধু নয়, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলে নেয়া কিছু ভূখ-ও ফেরত চাইছিল। তার মধ্যে একটি ছিল গোলান মালভূমিতে ২০ হাজার লোক অধ্যুষিত শহর কুনেইত্রা। ইসরাইল এতে রাজি ছিল না। প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মায়ার কিসিঞ্জারকে বলে দিয়েছিলেন যুদ্ধে হারার পর ভূখ- ফেরত চাওয়ার কোন অধিকার সিরিয়ার নেই। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইসরাইল শেষে কুনেইত্রা থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়ে নগরীর পশ্চিম প্রান্তে রাখার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সিরিয়ার কাছে তা গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। এ অবস্থায় ১৪ মে কিসিঞ্জার নিক্সনকে জানালেন যে, ইসরাইল কুনেইত্রার ব্যাপারে আর কোন ছাড় দিতে রাজি না হওয়ায় স্বল্পমেয়াদী সময়ের মধ্যে সিরিয়া-ইসরাইল চুক্তির সম্ভাবনা নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। নিক্সন এতে রীতিমতো ক্ষেপে যান। ইসরাইলের প্রতি নিক্সনের সমর্থন বরাবরই নিরুত্তাপ ও কৌশলগত ছিল। ১৫ মে রাতে তিনি স্কাউক্রফটকে দু’দুবার ফোন করে বলেন, পরদিন সকালের মধ্যে ইসরাইল তার অবস্থান না পাল্টালে সে দেশকে সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ যেন দেয়া হয়। নিক্সনের যেন জিদ চেপে গিয়েছিল। কিন্তু কুনেইত্রার ব্যাপারে ইসরাইলের নতুন ভূমিকা তিনি কি ধরনের চান, তা বলেননি। চুক্তির ব্যাপারে অগ্রগতি না হওয়ায় নিক্সন যখন রাগে ফুঁসছিলেন, সে সময় মধ্যপ্রাচ্যের ওই তল্লাটের পরিস্থিতির নাটকীয় অবনতি ঘটে। ১৫ মে ভোরে সিরিয়া সমর্থিত ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দি লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন’-এর একটি গেরিলা দল ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলীয় শহর মালটের এক স্কুলে হানা দিয়ে ৫ ব্যক্তিকে হত্যা করে এবং ৪ শিক্ষক ও ৯০ জন ছাত্রছাত্রীকে জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে যায়। এই নতুন সঙ্কটের মধ্যে কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্টের আলটিমেটামের সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে দারুণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। জেরুজালেম থেকে তিনি নিক্সনকে লেখেনÑ ‘ইসরাইলকে সাহায্য বন্ধ করা সংক্রান্ত আপনার সাম্প্রতিক বার্তার ব্যাপারে আমি যতটা সম্ভব জোর দিয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এ ধরনের পদক্ষেপ আশু আলোচনার ক্ষেত্রে এবং মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন অবস্থানের জন্য বিপর্যয়কর হবে।’ তবে কিসিঞ্জার একই সঙ্গে নিক্সনকে শান্ত করতে এবং ইসরাইলের কাছ থেকে বাড়তি কনসেশন আদায় করে নিতে কোন না কোনভাবে সক্ষম হয়েছিলেন। যাই হোক, ইসরাইল শেষ পর্যন্ত কুনেইত্রা প্রশ্নে কিসিঞ্জার প্রণীত আপোস ফর্মুলা মেনে নেয়। আরও অবাক হওয়ার ব্যাপার হলো মেনে নেয় সিরিয়াও। সিরিয়ার রাজি হওয়ার একটা কারণ সম্ভবত এই যে, আসাদ বুঝেছিলেন বেশি একগুয়েমি করলে তাকে শান্তির আশা বিসর্জন দিতে হবে। কয়েকদিন পর অনেকটা শান্ত হয়ে ওঠা নিক্সন কিসিঞ্জারকে একটি ব্যক্তিগত বার্তা পাঠান। তাতে বলেন, ‘আমি মনে করি যথাশীঘ্র সম্ভব মধ্যপ্রাচ্য সফরের মধ্য দিয়ে এই অগ্রগতির পরবর্তী করণীয়টুকু আমাদের করা উচিত।’ ৩১ মে সিরিয়া ও ইসরাইল আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি সম্পাদনের দু’সপ্তাহ পর নিক্সন মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়ে বিপুল সংবর্ধনা লাভ করেন। সিরিয়া ও ইসরাইল সফরে যাওয়া তিনিই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং মিসর সফরকারী দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট। চলবে...
×