ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চিৎকার কর তবু পথ হারিয়ো না

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ৬ মার্চ ২০২০

চিৎকার কর তবু পথ হারিয়ো না

বিশ্ব সংস্কৃতির উঠোনে নাটক দুই তলে পরিবেশিত। এক-আবদ্ধ হল ঘরে, দুই-পথে প্রান্তরে বা মুক্তস্থানে। তবে ধারণা করা হয় নাটকের প্রথম যৌবন দ্বিতীয়খানাই। অর্থাৎ, এর মুখে ভাত পথে প্রান্তর দিয়েই। আর এই বৈশিষ্ট্যগত কারণেই নাটকীয় ব্যাকরণ একেসম্বোধন করে ‘পথনাটক’ নামে। সৃষ্টির শুরুর দিকে অর্থাৎ ভূমিভিত্তিক কৃষিসমাজ শুরুর পূর্ব-পর্যন্ত মানুষের যাপন তরিকা ছিল যাযাবর হালাতের। টিকে থাকার ঐ সময়টায় গোত্রের সদস্যদের প্রকৃতি উপযোগী করা হতো শিকার সংগ্রহের অভিনয় দিয়ে। যাতে ব্যবহৃত হতো শিকারের বল্লম, পাথর, লাঠিসহ নানা উপাদান। আর এই পুরো প্রক্রিয়া উপস্থাপন করা হতো উন্মুক্ত স্থানে। এ হিসেবে নাটকের আদি মাতা এবং প্রথম প্রপস ব্যবহারকারী মাধ্যম হিসেবেও পথনাটককে উল্লেখ করা যেতে পারে। পথকে কেন্দ্র করে এর উদযাপনের ঢংবহু পুরনো। ডিয়োনাইসাসের উৎসব উদযাপনকে কেন্দ্র করে আক্রোপোলিসের বেদীতে আসার পূর্ব পর্যন্ত পথে পথে নানান নৃত্য, গীত, রঙ্গকৌতুক ও হুল্লোড় পরিবেশিত হতো। আর এসবের সম্মিলিত সঙ্গমেই প্রথমে গ্রীক থিয়েটারের জন্ম এবং পরে রাজনৈতিক ও সামাজিক আবেদনে জন্ম পথনাটকের। পথনাটকের সংজ্ঞায়নেও যা স্পষ্ট হয়। মানুষের চলাচলের পথের পাশে কোন বিশেষ সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যামূলক ইস্যুভিত্তিক ক্ষুদ্রায়তনিক নাট্য পরিবেশনা-ই পথনাটক।যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখানটায় এর সংজ্ঞায়নের গভীরতা বা গূঢ়ার্থ বহুক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। সংজ্ঞায়নের যুক্তিতে পথনাটকের পরিবেশনা প্রয়োজন রাজনৈতিক এবং সামাজিক ইস্যুভিত্তিক। যার নজির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতের দুর্ভিক্ষ, মহামারীসহ নিত্য সঙ্কট ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। পথনাটক তখন তৎকালীন জনদুর্ভোগ এবং সম্ভাবনাগুলোকে চিহ্নিত করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর আবেদন রাজনৈতিক সুবিধার ভোগ-বিবাদে এবং আদর্শিক শূন্যতায় তলানিতে পৌঁছেছে। শুধু তাই নয় ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে এর ইস্যুর ধরন, পরিবেশনার উপাদান এবং ব্যাপ্তিকাল সবটাই বলদে যায়। অর্থাৎ শিল্পের যে সত্তাগত রাজনীতি, ক্ষুরধারা তলোয়ার, জমিন সেটা লুট হয়ে যায়। ঝান্ডা গারে দলীয় আনুগত্য, অনুকম্পা এবং পৃষ্ঠপোষকতা বাণিজ্য। পাশাপাশি ইতিহাসের গতি প্রকৃতির বদল তো আছেই। যেমন বলা যায় বিগত দুই জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে পেট্রোল সন্ত্রাস কিংবা কিছু মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে তাতে প্রায় সকল সংস্কৃতি কর্মীই আত্মরক্ষাকারী ভূমিকায় ছিলেন বা বলা যায় আপন প্রাণ বাঁচা ভূমিকায় ছিলেন। কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতির জগত তো এমন কোন দিন ছিল না। বরং শিল্পের যে নিজস্ব রাজনীতি সেই রাজনীতি সার্বজনীন এবং মানবিক। ভিন্নভাবে বললে সেটা নিজের আলো দিয়ে বাকি প্রদীপগুলো জ্বালানোর। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই আলো প্রায় নিরুদ্দেশের পথে। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৭ সালে পথনাটকের অভিষেক হয়সেলিম-আল-দীনের চর কাঁকড়ার ডকুমেন্টারি দিয়ে। যার গতি প্রকৃতি পরে এতই ব্যাপ্তি লাভ করে যে সাংগঠনিকভাবে ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পথনাটক পরিষদ’। বর্তমানে এই সংগঠন প্রত্যেকশীত মৌসুমে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বার্ষিক পথনাটক উৎসবও করে থাকে। যদিও অতীতের পাকিস্তানী শোষণ এবং স্বৈরাচারী আন্দোলনের বিরুদ্ধে পথনাটকের যে ভূমিকা ছিল স্বাধীন দেশের বিগত দুই জাতীয় নির্বাচনে যারা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়েছিল তাদের প্রশ্নে এরা ছিল প্রায় নির্জীব। যদিও ২০১৬’তে নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার ঘটনায় মান্নান হীরার রচনা এবং নির্দেশনায় ‘শিকারী’ নামের পথনাটক উল্লেখ্য। যেখানেতনুর জীবনাচরণ এবং তার প্রতি নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল নাটকটিতে এবং এর উদ্দেশ্য ছিল জনসচেতনতা এবং ন্যায্যতা দাবি। তাছাড়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত পথনাটক উৎসবগুলো দেখলেও দেখা যায় এখানে সামাজিক ইস্যু নিয়ে নির্মিত নাটকের সংখ্যা বেশি, রাজনৈতিক রচনা এবং নির্দেশনা ভীষণ কম। যদিও বিভিন্ন সময় বেশ কিছু রাজনৈতিক ইস্যু এসেছে যেগুলো নিয়ে নাটক নির্মাণের সুযোগ ছিল। তাছাড়া পথনাটক যেহেতু পথের ধারে এবং স্বল্প সময়ে স্বল্প আয়োজনের সে হিসেবে ক্ষমতার নামে যারা পেট্রোল সন্ত্রাস বা বোমাবাজি করেছে তাদের নিয়ে রচনার বেশ সুযোগ ছিল। তবে সেটা হয়নি। হয়ত ক্ষমতার পালাবদলে চেয়ার ধসে যাবে কিংবা অর্জিত পুরস্কার কেড়ে নেয়া হবে এমনও একটা বিষয় থাকতে পারে। তাছাড়া পূর্বে দেখা যেত এই সংস্কৃতি কর্মী এবং পথনাটক রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলোকে নিয়েও নাটক রচনা করেছে। রাষ্ট্র কোন সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করলে কিংবা নিতে অপারগ হয়ে দাঁড়ালে কিংবা কারো চাপে নিতে অসুবিধায় পড়লে পথনাটকের মাধ্যমে সংস্কৃতি কর্মীরা জনগণকে নিয়ে রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়িয়েছে। আবার রাষ্ট্রপ্রধানকে কোন বার্তা দিতে চাইলে সেটাও করেছে তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এখন কিছু নেতার আদলের কর্মীরা সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হবার লোভে পড়েছেন। নিজেদের সকল দায়বোধ বিসর্জন দিয়ে বলার আকাক্সক্ষাকে শিল্প-সংস্কৃতিকে ডিঙ্গিয়ে শুধু ওরালি জননেতার মতো বলতে ছুটেছেন। ফলাফল একটা দীর্ঘ সাংস্কৃতিক সঙ্কটের পথে রাষ্ট্র। তবে এও সত্য যে এই চিত্র শুধু বাংলার নয় বরং গোটা বিশ্ব সংস্কৃতির মানচিত্রের। আর এসব ছাপিয়ে যা সবচেয়ে মারাত্মক মহামারী তা হলো সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনায় রাষ্ট্র কর্তৃক দেয়া প্রণোদনা বা পৃষ্ঠপোষকতা সম্পর্কে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড চালানো নেতাদের মনোভাব। ক্ষেত্র বিশেষে তারা ভেবে বসেছেন এই পৃষ্ঠপোষকতা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা দলের! অর্থাৎ এরা প্রায় ভুলতে বসেছে এই প্রণোদনা বা পৃষ্ঠপোষকতা অর্থকড়ি জনগণের কষ্ট নিঃসৃত ঘামের। যে ঘাম চিৎকার করে বলে, সংস্কৃতির মাধ্যমগুলোর ধার যেন না কমে, বাঙালী সংস্কৃতি যেন না মরে যায়।
×