ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৮ মার্চ নারী দিবসের তাৎপর্য

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ৬ মার্চ ২০২০

  ৮ মার্চ  নারী দিবসের তাৎপর্য

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। শ্রম মজুরিতে বৈষম্যকরণ ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে লড়াই এবং মানুষ হিসেবে আপন মর্যাদাকে সংহত করতে অর্ধাংশ, অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া এই গোষ্ঠী এক সময় দৃঢ় প্রতিবাদে কর্তৃত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝমাঝি সময় থেকে শিল্প বিকাশের ধ্রুপদী যুগে শ্রেণী বিভাজন যখন সামাজিক বৈষম্যকে সর্বনাশা পর্যায়ে দাঁড় করায় তখন নিপীড়িত ও বঞ্চিত সিংহভাগ গোষ্ঠী আন্দোলন আর লড়াইয়ে সম্মুখ সমরকে আলিঙ্গন করতেও পিছপা হয়নি। সভ্যতা সূর্য যখন মধ্যগগনে, আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে আধিপত্যকারী শক্তি যখন হরেক রকম উপায় কৌশল অবলম্বনে নিজেরা সম্পদের পাহাড় গড়তে বদ্ধপরিকর সেই একই প্রক্রিয়ায় ধনের মজুদ তৈরিতে শ্রম বিনিয়োগকারী অতি সাধারণ গোষ্ঠী তাদের শ্রম ছাড়া আর সব হারিয়ে ফেলে। সেখানে অসহায় ও দুর্বল গোষ্ঠী হিসেবে নারীর অবস্থা হয় ভয়াবহ, শোচনীয়। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে মানুষে মানুষে ফারাক যেমন দৃষ্টিকটু একইভাবে নারী-পুরুষের সমান অধিকার অর্জনও একেবারে অনিশ্চিত। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে একটি উন্নত বিশ্ব উপহার দিলেও মালিকানা ভিত্তি উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে শ্রম বিনিয়োগকারী শ্রেণীর পোষণ প্রক্রিয়ার এক অপরিহার্য গতি। অতি সহজভাবে অনুমেয় একজন শিল্প-কারখানার মালিক তার ব্যবসায় যে অর্থ লগ্নি করে সেখান থেকে মুনাফা আসে অনেক বেশি। সব কি যান্ত্রিক সভ্যতার অবদান? যন্ত্রই কি অতি অল্প সময় বেশি পণ্য উৎপাদন করে ধনবাদীকে আরও ধন তৈরি করতে মূল নির্ণায়ক শক্তি? কথাটা আংশিক সত্য হলেও পুরোপুরি নয়। এখানে উৎপাদনের মূল নির্ণায়ক শক্তি অসংখ্য শ্রম বিনিয়োগকারী শ্রেণী। যাদের মূল্যবান শ্রমের বিনিময়ে মালিক পক্ষ ঐশ্বর্য সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু মূল নির্ণায়ক শক্তি শ্রমিকরা নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হতে থাকে। আর শ্রমিকদের মধ্যে যারা নারী তারা এমনিতেই সামাজিক বৈষম্যের শিকার সেই শিশুকাল থেকে। বৃহত্তর সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশে এসে আরও অসাম্য আর বঞ্চনাকে বরণ করে নেয়া ছাড়া কোন উপায়ও থাকে না। এমনিতেই মজুরি শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয় সেখানে নারী হিসেবে যে কত বিভেদ তৈরি হয় সেটা অবর্ণনীয়। শ্রমের ধরন এবং সময় নারী-পুরুষের বেলায় কোন তারতম্য হয় না। কিন্তু মজুরি প্রদানের সময় সেখানেও ফারাক দৃশ্যমান। আট ঘণ্টা কর্ম সময়ে একজন পুরুষ যদি ৪০০ টাকা আয় করে সেখানে নারীকে দেয়া হয় মাত্র ৩০০ টাকা। পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোর ন্যক্কারজনক অসাম্য বৈষম্যের আর এক নমুনা তো বটেই। যে কোন সমাজের মূল্যবোধ, সংস্কার এবং চেতনা এমনভাবে তৈরি হয় যেখানে জন্ম থেকেই কন্যা সন্তানরা প্রথমেই তার বাবা মার হাতেই নিপীড়ন আর নির্যাতনের আবর্তে পড়ে। শ্বশুরবাড়ি কিংবা পেশাগত জীবনের কর্তৃপক্ষের ব্যাপার তো আরও অনেক পরে। কিন্তু সভ্যতাবিবর্জিত অতি আদিম প্রাচীন সমাজের গুহাবাসী বন্য মানুষদের মধ্যে এমন ফারাক ছিল না বলে ঐতিহাসিক ও সমাজ বিজ্ঞনীদের অভিমত। বন্য দশায় আদিম মানুষরা প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে নিজেদের টিকিয়ে রাখত। এক অনবচ্ছেদ একাত্মতায় নারী-পুরুষ উভয়েই কোন গোষ্ঠী কিংবা গোত্রের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে জীবনযাপন করত। স্থায়ী কোন নিবাস ছিল না, উৎপাদনের কোন উপকরণ সে সময় দেখা যায়নি, ফলমূল সংগ্রহ করার আদিম অর্থনীতিতে নিরাপদ জায়গায় যাযাবর বৃত্তিই ছিল বন্য মানুষের একমাত্র উপায়। নারী-পুরুষের ফারাক তো ছিলই না বরং পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পরিবার হিসেবে আজও চিহ্নিত হয়ে আছে মাতৃতান্ত্রিকের অবস্থান। অবাধ স্বেচ্ছাচার আর দলগত বিয়েতে পিতৃত্বের কোন স্বীকৃতিই ছিল না। মার গর্ভ থেকে সন্তান আসত বলে মায়ের পরিচয় জানা যেত। ফলে জন্মদাত্রী মাতাই ছিল সন্তানের সমস্ত কৃতিত্বের দাবিদার। এমন কি সম্পদ ও বংশপঞ্জিও নির্ধারিত হতো মায়ের দিক থেকে। এমন নিয়মের ব্যত্যয় বহুকাল ঘটেনি। কিন্তু সভ্যতা সূর্য যখন তার আলো ছড়ানোর সন্ধিক্ষণে, সেই সময় শারীরিকভাবে পরাক্রমশালী পুরুষরা নিজেদের কর্তৃত্ব অর্জনের উপায় আর অবলম্বন তৈরিতে মনোযোগ দেয়। ইতোমধ্যে বিজ্ঞান গুহাবাসী মানুষদের জীবনকে স্থিতি অবস্থায় নিয়ে আসাই শুধু নয় উৎপাদনের উপায়গুলোকে আদিম মানুষদের সামনে দৃশ্যমানও করে তুলতে থাকে। উৎপাদন ব্যবস্থায় সম্পদ মজুদ করার যে নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয় সেখানে পুরুষদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে পিতৃত্বের পরিচয়। ফলে দলগত বিয়ে থেকে বিবাহ বন্ধনটা হয়ে যায় একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে। সমাজচিন্তক এঙ্গেলসের মতে সমাজের পরিবার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব নারী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয়। সেখান থেকে নারীরা অনেক লড়াই-বিপ্লব করেও সে আধিপত্য আর সম্মান অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ যখন মধ্যযুগের তাদের নতুন আস্তানা গড়ে তোলে সেখানেও সিংহভাগ মানুষ দাসত্বের শৃঙ্খল পড়ে মসস্ত মানবিক আর মৌলিক অধিকার শূন্য হয়ে যায়। এখনও চরম নৃশংসতাকে থাকি আমরা মধ্যযুগীয় বর্বরতা হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা যখন পৃথিবীব্যাপী আলোর দ্যুতি ছড়াতে থাকে তখনই সভ্যতা সূর্য তার পূর্ণ আভায় বিকশিত হলেও সিংহভাগ মানুষ নিরাপত্তাহীনতা, বঞ্চণা আর নির্যাতনের আবর্তে পড়তে থাকে। ফলে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, তথ্য-প্রযুক্তিতে আধুনিক বিশ্ব আজ সম্প্রসারিত এক সুবর্ণ সময়। কিন্তু শ্রেণী বিভাজনের কারণে সিংহভাগ মানুষ আজও অসহায়, লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত। সেখানে নারীদের অবস্থা আরও ভয়াবহ এবং অসহায়। আজও কন্যাশিশু যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে না, বাল্যবিয়ের শিকার হয় শ্রম মজুরিতে ব্যবধানের আবর্তে পড়ে। ফলে ১৮০০ শতাব্দীর আধুনিক যুগ পরম্পরায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতেও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় নারীরা এখন শুধু সামাজিক বৈষম্যই নয় পুরুষের তুলনায় অর্থনৈতিক তারতম্যেরও শিকার হচ্ছে। ফলে শিল্প বিকাশের ধ্রুপদী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারখানাগুলোতে নারী শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবি শ্রম মজুরি, শ্রমঘণ্টা কমানোসহ আরও অনেক শ্রমনীতি আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে নেমে আসে। সেই অধিকার আদায়ের সূচনা পর্ব শুরু হয় আমেরিকার বস্ত্রশিল্পের নারী শ্রমিকদের কাজের সময় কমানো ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে রাজপথে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়া। যে সোচ্চার কণ্ঠে নারীরা তাদের অধিকার অর্জনের দৃপ্ত ঘোষণা দেয় তা সমকালে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলে। দিনটি ছিল ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ। তবে এই বৈপ্লবিক দিন তার মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে আরও অর্ধ শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়। ১৮৫৭ সালের ধারাবাহিকতায় ১৮৬০ সালে ৮ মার্চ নারী শ্রমিকরা একাত্মতা ঘোষণা করে অধিকার আদায়ে সম্মিলিতভাবে ইউনিয়ন গঠন করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়। ফলে বিক্ষিপ্ত এবং অসাংগঠনিকভাবে ছড়ানো এই নারী অধিকার আন্দোলন আলোর মুখ দেখতে আরও ২৯ বছর পার করে দেয়। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে নারীর অধিকার আদায়ের ব্যাপারটি আরও জোরালোভাবে তুলে ধরেন। এর পরের ঘটনা প্রবাহ এমন আন্দোলনের সম্প্রসারিত পর্যায়ে আর বেগবান এবং দৃঢ় করে। ১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুট গার্টে আয়োজন করা হয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন। যেখানে যুদ্ধটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে ছিল না বরং শ্রেণী বিভক্ত পুঁজিবাদী কাঠামোকে নাড়া দিতেই সাম্যবাদী এক আন্দোলনের রূপরেখা বিনির্মিত হয়। ফলে ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে এক বিরাট সমাবেশের আয়োজন করা হলে নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিন এই সম্মেলনের নেতৃত্ব দেন, যা জার্মানির এই নেত্রীর পতাকাতলে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক নারী জমায়েত। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে ১৭টি দেশের ১০০ জন প্রতিনিধি নিয়ে ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মহা সম্মিলন। ১৯১১ সালে ৮ মার্চ তৃতীয় সমাবেশে নেত্রী ক্লারা জেটকিনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দিনটিকে ‘নারীর সমঅধিকার পালন দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতি বছর তা আনুষ্ঠানিকভাবে আয়োজন করার প্রত্যয় জানানো হয়। এ বছরই ১৯ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন’ বিশ্বব্যাপী আবেদন জাগায়। বিভিন্ন দেশে সমাবেশ, মিছিল, পথসভার মাধ্যমে দিবসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ১৯১৪ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটির তাৎপর্য বিবেচনায় পালন করা শুরু হয়ে যায়। ১৯৪৫ সালে সানফ্রান্সিসকোতে জাতিসংঘ সমতাভিত্তিক চুক্তিতে নারী অধিকারের যৌক্তিক দাবিগুলো বিবেচনায় আনে। ১৯৭৫ থেকে ’৭৭ এর মধ্যে জাতিসংঘ ৮ মার্চ নারী দিবসকে স্বীকৃতিও প্রদান করে। এরপর থেকে বিশ্বজুড়ে দিবসটি নারীর অধিকার সুরক্ষার মাত্রায় অনুষ্ঠান, সমাবেশ এবং সম্মেলনের আয়োজন করে যাচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও যথাযোগ্য মর্যাদায় নারী দিবসের তাৎপর্য অনুধাবনে নারী অগ্রযাত্রার বিভিন্ন সূচককে প্রাধান্য দিয়ে ৮ মার্চের গুরুত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে সংশ্লিষ্টদের জীবনমান উন্নয়নে প্রয়োগ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। শুধু তাই নয় সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে বাংলাদেশ বিভিন্ন সূচকে ইতোমধ্যে অনেকখানি এগিয়ে পাশাপাশি নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণের মতো অমানবিক, অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা নারীদের বিপর্যস্ত করছে এটাও কোনভাবে অস্বীকার করার পথ নেই। ব্যক্তি মানুষের সচেনতা যত বাড়বে, নাগরিক সমাজের মানবিক মূল্যবোধ যতই গতানুগতিক সংস্কারচ্ছন্ন চেতনাকে অতিক্রম করবে ততই নারীর প্রতি সহনশীলতা, সম্মান আর মর্যাদার ব্যাপারটিও সবাইকে অন্যের প্রতি দায়বদ্ধ হতেও নিয়ামকের ভূমিকা পালন করবে। সব মানুষ যদি তার স্বাধীনতা এবং ব্যক্তি অধিকারের পথ অবারিত করতে পারে তা হলে নারীরা যথাযথ মর্যাদায় সমাজ অধিষ্ঠিত হতে বেগ পাবে না। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×