ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষ পুড়ে মরে;###; তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না;###;সতর্ক হয় না সাধারণ মানুষ

বাড়ছে অগ্নিঝুঁকি ॥ ১৩ বছরে মরেছে ১৯১৬ জন, সম্পদহানি প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ২ মার্চ ২০২০

বাড়ছে অগ্নিঝুঁকি ॥ ১৩ বছরে মরেছে ১৯১৬ জন, সম্পদহানি প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার

শংকর কুমার দে ॥ আসছে শুষ্ক মৌসুম। বাড়ছে অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি। বিদ্যুতের শর্টসার্কিট, গ্যাস বিস্ফোরণ, দাহ্য কেমিক্যাল গোডাউন, রান্নাঘরসহ ছোটখাটো অনবধানতায় ঘটে যাচ্ছে বড় দুর্ঘটনা। প্রতি বছরই অগ্নিকান্ডের ঘটনায় হতাহত ও সম্পদহানি ঘটছে। ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয়। কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে অগ্নিকান্ডের কারণ উল্লেখ করে। নানা সুপারিশ করে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য। এসব সুপারিশমালা বাস্তবায়ন হয় খুবই কম। অনবধানতা ও অসতর্কতার কারণে প্রতি বছরই অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অসংখ্য মানুষ হতাহত এবং সম্পদহানির মাধ্যমে রিক্ত নিঃস্ব হয়ে যায়। গত বছরেই সারাদেশে ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছে ১৮৫ জন। আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। সম্পদহানি হয়েছে ৩৩০ কোটি ৪১ লাখ টাকা। গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে আগুনে পুড়েছে অন্তত ১২ হাজার মানুষ। আর এর মধ্যে মারা গেছে এক হাজার ৯১৬ জন। গত ১৩ বছরে সম্পদহানির পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডে একটি পাঁচ তলা ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে মর্মান্তিকভাবে তিনজন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। রবিবার মারা গেছে আরও একজন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন আরও চারজন। এছাড়া হুড়াহুড়ি করে নামতে গিয়ে আরও অন্তত দশজন আহত হয়েছেন। ভবনের নিচ তলায় গ্যারেজের বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে দমকল বাহিনীর ধারণা। অগ্নিকান্ডের সময়ে পাঁচ তলা ভবনের ফ্ল্যাটগুলোর পরিবারের সবাই ঘুমিয়ে ছিল। চলতি বছরে রাজধানীতে এটাই সবচেয়ে মর্মান্তিক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। দমকল বাহিনীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর ২০১৯-এ আগুনের ঘটনায় ৩৩০ কোটি টাকার সম্পদহানি হয়েছে। শিল্প কারখানা ও আবাসিক ভবনে গেল বছর ছোট বড় মিলিয়ে ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকান্ডে সম্পদহানি হয়েছে ৩৩০ কোটি ৪১ লাখ টাকার। মৃত্যু হয়েছে ১৮৫ জনের। দেশের শিল্প কারখানায় আগুনের ঘটনা কমছে। বাড়ছে আবাসিক ভবনে অগ্নিকান্ড। অসতর্কতাই এর মূল কারণ। বনানীর এফআর টাওয়ার ও চকবাজারের ভয়াবহ আগুনে হতাহত ও সম্পদহানি মর্মান্তিক ঘটনা এখনও সবার কাছে হৃদয় বিদারক স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। দমকল বাহিনীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে আগুনে পুড়েছে অন্তত ১২ হাজার মানুষ। আর এর মধ্যে মারা গেছে এক হাজার ৯১৬ জন। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর অগ্নিকান্ডে ১২৪ জন নিহত হয়েছিল। গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনের আগুনে প্রাণ হারান ৭০ জন। এর এক মাস পর গত ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালে ২৪ নবেম্বর আশুলিয়ার তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১১১ জন নিহত হয়। এতে সরাসরি আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায় ১০১ জন পোশাক শ্রমিক। পুরান ঢাকার নিমতলী, চুড়িহাট্টার ও বনানী অগ্নিকান্ডসহ কয়েকটি বড় অগ্নিদুর্ঘটনা মানুষের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। দমকল বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকার নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটি ১৭ দফা সুপারিশ করেছে। সুপারিশমালার মধ্যে রয়েছে জরুরী ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ, বাজারজাতকরণ এবং বিক্রির জন্য লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া জোরদার করা, ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩’ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্য বা বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুদকরণ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, ঘরবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের গুণগতমান নিশ্চিত করা, রাস্তায় স্থাপিত খোলা তারের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা পরিহার করতে প্রতি মাসে অন্তত একবার বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার সরেজমিনে গিয়ে পরীক্ষা করা, দ্রুত অগ্নিনির্বাপণের জন্য স্থানীয়ভাবে পৃথক পানির লাইনসহ হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন করা, দুর্ঘটনা মোকাবেলায় জাতীয় পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন, রাসায়নিক ও রাসায়নিক জাতীয় দাহ্য বস্তুর আলাদা দফতরের পরিবর্তে সব দফতরের মধ্যে সমন্বয় সাধন, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অবকাঠামো, জনবল, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের আধুনিকায়ন, জনসচেতনতা বাড়ানো, অগ্নিকান্ডের সময় যেন উৎসুক জনতা উদ্ধার কাজে বিঘœ ঘটাতে না পারে সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো, পাঠ্যসূচীতে অগ্নিকান্ড, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করা, ৬২ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা, কমিউনিটি সেন্টারগুলো নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো ডেকোরেটরের উপকরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয়সংখ্যক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা ইত্যাদি। দমকল বাহিনীর রিপোর্টে বলা হয়, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য চাহিদা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অবকাঠামো বাড়ানো হলেও এখনও সেক্টরটি অত্যাধুনিকভাবে গড়ে ওঠেনি। এ জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলার চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং প্রতিটি মসজিদের ইমাম ও দলীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে অগ্নিকান্ড সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা যেতে পারে। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো টেলিফোন হটলাইন নাম্বার এবং ওয়েবসাইট স্থাপন (ইমেল ঠিকানাসহ) করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ের হাসপাতালগুলো এমন একজন প্রতিনিধি চিকিৎসক থাকবেন, যিনি পোড়া রোগী সম্পর্কে প্রতিরোধ ও পোড়া রোগী ম্যানেজমেন্ট করার তথ্য প্রদান করবেন এবং ওই হটলাইন নাম্বার মিডিয়ার স্ক্রলিংয়ের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে অবহিত করবেন, যাতে পুড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা সম্পর্কিত বিষয়ে তথ্যাদি অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করতে পারেন। দমকল বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, নিমতলীর ঘটনার ১০ বছর পরও সুপারিশমালাগুলোর অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা হয়নি। আসলে শুধু চকবাজার থেকে নয়, দেশের যে কোন আবাসিক এলাকায় অতিদাহ্য পদার্থ বা বিপজ্জনক উপাদানের গুদাম থাকতে পারে না। এ জন্য পুরান ঢাকাসহ দেশের সব জায়গায়ই আবাসিক এলাকা থেকে বিপজ্জনক কারখানা, বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থের গুদাম বন্ধে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। নিমতলীর ঘটনার ১০ বছর পরও পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থে ভরপুর গুদামগুলো সরিয়ে নেয়া হয়নি বলেই আবার চকবাজারে আগুনের নৃশংসতা দেখল মানুষ। বিশেষ করে গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডারের দুর্ঘটনা এড়াতে হলে তার মান সম্পর্কে কঠোর হতে হবে। কারণ ঝুঁকিপূর্ণ কলকারখানা, গ্যাস সিলিন্ডার ও গুদামের সঙ্গে মানুষের বেঁচে থাকা এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব জড়িত। মূলত চকবাজার, নিমতলী, তাজরিন গার্মেন্ট কিংবা অন্য কোন ভয়াবহ অগ্নিকান্ড যেন না ঘটে, সে জন্য জোর প্রচার অভিযান চালাতে হবে, পাশাপাশি আবাসিক এলাকা থেকে দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানা অবিলম্বে অপসারণ ও বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলোর প্রতিকার করতে হবে এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও নিতে হবে কঠোর আইনী ব্যবস্থা নেয়া হলেই আগুনে পুড়ে মৃত্যু কমানো সম্ভব।
×