ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির শেষ সিরিজ

প্রকাশিত: ১১:৫০, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির শেষ সিরিজ

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের একমাত্র টেস্ট ম্যাচটি শনিবার থেকে শুরু হবে। এ টেস্ট শেষেই বাংলাদেশ ও জিম্বাবুইয়ের মধ্যকার তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ শুরু হবে। সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ১, ৩ ও ৬ মার্চ যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হবে। এ ওয়ানডে সিরিজে মাশরাফি বিন মর্তুজাই অধিনায়ক হিসেবে থাকবেন। তবে এ সিরিজই অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির শেষ সিরিজ হবে। তবে এখনই ক্রিকেট ছাড়ছেন না মাশরাফি। শুধু জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে সিরিজ শেষে ওয়ানডে অধিনায়কত্ব শেষ হচ্ছে তার। বুধবার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এমনটিই জানিয়েছেন। মাশরাফির ভূমিকা জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজে আসলে কি হবে, এ নিয়ে এবং টেস্ট শুরুর আগে দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে আলোচনা করতে বুধবার বিসিবিতে আসেন বিসিবি সভাপতি। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে টেস্ট দলের তিন ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম, মুমিনুল হক ও তামিম ইকবালের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বিসিবি সভাপতি। সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, অধিনায়ক হিসেবে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে সিরিজটিকেই মাশরাফির শেষ সিরিজ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেছেন, ‘সামনের ওয়ানডে বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে আমাদের দল গোছাতে হবে। একজন অধিনায়কও ঠিক করতে হবে। বিশ্বকাপের আগে অন্তত দুই বছর যেন ওই অধিনায়কের নেতৃত্বে টিমটা খেলতে পারে। সুতরাং খুব দ্রুত আমরা ওয়ানডেতে নতুন অধিনায়কের নাম ঘোষণা করব। সম্ভবত আগামী ৭-৮ তারিখে বোর্ড সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।’ মাশরাফি সিরিজে খেলবেন এবং শেষবারের মতো নেতৃত্বও দেবেন। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে যে কোন পর্যায়ে খেলতে যে এখন বিপ টেস্ট দিতে হয়। তাতে পাস মার্ক পেলেই খেলার অনুমতি মিলে। মাশরাফিকেও সেই টেস্ট দিয়েই খেলতে হবে বলে জানান বিসিবি সভাপতি, ‘মাশরাফি এই (জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে) সিরিজে অবশ্যই খেলছে এবং সেটা অধিনায়ক হিসেবে। তবে ফিট না হলে সেটা ভিন্ন কথা। আগে তো বিপ টেস্ট পাসের কোন ব্যাপার ছিল না। এখন তো এটা পাস করতে হয়। প্রথম কথা মাশরাফিকে বিপ টেস্টে পাস করে আসতে হবে। ওর জন্য অতটা কড়াকড়ি করব না।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘আমি সবসময়ই বলে এসেছি সাকিবের মতো বদলি খেলোয়াড় আমাদের নেই, আবার মাশরাফির মতো অধিনায়ক এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। এটা মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে যেভাবে টার্নওভার করেছে তাতে সবচেয়ে বড় অবদান মাশরাফির। তার নেতৃত্ব ছিল অসাধারণ। আবার এটাও ঠিক ওর (মাশরাফির) সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেয়ার, আর কতদিন খেলবে।’ জিম্বাবুইয়ে সিরিজে অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির শেষ সিরিজ হলেও খেলোয়াড় হিসেবে তার দরজা এখনই বন্ধ হচ্ছে না। ফিট থাকলে, ফর্মে থাকলে অন্যদের মতো বিবেচনায় থাকবেন মাশরাফিও। বিসিবি সভাপতি যেমন বলেছেন, ‘অধিনায়ক আমরা ঘোষণা করে দেব। কারও যদি পারফর্মেন্স এবং ফিটনেস ঠিক থাকে তাহলে খেলতে তো কোন সমস্যা নেই। কেউ যদি খেলে যেতে চায়, খেলবে। জাতীয় দলে চান্স পেতে হলে যা যা করতে হয় সেগুলো মাশরাফি পূরণ করতে পারলে খেলতে তো কোন সমস্যা নেই।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘আমরা দেখি নামী দামী খেলোয়াড়রা পরিকল্পনা করেই বলে দেয়, এটা আমার শেষ সিরিজ। আমাদেরও ইচ্ছে ছিল মাশরাফি যদি এমন সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে আমরা আয়োজন করে তাকে বিদায় জানাব। ইংল্যান্ডে থাকতে এমন ভাবনাই ছিল মাশরাফির। কিন্তু দেশে ফেরার পর দেখলাম ওর মানসিকতা কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। ও অবসর না নিলেও আমাদের তো একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। খুব দ্রুতই আমরা আগামী বিশ্বকাপে যে নেতৃত্ব দেবে এমন একজনকে ওয়ানডে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব দেব। তারপর ও যদি নিজের পারফর্মেন্সে দলে ঢুকতে পারে ঢুকবে। এটা তো কারও জন্য বাধা নয়।’ মাশরাফি অধিনায়ক না থাকলে সেই ভার সাকিব আল হাসানের কাঁধেই পড়ার কথা। কিন্তু সাকিব এখন নিষিদ্ধ। যদিও এ বছর অক্টোবরের পরই সেই নিষেধাজ্ঞা কেটে যাবে। এরপর যদি সাকিবের পারফর্মেন্স ঠিক থাকে তাহলে সাকিবকেই ওয়ানডের নেতৃত্বে দিতে চান বিসিবি সভাপতি, ‘অবশ্যই। ও যদি ফর্মে চলে আসে। যেমন সাকিব ছিল, তেমনটাই থাকে তবে অবশ্যই সে অধিনায়ক হবে।’ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর থেকেই মাশরাফিকে আর জাতীয় দলের সঙ্গে খেলতে দেখা যায়নি। শ্রীলঙ্কা সফরে ইনজুরির জন্য যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল টি২০) খেলেছেন। কিন্তু ওয়ানডে খেলা হয়নি। গত বছর জুন-জুলাইয়ে ওয়ানডে বিশ্বকাপ হয়। এরপর জুলাইয়েই শ্রীলঙ্কা সফরের পর আর কোন ওয়ানডে খেলাই ছিল না। টেস্ট আর টি২০ খেলা হয়েছে। এবার প্রায় আটমাস পর আবার জাতীয় দলের জার্সিতে দেখা যাবে মাশরাফিকে। অধিনায়ক হিসেবেই ফিরবেন। তবে এবারই তাকে শেষবারের মতো ওয়ানডেতে অধিনায়কত্ব করতে দেখা যাবে। টেস্ট খেলেন না। টি২০ থেকে আগেই অবসর নিয়েছেন। ওয়ানডে খেলেন। অধিনায়কও তিনি। শেষবারের মতো জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে অধিনায়কত্বও করবেন। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে অধিনায়কত্ব ক্যারিয়ার শুরু করেন মাশরাফি। তার আগে ২০০৯ সালেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে অধিনায়ক ছিলেন। কিন্তু ইনজুরিতে পড়ায় আর ওয়ানডে সিরিজে নেতৃত্ব থাকেনি। সাকিব আল হাসানের কাঁধে অধিনায়কত্বের ভার পড়ে। ২০১০ সালেই মূলত নিয়মিত অধিনায়কত্ব শুরু করেন। মাঝপথে তিন বছর আবার অধিনায়কত্ব হারান। আবার ২০১৪ সালে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে অধিনায়কত্ব দিয়ে যে এই পদের স্বাদ নেন, এখনও নিচ্ছেন। তবে এবার জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ শেষ হতেই এই পদে দেশের সফল ওয়ানডে অধিনায়ককে আর দেখা যাবে না। বিশ্বকাপে মাশরাফির যে ব্যর্থতা দেখা গেছে, ৮ ম্যাচ খেলে ১টি মাত্র উইকেট শিকার করতে পেরেছেন। তাতে মাশরাফির অবসর নিয়েই কথা উঠে গেছে। মাশরাফির অবসরের সময় হয়ে গেছে, সেই জল্পনাই চলে। কিন্তু মাশরাফি যে এখনই অবসর নেবেন না তা জানিয়ে দেন। ২০ বছর খেলে যাওয়ার কথাই বলেন। সর্বশেষ বিপিএলে এলিমিনেটরে নিজের দল ঢাকা প্লাটুনের বিদায় শেষে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-২ আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদ মাশরাফি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে, সুস্থ থাকলে ইচ্ছা আছে (আবার বিপিএলে খেলার)। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কি হবে জানি না, তবে সবকিছু মিলিয়ে একটা ইচ্ছা ছিল বিশ বছর ক্রিকেট খেলার। শুধু যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই আছে তা তো নয়। ঢাকা লীগ, বিপিএল এসব আমাদের এখানে বড় টুর্নামেন্ট, এখান থেকে জাতীয় দলে যায়।’ সেই ১৯ বছর আগে ২০০১ সালে দেশের ক্রিকেটে পা পড়ে মাশরাফির। ঘরোয়া ক্রিকেটও যেমন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও ২০০১ সালে শুরু। অনুর্ধ-১৭ দলে ঝলক দেখিয়ে সে বছরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলা দিয়েই টেস্ট, ওয়ানডে অভিষেক হয়। সেই থেকে একের পর এক পায়ে অপারেশনের পরও দমে যাননি মাশরাফি। ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ বরাবরই অদম্য প্রাণশক্তি নিয়ে বোলিং করে গেছেন। বাংলাদেশ দলকে জিতিয়েছেন। ১৯ বছর ধরে খেলে চলেছেন। আর এক বছর গেলে হবে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ২০ বছর। তার মানে আরও একটি বছর খেলে যাবেন মাশরাফি। তিনি বলেছিলেন, ‘আগে থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল বিশ বছর খেলার। হবে কিনা জানি না, তবে ইচ্ছা আছে। এখন বিপিএল যদি পরের বছর সময় মতো হয়, তাহলে ইচ্ছা আছে। তবে বলতে পারছি না এখনই। ইচ্ছা আছে খেলার। দেখা যাক।’ ওয়ানডে দল বাংলাদেশের অনেক মজবুত। টেস্ট, টি২০তে দল যেভাবে ব্যর্থতার বৃত্তে আটকা থাকে, ওয়ানডেতে তা নয়। ওয়ানডেতে জয় আসে। খুব ভাল ফলও মিলে। তা মিলেছে আসলে মাশরাফির হাত ধরেই। ২০১৪ সালের নবেম্বরের আগ পর্যন্ত ওয়ানডেতে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। যে মাশরাফিকে অধিনায়ক করা হয়। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে সিরিজ জয় দিয়ে যে শুরু হয়, সাফল্য আকাশচুম্বী মিলে। ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে এত বড় সাফল্য মিলে। এরপর দেশের মাটিতে পাকিস্তানকে প্রথমবারের মতো সিরিজে হারানোর সঙ্গে হোয়াইটওয়াশও করে। পাকিস্তানকে হারানোর পর ভারতকেও সিরিজে হারায়। ভারতকে বধ করার পর দক্ষিণ আফ্রিকাকেও সিরিজ হারের স্বাদ দেয় বাংলাদেশ। মাশরাফির নেতৃত্বেই তা সম্ভব হয়। বাংলাদেশ দল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। এই টুর্নামেন্টে সেমিফাইনালেও খেলে। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের ফাইনালেও খেলে বাংলাদেশ। গত বছর বিশ্বকাপে খেলতে গিয়েই যত গ-গোল বাধে। এই বিশ্ব আসরে সেমিফাইনাল খেলার আশা নিয়ে গিয়ে তিনটি ম্যাচ জিততে পারে বাংলাদেশ। আবার দলনেতা হিসেবে মাশরাফি নিজেও ব্যর্থ হন। সবমিলিয়ে মাশরাফির অবসরের বিষয়টিই সামনে চলে আসে। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন অবশ্য বিশ্বকাপ শেষ হতেই বলেছিলেন, দেশের মাটিতে কোন এক সিরিজে মাশরাফিকে বিরোচিতভাবে, জমকালোভাবে বিদায় দেয়া হবে। কিন্তু মাশরাফি এমন বিদায় নিতেও নারাজ। তিনি বলেছিলেন, ‘কখনও ভাবি না যে মাঠ থেকে আমাকে সবাই বিদায় দেবে, ফুলের তোড়া নিয়ে আসবেন।’ সঙ্গে যোগ করেছিলেন, ‘বিসিবিতে যারা আছে তারা চিন্তা করবে (জাতীয় দলে সুযোগ দেবে কি না)। আমার এতটুকু স্বাধীনতা তো আছে যে, খেলতে চাই। বাংলাদেশে অনেক খেলোয়াড় আছে যারা মাঠ থেকে অবসরে যায়নি। হাবিবুল বাশার সুমন বাংলাদেশের ক্রান্তিকালে সবসময়ই রান করেছে। তিনিও মাঠ থেকে অবসরে যাননি। সুজন ভাই (খালেদ মাহমুদ) হয়তো করতে পেরেছে। এটা দুর্লভ। একটা সময় হয়তো ভাবতাম যে মাঠ থেকে করব কি করব না। এখন মনে হচ্ছে প্রয়োজন নেই।’ মাশরাফি মাঠ থেকে বিদায় নিতে চান না। তার মানে নিজের কথামতো আরও একটি বছর অন্তত খেলে যাবেন। কিন্তু এবার যদি পারফর্মেন্স ভাল না হয় তাহলে কী আর জাতীয় দলেও সুযোগটা ধরে রাখা যাবে? সেই প্রশ্ন উঠছে। তবে সেই প্রশ্নের উত্তর সময় দেবে। তবে অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ৮৫ ম্যাচ খেলে সবচেয়ে বেশি ৪৭টি জয় পাওয়া মাশরাফির অধিনায়কত্ব ক্যারিয়ার যে ৬ মার্চের পরই, জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডের পরই শেষ হয়ে যাচ্ছে তা নিশ্চিত হয়ে গেছে।
×