ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিঝুঁকিতে ঢাকার এক শ’ বস্তি ছাড়াও ৪৩৩ হাসপাতাল আর ২৪৯ ক্লিনিক

বনানীর টিএ্যান্ডটি কলোনির বস্তির তিন শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বনানীর টিএ্যান্ডটি কলোনির বস্তির তিন শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ল বনানী টিএ্যান্ডটি কলোনি বস্তির তিন শতাধিক ঘর। আগুনে ভস্মীভূত ঘর মালিকদের আশ্রয় এবার খোলা আকাশের নিচে। যদিও আগুনে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। শুক্রবার রাত সাড়ে তিনটার দিকে আগুন লাগে। শনিবার ভোর সাতটা নাগাদ ফায়ার সার্ভিসের বাইশ ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ততক্ষণে স্বল্প আয়ের প্রায় দুই হাজার মানুষের সর্বস্ব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে দ্রুত রিপোর্ট পেশ করতে বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের অপারেশনস এ্যান্ড মেনটেন্যান্স বিভাগের সার্ভে মোতাবেক, ঢাকার এক শ’ বস্তি ছাড়াও সচিবালয়, ঢাকার সরকারী-বেসরকারী মিলিয়ে ৪৩৩ হাসপাতাল ও ২৪৯ ক্লিনিক অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে। এরমধ্যে হাসপাতাল ও ক্লিনিক মিলিয়ে ১৭৩ মারাত্মক অগ্নিনিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। শুক্রবার রাত সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকার বনানী টিএ্যান্ডটি বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় বস্তিবাসী অধিকাংশই ঘুমে ছিলেন। মাত্র আধাঘণ্টার মধ্যে আগুন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। বস্তির মাঝামাঝি একটি জায়গায় প্রথম আগুনের লাগে হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। মুহূর্তেই আগুন আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের দশটি ইউনিট ঘটনাস্থলে হাজির হলেও আগুনের ন্যূনতম হল্কা থামাতে পারছিল না। পরে ফায়ার সার্ভিসের আরও ১২ ইউনিট সেখানে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনের লেলিহান এতটাই তীব্র ছিল যে, আশপাশের অন্তত কোয়ার্টার কিমি এলাকা আলোকিত হয়ে গিয়েছিল। বস্তির আশপাশের বাসাবাড়ির লোকজনের মধ্যে মারাত্মক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাদের অনেকেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে খোলা জায়গায় আশ্রয় নেন। বস্তিবাসী ও আশপাশের মানুষের আত্মচিৎকারে পুরো এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। ক্ষতিগ্রস্তরা পরে বস্তির পাশের খোলা জায়গা ও রাস্তার ধারে অবস্থান নিয়েছেন। আগুনে টিন আর বাঁশের ঘরগুলো পুড়ে একেবারে কয়লা হয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের অপারেটর শাহাদাত হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, আগুন লাগার খবর পেয়েই ফায়ার সার্ভিসের ২২ ইউনিট কাজ করে। ভোর পাঁচটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আর সকাল সাতটার দিকে সম্পূর্ণ আগুন নেভানো সম্ভব হয়। অগ্নিকা-ের কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে উপপরিচালক নূল হোসেন। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেনÑ সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম, উপসহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেন ও তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন মাস্টার ফয়সালুর রহমান। কমিটিকে দ্রুততার সঙ্গে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এদিকে খবর পেয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, গ্যাস ও বিদ্যুত বিভাগের লোকজন সেখানে হাজির হয়। শনিবার সকালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিএনপির পরাজিত মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল, চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুকসহ বিএনপি সমর্থিত স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী মিজানুর রহমান ও ফারুক হোসেনসহ স্থানীয় নেতাকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীকে সান্ত¦না দেন। তাবিথ আউয়াল বলেন, বস্তিতে আগুন লাগে, তদন্ত কমিটিও হয়। কিন্তু সেই তদন্ত রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশ হয় না। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানান। প্রসঙ্গত, গত ২৪ জানুয়ারি ঢাকার রূপনগরে চলন্তিকা বস্তিতে ভয়াবহ আগুনে তিন শতাধিক ঘর পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ১৫ ইউনিট টানা প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ভয়াবহ ওই অগ্নিকা-ে দগ্ধ হয়ে পারভীন আক্তার (৩৫) নামে এক গৃহকর্মী মারা যায়। ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ করছে। এর আগে গত বছরের ১৬ অগাস্ট একই বস্তিতে লাগে ভয়াবহ আগুনে অন্তত এক হাজার ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি মিরপুর-১৪ নম্বর সরকারী দুই বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা ভাষানটেক বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে পাঁচ শতাধিক ঘর পুড়ে যায়। নিহত হয় তিনটি শিশু। ফায়ার সার্ভিসের ২১ ইউনিট প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ওই ঘটনার তদন্তেও ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ করছে। স্থানীয় সরকারের অধীনে কাজ করা বিভিন্ন দাতা সংস্থার পরিসংখ্যান মোতাবেক দেশের ২৪ জেলার ২৯ শহরে ৪৫ হাজার বস্তি আছে। এরমধ্যে টঙ্গী ও সাভারেই বস্তির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এসব বস্তি ৫ হাজার একর সরকারী জমির ওপর গড়ে উঠেছে। রেলওয়ে বিভাগের তথ্য মোতাবেক, সারাদেশে সরকারী, আধা সরকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি প্রায় সাড়ে ৪ হাজার একর রেলওয়ের জমি অবৈধ দখলে রেখেছে। বেদখলে থাকা জায়গায় ভারি ও হাল্কা আধাপাকা স্থাপনা ছাড়াও গড়ে উঠেছে বস্তি। ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ২৩ কিমি. রেলপথের দুই ধারের প্রায় ৫৮ একর জমিতে রয়েছে হাজার হাজার অবৈধ স্থাপনা আর বস্তি। দাতা সংস্থা ইউপিপিআর (আরবান পার্টনারশিপস ফর পোভার্টি রিডাকশন্স প্রজেক্টের) জরিপ অনুযায়ী, বস্তিগুলোতে অন্তত ৫ লাখ হতদরিদ্র মানুষ বাস করে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের হিসেব অনুযায়ী, ঢাকায় ছোট বড় এক শ’ বস্তি আছে। গত চার বছরে ছোট ছোট দশটি বস্তি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরমধ্যে রেলওয়ের জায়গার উপরই গড়ে উঠেছে ৭০ বস্তি। অন্যান্য বস্তিগুলো সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে। ঢাকায় বস্তিতে বসবাস করছেন অন্তত ২ লাখ গরিব মানুষ। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের অপারেশনস ও মেনটেনেন্স বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, তারা নিজস্ব উদ্যোগে করা সার্ভে মোতাবেক ঢাকার সরকারী-বেসরকারী মিলিয়ে ৪৩৩ হাসপাতাল ও ২৪৯ ক্লিনিক অগ্নিনিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। এরমধ্যে এক শ’ তেয়াত্তরটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অগ্নিনিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতালের সংখ্যা ফায়ার সার্ভিসের সার্ভেমতে হাসপাতালের মোট সংখ্যার শতকরা ৯৮ শতাংশ। সার্ভে মোতাবেক বেডের তুলনায় হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগী বেশি, ভবনে র‌্যাম্প ও জরুরী সিঁড়ির অভাব, স্টোরিং গাইডলাইনের অভাব, হাসপাতালগুলোয় থাকা ফায়ারে সরঞ্জামাদি চালানোর মতো লোকের অভাব, ফায়ার ডিটেকশন ও প্রটেকশন সিস্টেমের অভাব, আর্থিং ব্যবস্থা না থাকা, এলপিএস সিস্টেম (লাইটিং প্রটেকশন) না থাকা, পর্যাপ্ত পানির অভাব, আবাসিক ভবনে হাসপাতাল স্থাপন, ইভ্যাকুয়েশনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গার অভাবসহ নানা কারণে হাসপাতালগুলো মারাত্মক অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়াও হাসপাতালে নিয়মতান্ত্রিক অক্সিজেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের ব্যবহার না হওয়া, রান্নাঘর স্থাপন, লন্ড্রি হাউসের অব্যবস্থাপনা, অনিরাপদ বয়লার ব্যবহার, বৈদ্যুতিক স্থাপনা (জেনারেটর, ট্রান্সফর্মার), অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ইন্টেরিওর ডেকোরেশন, কার পার্কিং, খোলা বাতির ব্যবহার (মোমবাতি, মশার কয়েল), ধূমপান, অপরিকল্পিত স্টোরসহ নানা কারণে অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হুসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, অগ্নিঝুঁকিতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঝুঁকি এড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই অনেক প্রতিষ্ঠান তা মেনেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে ফায়ার এলার্ম ও ডিটেকশন সিস্টেম স্থাপন, ফায়ার পাম্প সিস্টেম, পর্যাপ্ত পানির রিজার্ভার ও স্ট্যান্ডপাইপ সিস্টেম সংরক্ষণ, ফায়ার হোজ ও ফাস্ট এইড হোজ কানেকশন ফায়ার হাইড্রেন্ট ও ফায়ার লিফ্ট ও হাসপাতাল লিফট সংরক্ষণ, ফায়ার কমান্ড স্টেশন স্থাপিত হয়েছে। অগ্নিকা-ের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ বিষয়ে এই সেনা কর্মকর্তা বলছেন, আমরা নিয়মিত তদন্ত রিপোর্ট সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা দিই। সরকার সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়। তিনি বলেন, ঢাকায় সবমিলিয়ে বর্তমানে প্রায় এক শ’ বস্তি আছে। প্রতিটি বস্তিই অগ্নিঝুঁকিতে আছে। কারণ বস্তির ঘরগুলো বাঁশ, কাঠ বা এ ধরনের জিনিসপত্রে তৈরি। এসব জিনিস আগুনের সংস্পর্শে আসামাত্র জ্বলে ওঠে মুহূর্তেই তীব্র লেলিহানে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। এজন্য বস্তিগুলো তুলনামূলক বেশি অগ্নিকা-ের ঝুঁকিতে আছে। শুধু বস্তি নয়, সচিবালয়ের মতো স্থাপনাও রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে। বিষয়টি আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। পাশাপাশি অগ্নি ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করছি।
×