ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হাঁকডাক করেও মাঠে নামেনি বিএনপি

প্রকাশিত: ১০:৪১, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

হাঁকডাক করেও মাঠে নামেনি বিএনপি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে বিএনপি হাঁকডাক দিলেও ভোটের দিন ওই দলের নেতাকর্মীদের সেভাবে কেন্দ্রে যেতে দেখা যায়নি। এমনকি অনেক কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টও যাননি। তবে নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে ভোট কেন্দ্র ও আশপাশের এলাকায় সরব না থেকে নীরব থাকা বিএনপির কৌশল ছিল। আর এ কৌশলের অংশ হিসেবে ভোটের পর দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। ভোট শেষ হওয়ার পর বিকেলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনের নামে তামাশা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। এদিকে ভোট শেষে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় তা প্রমাণ হয়েছে। আর দক্ষিণ সিটির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠানো এক অভিযোগপত্রে বলেছেন, ভোটের আগের রাতেই বিএনপির এজেন্ট ও ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। সরেজমিনে বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করে দেখা গেছে, অধিকাংশ কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টই ছিল না। এমনকি ভোট কেন্দ্রের বাইরে দলের পক্ষে কাজ করার জন্যও বিএনপির তেমন লোকজন দেখা যায়নি। কোন কোন ভোট কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পাওয়া লোকজন অর্থের বিনিময়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করে সকালেই কেন্দ্র থেকে বের হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। আবার কোন কোন কেন্দ্রে বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর লোকেরা নৌকার ব্যাজ গলায় ঝুলিয়ে গোপনে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করেছে। এদিকে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিএনপি যে কৌশল গ্রহণ করে তাও সফল হয়নি বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। সরেজমিনে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করে দেখা গেছে দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া অধিকাংশ কেন্দ্রেই নবীন-প্রবীণ ভোটররা নির্বিঘেœ ভোট দিতে পেরেছে। কোন কোন কেন্দ্রে ইভিএম মেশিনে ত্রুটি দেখা দিলেও সেনাবাহিনীর সদস্যরা তা ঠিক করে দিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজে সাত বার ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়েও মেলাতে পারেননি। এতেই বোঝা যায় ইভিএমে ভোট ত্রুটিপূর্ণ। তিনি বলেন, যে সকল পোলিং এজেন্ট নানা বাধা উপেক্ষা করে ভোট কেন্দ্রে গেছেন তাদের দুপুর ১২টার মধ্যেই শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে বের করে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রের সামনে ২০০ থেকে ২৫০ জন বহিরাগত জড়ো করে রাখা হয়। সমগ্র ঢাকা শহরে পাড়া-মহল্লায় সন্ত্রাসী কর্মকা- সৃষ্টি করে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে। ফলে ভোটাররা নিরাপত্তাহীনতার কারণে ভোট কেন্দ্রে যায়নি। ভ্রাম্যমান আদালতগুলোকে নির্বাচনী মাঠে দেখা যায়নি। ফখরুল বলেন, অনেক কেন্দ্রে ইভিএমে ধানের শীষের প্রতীক ছিল না। ফলে ভোটাররা ভোট প্রদান করতে পারেননি। অনেক কেন্দ্রে ভোটারদের আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে শনাক্তকরণের পর ভোট দিতে না দিয়েই কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। অনেক কেন্দ্রে ভোটারদের সঙ্গে ভোট কক্ষে প্রবেশ করে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে। কোন কোন কেন্দ্র থেকে সাংবাদিকদের বের করে দেয়া হয়েছে। ফখরুল বলেন, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তরের ধানের শীষের মেয়র প্রার্থী ও তাদের প্রধান নির্বাচনী এজেন্টরা শত শত অভিযোগ রিটার্নিং অফিসার ও নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রেরণ করলেও তা প্রতিকারে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশনের জারিকৃত ২৯ জানুয়ারির পরিপত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ওই পরিপত্রে বলা হয়েছে কোন ভোটারের আঙ্গুলের ছাপ যদি ইভিএম গ্রহণ না করে বা ম্যাচিং না হয় সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভোট কক্ষের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার নিজের আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করে ওই ভোট কক্ষের মোট ভোটের সর্বোচ্চ এক ভাগ ভোটারকে শনাক্ত করে নিজে দ্বায়ভার নিয়ে ভোট প্রদানের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। প্রতিটি ভোট কক্ষের এই এক ভাগ ভোটারের অতিরিক্ত বায়োমেট্রিক নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সরবারহকৃত একটি পিন নাম্বার ছাড়া সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার নিজের বায়োমেট্রিক দিয়ে আর খুলতে পারবেন না। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রের ভোট কক্ষসমূহের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারদের এই এক ভাগের অতিরিক্ত ভোটারের বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ সংক্রান্ত পিন নাম্বার দুপুরের পরে ভোট কেন্দ্রসমূহে দিয়ে দিয়েছেন। এর ফলে এখন সহকারী প্রিসাাইডিং অফিসারের আঙ্গুলের ছাপে ভোটার উপস্থিতি না হলেও সরকারের চাহিদা মোতাবেক ওই কেন্দ্রের মোট ভোটের যত সংখ্যক প্রয়োজন তত সংখ্যক ভোটের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট জালিয়াতির পথ ক্ষমতাসীন দলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আমরা যেটা আশঙ্কা করেছি সেটাই হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, দলের ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবিব-উন নবী খান সোহেল প্রমুখ। সকাল ৮টায় গুলশান মানারত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভোট দেয়ার পর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে বলেন, অনেক কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্ট প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের কী উদ্দেশ্য তা আমরা আগে থেকেই জানতাম। তবে আমরা দেখতে চাই নির্বাচন কমিশনের কোন মনোভাব বদলায় কিনা। আমরা হাল ছাড়ছি না, মনোবল ভাঙছি না। আমাদের মনোবল এখনও শক্ত আছে। তাবিথ আউয়াল বলেন, আমরা বুঝতে পেরেছি আমাদের বিপক্ষ দল ভয় পেয়েছে, যে কারণে তারা ভয়ভীতি, হামলা ও পোলিং এজেন্টদের বাধা দেয়ার পদক্ষেপ সকাল থেকেই নিয়েছে। তবে আমাদের শক্তি জনগণ। এই জনগণের শক্তি নিয়ে আমরা নির্বাচন মোকাবেলা করছি। নির্বাচন কমিশনকে ইতোমধ্যেই অভিযোগ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও অভিযোগ করা হয়েছে। তাবিথ বলেন, প্রতিটি এলাকায় নির্বাচন কমিশন নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেট থাকার কথা। কিন্তু আমি মানারত স্কুল কেন্দ্রে কোন ম্যাজিস্ট্রেট খুঁজে পাইনি। ভেতরে একটি ইভিএম মেশিন ব্রেকডাউন হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই। তবে সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত। সকাল ৯টায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন ভোট দেন গোপীবাগের শহীদ শাহজাহান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এ সময় তিনি সরকার বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র দখল করেছেন বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ৩৪ নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন কেন্দ্রে শুক্রবার রাতেই সিসি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এ ছাড়া বিএনপির এক এজেন্টকে মারধর করা হয়। তবে ভোট কেন্দ্র পাহারায় রাখতে পারলে আমাদের বিজয় নিশ্চিত। বেলা ২টা ৭ মিনিটে মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ কেন্দ্র পরিদর্শনকালে দেখা যায় বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী সোহেল রানা ও জাতীয় পার্টি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী শফিকুল ইসলাম সেন্টুর সমর্থিত কিছু কর্মী আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ডেইজি সরোয়ারের ব্যাজ গলায় ঝুলিয়ে ভোটারদের কাছে চুপে চুপে নিজ নিজ প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাচ্ছে। এ বিষয়টি আঁচ করতে পেরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা তাদের চ্যালেঞ্জ করে বসলে উভয় পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে কেন্দ্রে থাকা পুলিশ ও ভ্রাম্যমাণ পুলিশ সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভোটার জানান, এভাবে অন্যান্য কেন্দ্রেও বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের কর্মীরা কৌশলে আওয়ামী লীগের পরিচয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করে নিজ দলের পক্ষে কাজ করেছে। বিকেল ৩টা ১২ মিনিটে মগবাজার নয়াটোলার শাহনূরী মডেল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হোসেন আহমেদ জানান, এই কেন্দ্রে বিএনপির কোন এজেন্ট নেই। তবে না থাকার কারণ হচ্ছে- আগের রাতেই প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিএনপির পোলিং এজেন্টরা কেটে পড়ে। আর ভোটের দিন বিএনপি নেতাকর্মীরাও প্রকাশ্যে ভোট কেন্দ্র ও আশপাশের এলাকায় এসে ভিড় করার চেষ্টা করেনি। এর আগে বেলা সোয়া ১১টায় মহাখালী তিতুমীর কলেজ কেন্দ্রে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভোটর বলেন, বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও বিএনপির লোক কেন্দ্র এবং আশপাশের এলাকায় আছে। আর ঝামেলা এড়াতে বিএনপির পোলিং এজেন্টরা সকালে আসলেও পরে চলে যায়। তবে ইভিএমে ভোট হওয়ায় কেন্দ্রের ভেতর তেমন কোন অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে না। তাই বিএনপির পোলিং এজেন্ট না থাকলেও কোন সমস্যা নেই। এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে ৫৪ ওয়ার্ডের মধ্যে ৪৩টিতে বিএনপির পোলিং এজেন্ট বের করে দেয়ার অভিযোগ করেছে। এ ছাড়া কোন কোন কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টকে মারধর করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। তাবিথ আওয়াল আরও অভিযোগ করেন, ভোট শুরুর আগের রাতেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঢাকা উত্তর সিটিতে এজেন্টদের কেন্দ্র না যাওয়া হুমকি দেয়া হয়। অনেক ভোটারদেরও হুমকি দেয়া হয় ভোট কেন্দ্র না যাওয়ার জন্য। রাতভরই এ ধরনের অভিযোগ আসে আমাদের নির্বাচনী কার্যালয়ে। এরপরও বিএনপির ভোটার ও এজেন্ট তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচনের দিন সকাল সকাল ভোট কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভোট শুরুর আগেই ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা বিএনপির এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। কোন কোন কেন্দ্রে স্বয়ং প্রিসাইডিং অফিসার নিজেই বিএনপির এজেন্টকে বের করে দেয়ার জন্য সহায়তা করে। তাবিথের অভিযোগে আরও বলা হয়, ভোট কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেয়ার খবর পেয়ে সেখানে বসিয়ে গিয়ে তাদের বসিয়ে দিয়ে চলে অসার পর আবারও বের করে দেয়া হয়। কোন কোন কেন্দ্রে ভোটারদের আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে ভোট দেয়া হয়ে গেছে বলে বিদায় করে দেয়া হয়। পরে ওই ভোটারের ভোট তাদের পছন্দ মতো প্রার্থীকে দিয়ে দেয় আওয়ামী লীগের লোকজন। কোন কোন কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে বিএনপির ভোটাররা ইভিএমে ধানের শীষ প্রতীক খুঁজে পাননি। ভোট কেন্দ্রে প্রবেশের সময় বিএনপির অনেক ভোটারকে বাধা দেয়া হয়েছে। বিএনপির ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র প্রার্থীর প্রধান এজেন্ট মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের গাড়িতে হাতবোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। বিভিন্ন কেন্দ্রে বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে।
×