ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

বাগদাদ-হত্যাকা- ॥ পশ্চিমা মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা

প্রকাশিত: ০৯:২০, ৮ জানুয়ারি ২০২০

বাগদাদ-হত্যাকা- ॥ পশ্চিমা মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা

‘সব শিয়ালের এক রা’ কথাটা পশ্চিমা মিডিয়ার ভূমিকা সম্পর্কে যতটা খাটে, ততটা আর কিছু সম্পর্কে নয়। বাগদাদে ইরানী জেনারেল কাশেম সুলাইমানির হত্যাকাণ্ড নিয়ে পশ্চিমা রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের প্রচারণাতে এই কথাটার যথার্থতা লক্ষ্য করছি। দীর্ঘকাল পশ্চিমা দেশে বাস করছি। ফলে বুঝতে পেরেছি এদের মিডিয়া সত্য ও পক্ষপাতহীন খবর প্রচারের নামে যা প্রচার করে তা কখনো কখনো নির্জলা মিথ্যা বলে প্রমাণ হয়। তাদের লজ্জা নেই তাতে। কোরিয়া যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, মালয়ে (স্বাধীনতা লাভ করার আগে) মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যদের যুদ্ধ, এমন কি দুই দুইটি গালফ যুদ্ধে পশ্চিমা মিডিয়া দিনের পর দিন যে মিথ্যা প্রচার করেছে তার বিবরণ লিখতে গেলে একটি মহাভারত লিখতে হয়। গত তেসরা জানুয়ারি বাগদাদ এয়ারপোর্টে মার্কিন দস্যুবৃত্তির দ্বারা ইরানের জনপ্রিয় জেনারেলকে হত্যা সম্পর্কে পশ্চিমা বিগ মিডিয়ার মিথ্যাচার সকল সীমা অতিক্রম করেছে। আকস্মিকভাবে বাগদাদ এয়ারপোর্টে ড্রোন হামলা এবং কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা ট্রাম্পের দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ এবং এই কাজ একটি ভয়াবহ যুদ্ধ বাধাতে পারে এটা জেনেও যে তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থে এই অবৈধ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন তা পশ্চিমা বিশ্ব বিগ মিডিয়া স্বীকার করলেও হত্যাকা-টির বৈধতা প্রমাণের জন্য তারা উঠে পড়ে লেগেছে। প্রাচ্যের সরকারগুলোর দুর্ভাগ্য এই যে, তাদের হাতে এই মিথ্যাচারের জবাব দেয়ার জন্য কোন শক্তিশালী প্রচারযন্ত্র নেই। রয়টার্স, এপিএ প্রভৃতি সংবাদসংস্থা এবং টাইমস, নিউইয়র্ক টাইমস, টেলিগ্রাফ, ওয়াশিংটন পোস্টের মতো বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র প্রাচ্যের দেশগুলোর কর্তৃত্বে নেই। ফলে পশ্চিমা প্রোপাগান্ডাই বিশ্বের সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ইন্দিরা গান্ধী। তিনি রয়টারের অনুরূপ একটি শক্তিশালী সংবাদ সরবরাহকারী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা বিশ্বের খবরাখবরের সঙ্গে প্রাচ্যের দেশগুলোর সঠিক খবর প্রচার করবে। ইন্দিরা গান্ধী বুঝতে পেরেছিলেন, আধুনিক প্রযুক্তিযুক্ত সর্বপ্রচার মিডিয়াই এখন পশ্চিমা আধিপত্যবাদী দেশের সরকারের কবলে। এর বিরুদ্ধে প্রাচ্যের হাতেও শক্তিশালী প্রচারযন্ত্র থাকা দরকার। এই পরিকল্পনা কার্যকর করার আগেই ইন্দিরা আততায়ীর হাতে নিহত হন। জেনারেল কাশেম সোলাইমানি ছিলেন ইরানের সামরিক বাহিনীর একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। তাকে হত্যার অর্থ সন্ত্রাসী হত্যা নয়, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। এটা জেনেও ট্রাম্প ব্যক্তিগত স্বার্থে মানবতাবিরোধী এই হত্যাকা- ঘটিয়েছেন। তিনি ভাবছেন, আমেরিকানদের নিরাপত্তা এবং বিশ্ব শান্তি গোল্লায় যাক, এই হত্যাকা- দ্বারা আমেরিকার হোয়াইট ভোটারদের কাছে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করে তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত ইমপিচমেন্ট থেকে বাঁচবেন এবং চলতি বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সহজেই জিতবেন। পশ্চিমা বিগ মিডিয়াতেও এসব কথা স্বীকার করা হয়েছে। তবু ট্রাম্পের এই হত্যাকা-কে বৈধ ও প্রয়োজনীয় বলে প্রমাণের জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে। কারণ, ট্রাম্প যত বড় দুষ্কৃতকারী হোন তাকে রক্ষা করে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম ও ইমপেরিয়ালিজমের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। ট্রাম্প যখন প্রথম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন অধিকাংশ পশ্চিমা মিডিয়ায় বলা হয়েছিল এই নীতিহীন, চরিত্রহীন ব্যক্তিটি বিশ্ব শান্তির জন্য ভয়ানক বিপদ। এখন সেই ট্রাম্পের কাজের তারা গুণগান গাইছেন। কারণ, ধনবাদী ও সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থের তল্পি বহন করতে হবে এই ক্রীতদাস মিডিয়ার। পশ্চিমা মিডিয়ার যুক্তি হলো ট্রাম্প খারাপ লোক, কিন্তু তিনি একটি ভাল কাজ করেছেন। ভাল কাজটি হলো সোলাইমানির মতো ‘ভয়ানক সন্ত্রাসীকে’ তিনি হত্যা করেছেন। ‘সানডে টাইমস’ তো গত ৫ জানুয়ারি সকলকে টেক্কা মেরে লিখেছে, ‘ডড়ৎষফ রং ংধভব রিঃযড়ঁঃ ঝড়ষধরসধহর’ (সোলাইমানিকে ছাড়া বিশ্ব নিরাপদ)। কথাটার মর্মার্থ সোলাইমানি গোটা পৃথিবীর জন্য এমনই বিপজ্জনক ব্যক্তি ছিলেন যে, তাকে হত্যা করে পুণ্যের কাজ করা হয়েছে। ঠিক একই কথা বলেছিলেন অন্যায় ও অবৈধ যুদ্ধে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে হত্যার পর ব্রিটেনের ধিকৃত ও নিন্দিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। তিনি বলেছিলেন, ‘সাদ্দামকে ছাড়া পৃথিবী নিরাপদ হলো।’ বাস্তব পরিস্থিতি ছিল টনি ব্লেয়ার ও জর্জ বুশকে ছাড়া পৃথিবী নিরাপদ হতো। পশ্চিমা মিডিয়ার মিথ্যাচারিতা বারবার প্রমাণ হয়েছে। তবু তারা লজ্জা পায়নি। মিথ্যা প্রচার বন্ধ করেনি। ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যে অন্যায় ও অবৈধ ছিল এবং সাদ্দামের হাতে মারণাস্ত্র থাকা সম্পর্কে টনি ব্লেয়ার যে মিথ্যা কথা বলেছেন তা পরে অকাট্যভাবে প্রমাণ হয়েছে। এই অন্যায় যুদ্ধে ইরাকে আমেরিকা ও ব্রিটেন মিলে যে গণহত্যা চালিয়েছে সেজন্য টনি ব্লেয়ার বা জর্জ বুশকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করে বিশ্ব আদালতে বিচার হওয়া উচিত ছিল। এই বিচার মিলোচিভসের হয়েছে বসনিয়ায় গণহত্যার জন্য। কিন্তু ইরাকে গণহত্যার জন্য টনি ব্লেয়ার ও বুশের কোন বিচার বা দ- হয়নি। পশ্চিমা বিগ মিডিয়া এ সম্পর্কে নীরব। এশিয়া-আফ্রিকায় যখনই কোন দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তখনই পশ্চিমা মিডিয়া তাকে সন্ত্রাসী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের সন্ত্রাসী বলে প্রচার করেছে। ধনতান্ত্রিক ও সা¤্রাজ্যবাদী পশ্চিমা দেশের স্বার্থ এবং আধিপত্যের বিরুদ্ধে কোন জননেতা মাথা তুললেই তাকে সন্ত্রাসী নেতা বলে মিথ্যা প্রচার করা হয়েছে। কেনিয়ার স্বাধীনতার আন্দোলন পরিচালনা করেছিল মাউ মাউ দল এবং তাদের নেতা ছিলেন জোমো কেনিয়াত্তা। ব্রিটিশ বিগ মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছিল মাউ মাউরা হচ্ছে নরমাংস ভক্ষণকারী একটি দল এবং কেনিয়াত্তা তাদের নেতা। কেনিয়া স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্ববাসী জানতে পারল, মাউ মাউরা একটি শিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল দল এবং জোমো কেনিয়াত্তা ব্রিটেনে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছেন। তার স্ত্রীও একজন ইংরেজ মহিলা। জোমো কেনিয়াত্তা আফ্রিকার গ্রেট নেতা হিসেবে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অনুরূপভাবে জিম্বাবুইয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা রবার্ট মুগাবেকেও বিশ্ব শান্তির জন্য বিপজ্জনক সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়া হয়েছিল। নেলসন ম্যান্ডেলাকে তো সন্ত্রাসী হিসেবে ২৭ বছর জেলে কাটাতে হয়েছে। এখন একজন মহামানব হিসেবে তিনি বিশ্বময় স্বীকৃত এবং লন্ডনের রাস্তাতেই তার স্ট্যাচু প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কাশেম সোলাইমানি যদি কোন গোপন সন্ত্রাসী দলের নেতা হতেন, যেমন ছিলেন ওসামা বিন লাদেন, তবুও না হয় তাকে হত্যা করা নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার প্রচার মেনে নেয়া যেত। কিন্তু সোলাইমানি কোন গোপন সন্ত্রাসী দলের নেতা ছিলেন না, ছিলেন ইরানের সামরিক বাহিনীর একজন প্রধান কর্মকর্তা। যুদ্ধরত অবস্থায় রণক্ষেত্রে তিনি মার্কিন বোমা হামলায় মারা যাননি। তাকে বাগদাদে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। এটা অবৈধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ কথা জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তাও স্বীকার করেছেন। পশ্চিমা বিগ মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন দূতাবাস ও কূটনীতিকদের ওপর হামলার পরিকল্পনার পেছনে ছিলেন সোলাইমানি। সাদ্দামের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র রাখার মতো এ অভিযোগও যে মিথ্যা নয় তার প্রমাণ কি? তাছাড়া ইরাকে এখনও মার্কিন ও ব্রিটিশ সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। ইরাকিদের ওপর এই সৈন্যদের জঘন্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাগদাদে গণবিক্ষোভ চলছে। মার্কিন দূতাবাসে হামলা হয়েছে। মার্কিন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জনগণের বিরোধিতায় ইরানী জেনারেলের সহানুভূতি ও সমর্থন থাকতে পারে। ইরানের স্বার্থ রক্ষায় এই জেনারেলকে সাফল্য লাভ করতেও দেখা গেছে। তার তৎপরতার ফলেই মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে ইরাকে মার্কিন আধিপত্য আজ টলটলায়মান। এটাই ব্রিটেন ও মার্কিন সরকারের টনক নড়িয়েছে। ইরাক অন্যায় যুদ্ধে দখল করে তারা সেখানে যথেচ্ছ অত্যাচার চালাবে, আর তা প্রতিরোধ করতে গেলেই তা কি সন্ত্রাস হবে? চমৎকার যুক্তি। মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন সফলভাবে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্যই সোলাইমানির ওপর পশ্চিমা শক্তিগুলোর এত রাগ। সেই রাগেরই বহির্প্রকাশ ঘটেছে পশ্চিমা বিগ মিডিয়ার মিথ্যা প্রচারে। ইরানের শুধু একজন কুশলী সেনাপতি হিসেবে নন, মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ ও তার অনুচর ইসরাইলের আগ্রাসন প্রতিরোধে সোলাইমানি ছিলেন একজন সফল যোদ্ধা। ট্রাম্প তার চরিত্র অনুযায়ী কাপুরুষোচিতভাবে গোপন হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করেছেন। তাতে জীবিত সোলাইমানির চাইতে মৃত সোলায়মানি এখন অনেক শক্তিশালী। তার প্রমাণ পাওয়া গেছে তার জানাজায় লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে। জনতা তার জন্য ক্রন্দন করেছে, আমেরিকার দস্যুবৃত্তির বিরুদ্ধে আরও ঐক্যবদ্ধ ও সংগ্রামের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। সমাবেশের ধ্বনি ছিল ‘ডেথ টু আমেরিকা।’ সমাবেশে সোলাইমানিকন্যা অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে বলেছেন, ‘এই হত্যাকা-ের ফলে আমেরিকার জন্য এক অন্ধকার দিন ঘনিয়ে আসবে।’ পশ্চিমা রাজনীতিকদের অনেকে এটা বিশ্বাস করেন না। তাদের কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলেছেন, যত গর্জায় তত বর্ষায় না। ইরান শুধু গর্জাচ্ছে। কিছু করার ক্ষমতা তার নেই। এই ভ্রান্তি তাদের শীঘ্রই ভাঙবে। ইরান লক্ষ্যবস্তু ঠিক করছে। সময় ও সুযোগমতো তাতে এমন কুশলী আঘাত হানবে যে, তাতে ট্রাম্পের দর্প চূর্ণ হবে। কিন্তু যুদ্ধ বাধাতে পারবে না। ইরানের অতীতের কৌশল দেখেও তার বর্তমান স্ট্র্যাটেজি অনুমান করা যায়। দেশে দেশে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের সিআইএ’র মাধ্যমে গোপন হত্যার জন্য আমেরিকা নিন্দিত। সোলাইমানি-হত্যা তার একটি। আমেরিকার সখা ইসরাইল এভাবে প্যালেস্টাইনি নেতা আরাফাতকে গোপনে হত্যা করেছিল। প্রেসিডেন্ট নাসেরের মৃত্যু নিয়ে গুজব আছে। আলেন্দে ও মুজিব হত্যার পেছনে ছিল সিআইএ। এসব হত্যাকা-ে আমেরিকার ভূমিকা চাপা দিতে পশ্চিমা বিগ মিডিয়া বহু চেষ্টা করেও সফল হয়নি। এই নেতাদের বিরুদ্ধেও তারা একটা না একটা দোষ চাপিয়েছিল। সোলাইমানির বিরুদ্ধেও তারা সন্ত্রাসের অভিযোগ আনবে তাতে বিস্ময়ের কি আছে? কিন্তু সোলাইমানিকে হত্যার জন্য এবার আমেরিকা ও ট্রাম্প রেহাই পাবেন না। অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা মধ্যপ্রাচ্যেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কবর তৈরি হচ্ছে। লন্ডন, ৭ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০২০
×