ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাপান শিল্পাঞ্চলে আগ্রহী ॥ বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব করতে চায় টোকিও

প্রকাশিত: ১১:০৮, ৭ জানুয়ারি ২০২০

জাপান শিল্পাঞ্চলে আগ্রহী ॥ বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব করতে চায় টোকিও

এম শাহজাহান ॥ বন্ধু রাষ্ট্র জাপান বঙ্গোপসাগর কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব’ করতে চায়। এই আগ্রহ সামনে রেখে জাপানের বিনিয়োগ আনতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করা হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ জাপান সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাপান সরকারের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রীর এই সফর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাপানের কূটনৈতিক সহযোগিতা চাইবে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার জাপান সফরের জন্য হালনাগাদ ব্রিফ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শীঘ্রই জাপান সফর করবেন। ওই সফর উপলক্ষে বাংলাদেশ-জাপান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর হালনাগাদ তথ্য প্রয়োজন। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অফিস ও সংস্থার জাপানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইনপুট, তথ্য ও মতামত লিখিত আকারে দিতে হবে। এর আগে গত বছরের ১৫ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারদিনের এক সরকারী সফরে জাপান গিয়েছিলেন। বঙ্গোপসাগর ঘিরে পুরো বাংলাদেশকে জাপানী বিনিয়োগের আওতায় আনতে ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। দেশী বিনিয়োগকারীরা জাপানের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগেও আগ্রহী। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাইকার প্রধান প্রতিনিধিও মনে করেন, জাপানী বিনিয়োগকারীদের জন্য আলাদা জোন করার ফলে অধিকতর বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যাবে। বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক শিল্প প্রবৃদ্ধির যে বলয় (বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট) গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয়েছে এসইজেডের (বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার) মধ্য দিয়ে। এবার প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের মধ্যদিয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে জাপানের সহায়তা বাড়ানোর ওপর জোর দেবেন তিনি। এছাড়া সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা, রোহিঙ্গা সঙ্কট বা তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার জন্য জাপানকে অনুরোধ জানাবে বাংলাদেশ। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজে আবের সঙ্গে বৈঠকে এসব বিষয় আলোচনা করা হবে। এছাড়া দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ মানবসম্পদ নেবে জাপান। বর্তমানে ১০/১২ হাজার বাংলাদেশী জাপানে কর্মরত রয়েছেন। নতুন করে জনশক্তি রফতানির চুক্তি করা গেলে জাপানে আরও বাংলাদেশীরা চাকরির সুযোগ পাবেন। এতে বিপুল অঙ্কের রেমিটেন্স আসবে। শুধু তাই নয়, জাপানে এদেশের তৈরি পোশাকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব. ড. মোঃ জাফর উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের এজেন্ডা তৈরির বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তৈরি করছে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রফতানি ও আমদানি বাণিজ্যের কিছু হালনাগাদ তথ্য দিচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়, কর্তৃপক্ষ ও অধিদফতর থেকেও এ বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, জাপান বাংলাদেশের বড় বাণিজ্য অংশীদার। দেশের অবকাঠামো খাতে জাপানের অবদান সবচেয়ে বেশি। তাই প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের বিষয়টিও আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত, গত বছরের মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময় পাঁচটি উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য জাপানের সঙ্গে ২৫০ কোটি ডলারের একটি উন্নয়ন সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৪০তম সরকারী উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) প্যাকেজ চুক্তির অধীনে এ অর্থ মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) উন্নয়ন প্রকল্প (লাইন-১), বিদেশী বিনিয়োগ সহায়ক প্রকল্প (২), জ্বালানি দক্ষতা ও সুরক্ষা সহায়ক প্রকল্প (পর্যায়-২) ও মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুত কেন্দ্র প্রকল্প (৫)-এ ব্যয় করা হচ্ছে। এছাড়া গত বছরও বাংলাদেশ জাপানের কাছ থেকে ওডিএ হিসেবে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে জাপানী ওডিএ এসেছে ১১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বে জাপান থেকে সবচেয়ে বেশি ওডিএ পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে। জাপান বাংলাদেশের রফতানি বাজারের বড় দশটির মধ্যে একটি। বাংলাদেশের রফতানির চেয়ে আমদানির পরিমাণ এখনও বেশি, যদিও প্রতিবছর রফতানির পরিমাণ আমদানির অনুপাতে আগের চেয়ে বাড়ছে। এ ছাড়া দুই শ’ ষাটটির বেশি জাপানী কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা চালাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে হচ্ছে জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চল ঢাকার অদূর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় ১ হাজার একর জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে জাপান অর্থনৈতিক অঞ্চল। এর ফলে দেশে জাপানী বিনিয়োগ বাড়বে। জাপানী উদ্যোক্তরা এদেশে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। এরই মধ্যে ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। অবশিষ্ট ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সম্প্রতি বেজা কার্যালয়ে ‘জাপান ইকোনমিক জোন’র জন্য অধিগ্রহণ করা ৫০০ একর জমির কাগজপত্র বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরীর কাছে হস্তান্তর করবে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ। এদিকে, জাপান ইকোনমিক জোন’র ভূমি উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পেয়েছে জাপানের সুমিতমো কর্পোরেশন। বাংলাদেশ সরকার, জাপান ও বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আইএফসি এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের অংশীদার হবে। এ প্রসঙ্গে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে জাপানের সুমিতমো কর্পোরেশন এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভূমি উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে যুক্ত হয়েছে। অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার জাপান। জাপান প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর জাপানে মাত্র ৭৫০ মিলিয়ন মূল্যমানের পণ্য রফতানি করা হয়। দু’দেশের মোট বাণিজ্য মাত্র ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্যিক ভারসাম্য জাপানের অনুকূলে রয়েছে। তবে বাংলাদেশে জাপানী বিনিয়োগ ও জাপানী শিল্প-কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে এই অসমতা দূর করা সম্ভব। জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড এ্যাসোসিয়েশন (জেট্রো) জাপানের জন্য বাংলাদেশকে এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহৎ লাভজনক ব্যবসায়িক স্থান মনে করে। এ কারণে শতকরা ৮৭ ভাগ জাপানী ব্যবসায়ী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
×