ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপদ হলো না সড়ক

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ৭ জানুয়ারি ২০২০

নিরাপদ হলো না সড়ক

সড়ক নিরাপদ করতে আইন হয়েছে। ভেবেছিলাম সড়ক এবার হয়ত নিরাপদ হবে। সড়ক নিরাপদ হয়নি। আরও অনিরাপদ হয়েছে। অবৈধ ড্রাইভাররা প্রশ্রয় পেয়ে আরও দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে। ওরা প্রতিদিন অকাতরে মানুষ মারছে। এদেশে কতশত সাইফুজ্জামানের মৃত্যু হচ্ছে। প্রতিদিন সড়কে মূল্যবান প্রাণ যাচ্ছে। কারও হাত যাচ্ছে, কারও পা যাচ্ছে, মাথা যাচ্ছে, মিশুক-মনির, সাইফুর রহমানদের জীবন যাচ্ছে। থামছে না সড়কে মৃত্যুর মিছিল। আমরা বিশেষ দুই-একজনের জন্য আহ্ উহ্ করি। প্রতিদিন কত খালিদ, কত হৃদয় পঙ্গু হচ্ছে, জীবন দিচ্ছে তার খোঁজ কি রাখি? আমরা কেন মৃত্যুর মিছিল রোধ করছি না? কেবল আলোচিত ঘটনায় মন্ত্রী, এমপিরা ছুটে যান স্বজন কিংবা লাশের পাশে। আমরা মায়াকান্না করি। লাভ কি তাতে? সম্প্রতি উচ্চ আদালত ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে না চালাতে নির্দেশ দিয়েছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি এখনও সড়কে চলছে। তবে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চললে সড়কে গাড়ির সংখ্যা কমে যায়। এতে জনগণের ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। আবার উচ্চ আদালত ফিটনেসবিহীন গাড়িতে জ্বালানি সরবরাহ না করতে নির্দেশ দিয়েছে। জ্বালানি পাম্পগুলোতে সাইনবোর্ডও লাগিয়ে দেয়া হয়েছে ‘ফিটনেস ছাড়া জ্বালানি সরবরাহ করা হয় না’। সে নির্দেশ এখন অকার্যকর। এবার নয়া ‘সড়ক আইন ২০১৯’ মনে আশা জাগায় বড়; তবে মনে জোর পাই না। আমাদের কত কিছুর জন্যই তো আইন আছে। প্রয়োগ হয় কয়টা? এদেশে কঠোর খাদ্য আইন আছে, তবুও প্রায় সব খাবারেই তো বিষ মিশানো থাকে। নারীর প্রতি সহিংসতার আইন আছে, তবুও এদেশের নারীরা কতটা নিরাপদ? অনিরাপদ হয়ে, ধর্ষিত হয়ে, খুন হয়ে যাবার পর নুসরাতের মতো কয়টা ঘটনার বিচার হয় এদেশে? সড়ক আইন ছিল আগেও, এখনও আছে, প্রয়োগ হয় কি?। নয়া আইনের প্রয়োগ নিয়েও মনে প্রশ্ন উঁকি-ঝুঁকি মারে। তবুও আশা করতে দোষ কোথায়? আশার বাসা বেঁধে নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন দেখতে দোষ কি তাতে? একেবারে আশা ছেড়ে দেয়া যাবে না। যা ভাবিনি তা তো হচ্ছে দেশে। সড়কে সড়কে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু সবই তো দেখছি। নতুন করে জানলাম শিশুরা নতুন বছর নতুন বইয়ের সঙ্গে টাকা পাবে। বয়স্ক মানুষ, দরিদ্র মানুষ ভাতা পাচ্ছে। একদিন আমরা দেশের সকল নাগরিক হয়ত ভাতার আওতায় আসব। ফ্রি চিকিৎসা পাব। এমন স্বপ্ন এখন দেখতে পারি। ভাবি সবকিছুই তো হচ্ছে। কিন্তু সড়ক কি আদৌ নিরাপদ হবে কখনও? মনে বড় সংশয়। সড়ক ঠিকই নিরাপদ হবে। কিছু ঘটনায় দেখেছি প্রধানমন্ত্রী নাড়া দিলে সব নড়েচড়ে ওঠে। তিনি দৃষ্টি দিলে সব সহজে হয়ে যায়। এবারও তিনি সড়ক নিরাপদ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আন্দোলনের ভয়ে হয়ত সেই নির্দেশনা অকার্যকর হয়ে আছে। মনে প্রশ্ন জাগে, আদৌ কি সড়ক আমাদের জন্য নিরাপদ হবে? থামবে কি সড়কে মৃত্যুর মিছিল? সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে তো মরছেই। রোধ হচ্ছে না। এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। সড়কে আইন মানছে না কেউ। আসলে সড়কে আইন মানতে বাধ্য করা হয় না। তাহলে কিভাবে সড়ক নৈরাজ্য থামবে? এ নিয়ে সরকার সংশ্লিষ্টদের ভাবনা কম। যারা সড়কে আইন মানানোর কাজ করেন তারাই আইন মানেন না। আমরা কি অন্ধ? আমরা কি কালা (কানে কম শুনি)? প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে। প্রতিদিন সংবাদপত্রগুলো ফলাও করে সংবাদ ছাপছে। জাতীয় প্রথম শ্রেণীর একটি পত্রিকা গত দেড় বছর ধরেই প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিশেষ সংবাদ ছাপছে। সবাই দেখে, সবাই দুর্ঘটনা নিয়ে ভাবে; কিন্তু যাদের এ নিয়ে ভাবনা থাকার কথা তারাই ভাবলেশহীন। তারা দেখেনও না, বললে শোনেনও না। সড়ক দুর্ঘটনা কি অলঙ্ঘনীয় ব্যাপার? এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা হলো মৃত্যুদূত ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মতো। ঘর থেকে বের হয়ে আবার প্রাণ নিয়ে ঘরে ফেরা যাবে কি? এমন সংশয় বরাবরই থেকে যায়। এ প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব পাওয়াও কঠিন বাংলাদেশে। তাই প্রতিদিন গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি সড়ক দুর্ঘটনার অসংখ্য বীভৎস ছবি, শুনতে পাই স্বজন হারানোর আহাজারি। আমাদের সড়ক যেন এখন মরণফাঁদ। এমন কোনদিন নেই, যেদিন অকালে প্রাণ ঝরছে না, প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বাতাস ভারি হয়ে উঠছে না। দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে তাতে নিরাপদ সড়ক বলে আর কিছু নেই। এ অবস্থায় আজকাল আর কেউ ঘর থেকে বের হলে পৈত্রিক প্রাণটা নিয়ে ফের ঘরে ফিরতে পারবেন কিনা সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। এমন কোনদিন নেই যেদিন সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে না। বিগত এরশাদ সরকারের আমলে সড়ক দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে সরকার দুর্ঘটনা সংঘটনকারী গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে পড়ে তা রহিত করতে বাধ্য হয় সরকার। এরপর থেকে বিভিন্ন সরকারকে পরিবহন শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার কাছে প্রায় জিম্মি থাকতে দেখা যাচ্ছে। এভাবে দুর্ঘটনা সংঘটনকারী চালকদের শাস্তি না হওয়া, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক কর্তৃক গাড়ি চালানো, আনফিট গাড়ি রাস্তায় চালানো, সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে ইদানীং সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত চালকদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসার ঘটনা এদেশে বিরল। দেখা গেছে প্রায় সব ক’টি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই চালকরা পার পেয়ে গেছে। কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে। এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক নয়, তা হচ্ছে মানবসৃষ্ট কারণে। এই হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতরা পরোক্ষভাবে হত্যারই শিকার। কিন্তু হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার কাক্সিক্ষত উদ্যোগ নেই। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। সরকারী হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে ৩৪ হাজার ৯১৮ জন। প্রতিবছর মারা যায় ৩ হাজার ৪৯১ জন। থানায় মামলা হয়েছে এমন দুর্ঘটনার হিসাব নিয়ে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে দায়িত্বশীলদের তরফ থেকে। বেসরকারী হিসাবে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে ২০ হাজার ৩৪ জন। প্রতিদিন গড়ে মারা যাচ্ছে প্রায় ৫৫ জন। সরকারী তথ্য ও বেসরকারীভাবে প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকার কারণ হলো দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ৬৭ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এ ঝামেলার কারণে অনেক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয়টি যথাযথভাবে রেকর্ডভুক্ত হয় না। পুলিশের দেয়া তথ্যানুযায়ী ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২ হাজার ১৪০ জন। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে ১ হাজার ১৮৬জন এবং সামান্য আহত হয়েছে ১৫৭ জন। অন্য একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭২ হাজার ৭৪৮টি। মারা গেছে ৫২ হাজার ৬৮৪ জন। আহত ও পঙ্গু হয়েছে আরও কয়েক হাজার মানুষ। ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এশিয়া, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়াসহ ১৫টি দেশের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি নেপালে বেশি, দ্বিতীয় বাংলাদেশে। সবচেয়ে কম হার যুক্তরাজ্যে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের দুর্ঘটনায় নেপালে মারা যায় ৬৩ জন এবং বাংলাদেশে ৬০ জন। যুক্তরাজ্যে এ হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির সাম্প্রতিক এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদহানি হয়। এই হার দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৯৫ শতাংশের সমান। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ বেশি। অন্য এক গবেষণা জরিপ থেকে জানা যায়, ৪৮ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যাত্রীবাহী বাস, ৩৭ শতাংশ দায়ী ট্রাক। দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি বিশেষ বাহিনী গঠন করা যায় তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এ জাতীয় বাহিনী গঠন করা হচ্ছে না কেন? জানমাল রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম মূল কারণ। সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ২. গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ব্যবহার, ৩. অতিরিক্ত যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন, ৪. ট্রাফিক আইন না মানা, ৫. সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা, ৬. চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা ও অসতর্কতা এবং ৭. অরক্ষিত রেললাইন। কথা হলো, যে কোন মৃত্যুই দুঃখজনক। মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয় তবে তা মেনে নেয়া আরও কঠিন। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকাল মৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না, এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবেলা করতে হচ্ছে, যা আমাদের কারও কাছেই কাম্য নয়। সংশ্লিষ্ট সবার প্রচেষ্টায় এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির নিরসন করতেই হবে। এভাবে চলতে পারে না। এভাবে মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে পারে না। পঙ্গুত্বের মতো দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে মানুষ জীবন কাটাতে পারে না। কারণগুলো যেহেতু চিহ্নিত সেহেতু সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দুরূহ হবে কেন? দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, ঘটবেও। কেন তা রোধ করা যাচ্ছে না? আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় দেশে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এসব রুখতে হবে। আমরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিবহন মালিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে সমন্বিত আন্তরিক, সচেতন, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করি। লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট [email protected]
×