ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গত নবেম্বর পর্যন্ত ৬৫ হাজারের বেশি নারী-পুরুষ কর্মী দেশে ফিরেছেন

চলতি বছরে ১০ লাখের বেশি কর্মীর বিদেশে চাকরির টার্গেট

প্রকাশিত: ১১:০৪, ৫ জানুয়ারি ২০২০

চলতি বছরে ১০ লাখের বেশি কর্মীর বিদেশে চাকরির টার্গেট

ফিরোজ মান্না ॥ শ্রমবাজার নিয়ে পুরো বছরটা ছিল টালমাটাল। বিভিন্ন দেশ থেকে নবেম্বর পর্যন্ত ৬৫ হাজারের বেশি নারী-পুরুষ কর্মী দেশে ফিরেছেন। নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন এক হাজার ৩৫৩ নারী কর্মী। বিদেশে গত বছরই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মীর মৃত্যু ঘটেছে। নবেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার মৃত কর্মীর লাশ দেশে এসেছে। এখনও কয়েক শ’ লাশ দেশে আনার অপেক্ষায়। তবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে ফেরত আসার বিষয়টি নিয়মিত ঘটনা। মালয়েশিয়ার মতো শ্রমবাজার বন্ধ থাকার পরও গত বছর ৭ লাখ ১১ হাজার কর্মী বিভিন্ন দেশে চাকরি নিয়ে গেছেন। এর আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৩৬ হাজার। ২০২০ সালে নতুন বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে ১০ লাখের বেশি কর্মীর চাকরির টার্গেট নেয়া হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, গত বছরে আমাদের টার্গেট ছিল মাত্র ৬ লাখ কর্মী পাঠানো। কিন্তু সেই জায়গায় ৭ লাখের বেশি কর্মীকে আমরা বিভিন্ন দেশে পাঠাতে সক্ষম হয়েছি। এবার আমরা ১০ লাখের বেশি কর্মী বিভিন্ন দেশে চাকরি দিয়ে পাঠাতে পারব। সে ক্ষেত্রে আমাদের অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনতেই হবে। সে জন্য কাজ করা হয়েছে। কোন জনশক্তি রফতানিকারক বেঁধে দেয়া টাকার চেয়ে বেশি টাকা নিতে পারবে না। দালাল গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে কঠোর হাতে। এই সেক্টরে অনেক বদনাম রয়েছে। বদনাম যাতে না থাকে সে জন্য মন্ত্রণালয়সহ জনশক্তি রফতানিকারকদের জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব সেলিম রেজা জনকণ্ঠকে বলেন, গত বছর শ্রমবাজারে নানা উত্থান পতন থাকলেও ৭ লাখ ১১ হাজারের বেশি কর্মী বিদেশে চাকরি নিয়ে গেছেন। আগের বছরের তুলনায় ২৫ হাজার কর্মী কম চাকরি পেয়েছেন। এটা হতো না যদি মালয়েশিয়ার বাজারটি খোলা থাকত। মালয়েশিয়ার বাজারে আরও প্রায় এক লাখ কর্মীর চাকরি হতো। বিদেশ থেকে যে সংখ্যক কর্মী দেশে ফিরেছেন-এটা সংখ্যায় খুব বেশি কিছু না। কারণ নানা কারণেই কর্মীদের দেশে ফিরতে হচ্ছে। কারও চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছে, আবার কোন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কারও দেশে ফিরতে হয়েছে। কেউ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তাছাড়া বিদেশ থেকে দেশে ফেরা এটা ‘রুটিন ওয়ার্ক’। আমরা ২০২০ সালে যাতে বেশি কর্মী বিদেশ যান তার জন্য বেশ কযেকটি নতুন বাজার সৃষ্টি করেছি। এরমধ্যে চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায়, রুমানিয়া, ম্যাকাউসহ কয়েকটি নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৭ সালে রেকর্ড সংখ্যক ১০ লাখ ৭ হাজার কর্মী বিদেশ গিয়েছিলেন। এ বছর ’১৭ সালকে অতিক্রম করার টার্গেট নিয়েছি। গত বছর জনশক্তি রফতানি কম হলেও রেমিটেন্স প্রবাহ বেশি হয়েছে। বাজারের পরিধি বাড়ার কারণে শ্রমবাজার ভাল হবে। জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান জনকণ্ঠকে জানান, বছর ধরেই শ্রমবাজারে চলেছে টালমাটাল অবস্থা। এরপরও জনশক্তি পাঠানোর হার কিন্তু খারাপ না। মালয়েশিয়ার বাজারের বাইরে ৭ লাখের বেশি জনশক্তি বিদেশে চাকরি নিয়ে গেছেন। এবার আমরা বায়রার পক্ষ থেকে আশা করছি, ১০ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে চাকরি নিয়ে যাবেন। কারণ কয়েকটি নতুন বাজার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে মন্ত্রণালয়। বিদেশ থেকে কর্মীরা তো একটা না একটা সময় দেশে ফিরবেনই। তিন বছরের মেয়াদ নিয়ে চাকরি করতে যান কর্মীরা। মালিকের ইচ্ছায় আরও কয়েক বছর চাকরি বাড়িয়ে কর্মীরা হয়তো ১০ বছর চাকরি করেন। এরপর তো তাকে দেশে ফিরতেই হবে। এটা নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। কারণ শ্রমবাজারের অস্থিরতার মধ্যেও ৭ লাখের ওপরে কর্মী বিদেশে চাকরি পেয়েছেন। সেখানে ৪০/৫০ হাজার কর্মী ফিরে আসা খুব বড় কিছু না। নারী কর্মীরা দেশে ফিরেছেন নানা কারণে। শুধু যে নির্যাতন তা কিন্তু নয়। তার দাবি, বিদেশে গিয়ে আবহাওয়া ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে অনেকে ফিরে আসছেন। আবার কেউ দেশে ফিরেছেন স্বামী সন্তানের টানে। এখানে ঢালাওভাবে অভিযোগ করলে চলবে না। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালে চাকরি নিয়ে বিদেশ গিয়েছিলেন ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫ নারী গৃহকর্মী। ২০১৮ সালে এসে সংখ্যাটি কমে হয় ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৫ জন। ২০১৯ সালে এক লাখের বেশি কর্মী বিদেশে গিয়েছেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে নানা ধরনের নেতিবাচক খবরের কারণে নারী কর্মীদের বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা কিছুটা কমেছে। বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে বিদেশে যাওয়া নারীদের প্রায় ৮০ শতাংশের গন্তব্য সৌদি আরব। সৌদি থেকে ফিরে আসা নারী কর্মীদের ওপর নানা নির্যাতনের কথা সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসায় এ বছর নারী কর্মী কিছুটা কমে গেছে। তবে কিছু যে নির্যাতনের ঘটনা নেই তা কিন্তু নয়। কিছু কর্মী নির্যাতনের কারণেও দেশে ফিরেছেন। ব্র্যাক মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, গত বছর বিদেশ থেকে ৬৫ হাজারের বেশি কর্মী দেশে ফিরেছেন। ৪ হাজারের বেশি কর্মীর মৃত দেহে এসেছে। বছরজুড়েই সৌদি আরব থেকে নির্যাতিত নারী কর্মীরা ফিরেছেন। এক হাজার ৩৫৩ নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন। তাদের প্রায় সবাই নির্যাতনের কারণে ফিরে আসার কথা বলেছেন। তবে অনেক নারী কর্মী বিমানবন্দরে নেমেই নিজ দায়িত্বে বাড়ি ফিরে গেছেন তাদের তথ্য ব্র্যাকের কাছে নেই। নিঃস্ব হয়ে দেশে ফেরা প্রবাসীদের সহায়তা দিতে কাজ করছে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগ। বাংলাদেশী অভিবাসী মহিলা শ্রমিক এ্যাসোসিয়েশনের (বমসা) সাধারণ সম্পাদক শেখ রুমানা জনকণ্ঠকে বলেন, সৌদি আরব থেকে নারীরা নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসায় মানুষ ভয় পাচ্ছেন। সবাই হয়তো নির্যাতিত হচ্ছেন না, ভাষাগত দক্ষতার অভাবেও অনেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে ফিরছেন। ফিরে আসার খবর ছড়িয়ে পড়ায় প্রশিক্ষণ নিয়েও অনেকে যেতে রাজি হচ্ছেন না। এ ধারা অব্যাহত থাকলে শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভবিষ্যতে যাতে কোন নারী কর্মী নির্যাতনের শিকার না হন সেদিকে কর্তৃপক্ষকে নজর রাখতে হবে। অভিবাসন খাতের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করেই নারী গৃহকর্মীদের সৌদি আরবে পাঠানো হচ্ছে। ভাষার সমস্যাও রয়েছে। ফিরে আসা নারীরা যৌন নির্যাতনসহ নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ভয়াবহ বিবরণ দিচ্ছেন। কাজের নিরাপদ পরিবেশের নিশ্চয়তা না থাকায় বিদেশ যেতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন অনেক নারী কর্মী।
×