ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিন দিনের পৌষ মেলা বাংলা একাডেমিতে

গ্রামীণ ঐতিহ্যের পিঠাপুলি, লোক সংস্কৃতির জয়গান

প্রকাশিত: ১১:০৪, ৫ জানুয়ারি ২০২০

গ্রামীণ ঐতিহ্যের পিঠাপুলি, লোক সংস্কৃতির জয়গান

মোরসালিন মিজান ॥ পৌষ মানেই পৌষ-পার্বণ। হালকা শীতের এই কালে দারুণ উৎসবে মাতে বাঙালী। গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতিতে এর বিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মাসের শেষভাগে ঘটা করে উদ্যাপন করা হয় পৌষ সংক্রান্তি। তারও আগে থেকে চলে পৌষ মেলা। এসব আয়োজনের প্রধান আকর্ষণ পিঠাপুলি। এক সময় গ্রামের ঘরে ঘরে পিঠা তৈরি হতো। এখন অনেক কমে গেছে। শহর তো আরও বিচ্ছিন্ন। এ অবস্থায় শহর ঢাকায় শুরু হলো তিন দিনব্যাপী পৌষ মেলা। শনিবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে পৌষ মেলা ১৪২৬ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, নাগরিক দায় থেকেই এ ধরনের আয়োজন। গ্রামীণ স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়া এবং নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি অধিকারবোধ জাগ্রত করার একটি চেষ্টা এখানে চোখে পড়ছে। অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে বিভিন্ন পরিবেশনার মাধ্যমে লোক সংস্কৃতির মহিমা প্রচার করা হচ্ছে। এর চারপাশে পিঠার স্টল। সবকটিতেই পিঠা। সুন্দর সাজিয়ে পরিবেশন করা হচ্ছে। গরম গরম খেতে চান? আছে সে ব্যবস্থাও। বেশকিছু স্টলের ভেতরে চুলা বসিয়ে চোখের সামনে পিঠা তৈরি করা হচ্ছে। দৃশ্যটি দেখার মতো। দেখতে দেখতে অনেকেই, নিশ্চিত করে বলা যায়, শৈশবে ফিরে যাবেন। মা খালারা একটি একটি করে পিঠা চুলা থেকে নামাচ্ছেন, অন্যদিকে চলছে গরম গরম মুখে পুড়ে দেয়ার প্রতিযোগিতা। এমন বিস্মৃতপ্রায় ছবিটা মনে পড়ে যাবে। আর আজকের প্রজন্মের যারা পিৎসা বার্গার খেয়ে বড় হয়েছে বা হচ্ছে তাদের নিজের কী আছে, তা জানার জন্য মেলায় যাওয়া চাই। পুরো প্রাঙ্গণে ৫০টির মতো স্টল। এসব স্টল ঘুরে কত রকমের পিঠা যে খুঁজে পাওয়া গেল! হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কার মধ্যে এত পিঠা রাজধানী শহরের মেলায় দেখে সত্যি আশাবাদী হতে হয়। মেলা ঘুরে খুঁজে পাওয়া গেল এমন এক তরুণীকে যিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেছেন। বড় হয়েছেন ঢাকায়। অথচ গ্রামীণ ঐতিহ্যের পিঠাপুলি তাকে খুব টানে। স্মার্ট দেখতে তরুণী নিজ হাতে হরেক রকমের পিঠা তৈরি করে মেলায় নিয়ে এসেছেন। নাম তমা। তার স্টলেই পাওয়া গেল প্রায় ১৮ জাতের পিঠা! ছানা পোড়া, মুগপাকোন, দুধচিতই, নকশি পিঠা, গোলাপফুল পিঠা ইত্যাদি সামনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একটি পিঠার নাম, জানা গেল, বধূবরণ। গ্রামের বিয়ে বাড়িতে পিঠাটি নাকি রাখতেই হয়। তমা বলছিলেন, আমার নানু এবং খালামনিরা পিঠা বানাতেন। দেখে আমারও খুব ইচ্ছে হয়। তাদের কাছ থেকেই পিঠা বানানো শিখি। বর্তমানে ৩০ জাতের পিঠা তৈরি করতে পারেন বলে জানান তিনি। তমার আন্টি শাহনাজও স্টলে ছিলেন। বললেন, আমি পিঠা খেতে ভালবাসি। একই কারণে বানাতেও পছন্দ করি। মেলার আরেকটি স্টলে পুরো একটি পরিবারকে খুঁজে পাওয়া গেল। নোয়াখালী থেকে আসা পরিবারের প্রায় সকলেই পিঠা তৈরি করেন অথবা তৈরিতে সহায়তা করেন। মূল মানুষটি জান্নাতুল ফেরদৌস পারভীন। এই মা স্টলে পিঠা তৈরির কাজ করছিলেন। কাজের ফাঁকে নিজের মেয়ে, ছেলে এবং মেয়ের স্বামীকে দেখিয়ে বললেন, সবাই আমার সঙ্গে আছে। গাজীপুরের একটি স্টলে পিঠা তৈরি করছিলেন লাকী। তার স্টলে পাওয়া গেল ইলিশ পিঠা। ঠিক ইলিশ মাছের মতো দেখতে। তিনি জানালেন, পিঠার ভেতরে ইলিশ মাছের কিমা দেয়া আছে। স্টলের আরেকটি পিঠা পানকলি। পানের মতো দেখতে। বেশ রসাল বলে মনে হলো। লাকী জানালেন, ক্যাটারিং কোর্স করেছেন তিনি। পাশেই আঁখি নামের আরেকটি মেয়ে। সেও ক্যাটারিং কোর্স করে পিঠা তৈরি করছে বলে জানা গেল। স্বাদ পিঠা ঘর নামের একটি স্টলে পাওয়া গেল রস চিতই। স্টলের দায়িত্বে থাকা হালিমা খানম এসেছেন গোপালগঞ্জ থেকে। তিনি জানান, তার নিজের এলাকায় খুব বিখ্যাত পিঠা রস চিতই। এখানে আরও পাওয়া গেল দুধপুলি। শেমাই পিঠা। গ্রাম বাংলা পিঠাপুলি নামের একটি স্টলে শেমাই পিঠার পরিবর্তে পাওয়া গেল শেমাই কাটলেট। পিঠার বাইরের অংশে শেমাই। ভেতরে মুরগির কিমা, আলু ও সবজি। তাজমহল পিঠাঘরে দৃষ্টি কাড়ল ঝিনুক পিঠা। এটিও ঝিনুকের মতো দেখতে। চালের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি। বরিশালের একটি স্টলে খুঁজে পাওয়া গেল তিলের পিঠা। হেল্লাল হোসেন নামের এক কিশোর পিঠাটি তৈরি করেন। সেই জানাল, বরিশালে তিলের পিঠার খুব কদর। ঢাকার কারিগর নুরু মিয়ার স্টলে ছিল ডিম পান্তুয়া। পিঠার পাশেই ধনিয়াপাতা ও শুঁটকি ভর্তা রাখা আছে। সেদিকে দেখিয়ে নুরু মিয়া বলেন, ভর্তাসহ খেতে হয় এটি। খুব স্বাদ। মেলার স্টল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রথমদিকে শখে পিঠা তৈরি করলেও, এখন তারা রীতিমতো ব্যবসায়ী। বাসায় তৈরি পিঠা বিক্রির নিজস্ব ব্যবস্থা আছে। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন মেলায় তারা অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পিঠা বাঁচিয়ে রাখছেন। আবার কিছু তারা নিজেদের মতো করে তৈরি করছেন। পিঠাপুলির পাশাপাশি মঞ্চে চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। লোক সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারার পরিবেশনা উপভোগ করতে করতে পিঠা খাওয়া। মেলা প্রসঙ্গে প্রধান আয়োজক গোলাম কুদ্দুছ বলেন, আজকের বাস্তবতা অনেক কঠিন। বিশ্বায়নের কালে নিজের বলতে যা কিছু সবই যেন সঙ্কটে। এ অবস্থা আমরা একটা দায়বোধ করি। সে দায় থেকেই পৌষ মেলার আয়োজন। পৌষ মেলা উদ্যাপন পর্ষদ আয়োজিত মেলা চলবে আগামীকাল সোমবার পর্যন্ত।
×