ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ হেলাল হোসেন

উপকূলীয় অঞ্চলে ঝরে পড়া রোধকল্পে করণীয়

প্রকাশিত: ০৯:০৩, ৫ জানুয়ারি ২০২০

উপকূলীয় অঞ্চলে ঝরে পড়া রোধকল্পে করণীয়

বিশ্বের সর্ববৃহৎ বদ্বীপ নদীমাতৃক বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের অবস্থান এবং সাগরের তীরে অবস্থিত এ দেশের ১৯টি জেলার শতাধিক উপজেলা উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা নদীবিধৌত খুলনা দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা এবং এ জেলার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলার আংশিক উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে বিবেচ্য। এসব অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানকার জনগণের জীবনযাত্রাও বৈচিত্র্যময় এবং সংগ্রামমুখর। তাদের কখনও যুদ্ধ করতে হয় প্রকৃতির সঙ্গে আবার কখনও যুদ্ধ করতে হয় অর্থনীতির সঙ্গে। তাই এ অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বেশি। যেহেতু উপকূলীয় অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নতি ও অগ্রগতির পিছনে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো শিক্ষা, আর প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার মূল ভিত্তি। তাই প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে এ অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ড্রপ আউট রোধকল্পে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০ (Sustainable Development Goals-2030)-এর অভীষ্ট-০৪ (এড়ধষ-০৪)-এ মানসম্মত ও টেকসই সর্বজনীন শিক্ষার পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে জোর দেয়া হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা বলতে একটি দেশের সকল প্রান্তের সকল স্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় আনা ও উপযুক্ত শিক্ষাদানকে বোঝায়। বাংলাদেশের সুবিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্মত শিক্ষার জন্য একদিকে যেমন শতভাগ শিশুর স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে, একই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা যেন কোন অবস্থাতেই ঝরে না পড়ে সে বিষয়েও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন এ অঞ্চলে ড্রপ আউটের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী Need Based Assessment-এর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ড্রপ আউটের কারণসমূহ : * অর্থনৈতিক সমস্যা ও পূর্ব পুরুষের দীর্ঘদিনের পেশা ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা গ্রহণের স্বাভাবিক আগ্রহকে অনেক সময় বিনষ্ট করে দিচ্ছে। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এখানকার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি, মাছ ধরা, কাঁকড়া ধরা ইত্যাদি। দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে এরা কালাতিপাত করেন। যখন একটি পরিবারকে তিন বেলা তিন মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা না দেয়া যায় তখন তারা বাচ্চাদের নিয়মিত স্কুলিং নিশ্চিত করতে পারেন না। আর বাচ্চারাও জীবিকা নির্বাহের তাগিদে বাবা-মার সঙ্গে কাজে বেরিয়ে পড়ে। ফলে ব্যাহত হয় শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ। * বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০১৮ অনুযায়ী শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি, মাছ ধরা বা কাঁকড়া ধরার মতো পেশায় কর্মজীবীদের সিজনাল ডিমান্ডের কারণে দরিদ্র পরিবারের বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের অধিক আয়-রোজগারের জন্য বিভিন্ন সিজনে কাজে পাঠিয়ে থাকে। আর একবার এসব শিশুর পড়াশোনার ধারাবাহিকতায় ব্যাঘাত ঘটলে অধিকাংশ তারা বা তাদের পরিবারও আর সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে আগ্রহী হয় না। * উপকূলীয় অঞ্চলগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ। দুর্যোগগুলোর মধ্যে আছে পুনরাবর্তক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙ্গনের মতো বিবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এসব দুর্যোগের ফলশ্রুতিতে অনেক পরিবারই ছিন্নমূল পরিবারে পরিণত হয়। এতে তারা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এর ফলে তাদের সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হয়। * সুপেয় পানির অপর্যাপ্ততা এ অঞ্চলের জনগণের অন্যতম দুর্ভোগের কারণ। তাদের বছরের ১২ মাস সংগ্রাম করতে হয় সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য। যখন একটি ৭-১০ বছর বয়সী বাচ্চার পড়ার টেবিলে থাকার কথা তখন তাকে কলস বা পানির পাত্র হাতে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় পার্শ্ববর্তী পাড়া বা মহল্লার পুকুর/ পাতকূপ থেকে পানি সংগ্রহের জন্য। এতে ব্যাহত হয় শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ, ব্যাহত হয় পড়াশোনার নিরবচ্ছিন্ন পরিবেশ। * নদীভাঙ্গনের কারণে অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর পরিবারগুলোকে অনেক সময় থাকতে হয় বাপ-দাদার সূত্রে প্রাপ্ত ভিটে বাড়িতে। তখন তারা জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে স্থানান্তর হন। এর ফলে তাদের কোমলমতি সন্তানদের শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়। তারা অল্প কিছু টাকার মোহে কর্মে নিযুক্ত হয়, যা শিক্ষার ক্ষেত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। * যাতায়াত ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত প্রতিকূলতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে গেলেও তারা শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারে না। সমতল ভূমিতে একজন শিক্ষার্থী যেখানে হেঁটে বা কোন বাইসাইকেল/স্কুলবাস/ভ্যানে স্কুলে যেতে পারে উপকূলীয় এলাকায় সেখানে একজন শিক্ষার্থীকে মাটির/ইটের তৈরি পথে হেঁটে গিয়ে ঝপঝপিয়া/চুনকুড়ি/শিবসার মতো বড় নদী খেয়াপার হয়ে তারপর স্কুলে যেতে হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর কোমল মন ও শরীরের জন্য যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য অনেক সময় তাদের মা-বাবা তাদের স্কুলে যেতে নিরুৎসাহিত করেন, যা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ। অর্থাৎ নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াতের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। ড্রপ আউট (ঝরে পড়া) রোধকল্পে সুপারিশসমূহ : * উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে প্রতি মাসে একবার করে রুটিনমাফিক ছাত্রছাত্রীসহ শিক্ষার্থীদের মা-বাবা, সরকারী কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকর্মীর সমন্বয়ে সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ সভা আয়োজন করতে হবে। এ সভার মাধ্যমে অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে যেন তারা সকল অবস্থায় সন্তানদের স্কুলে পাঠায়। * এলাকাভিত্তিক স্কুলবান্ধব যানবাহন ও নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত স্কুলে যাবে বলে আশা করা যায়। এজন্য সরকারী-বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে স্কুলভ্যান ও খেয়া পারাপারের জন্য ইঞ্জিন নৌকার সংখ্যা বাড়াতে হবে। * যেহেতু দারিদ্র্য এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান সমস্যা সেজন্য উপকূলীয় অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ উপবৃত্তির ও মেধাবীদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যাতে তারা শিশুশ্রমে লিপ্ত না হয় এবং পড়াশোনার প্রতি উৎসাহী হয়। * বর্তমান সরকার ‘বই উৎসবের’ মাধ্যমে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতভাগ বাচ্চাকে বছরের প্রথম দিনেই নতুন বই সরবরাহ করছে। পাঠ্যবই নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বাচ্চাদের বিদ্যালয়মুখী করা সম্ভব। * ‘মিড ডে মিল’ শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করার অন্যতম কার্যকরী ব্যবস্থা। এজন্য উপকূলীয় শিক্ষার্থীদের শতভাগ ‘মিড ডে মিল’ নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে হবে। * ছাত্রছাত্রীদের মাঝে স্কুল ড্রেস ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হলে তারা নিয়মিত স্কুলে আসতে আগ্রহী হবে। * উপকূলীয় অঞ্চলের শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে, যেন তারা উদ্ভাবনী ও চিত্তাকর্ষক উপায়ে বাচ্চাদের পাঠদান করে তাদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সক্ষম হন। * অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্যোগ সহনীয় স্কুল বিল্ডিং নির্মাণসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি ও দারিদ্র্য হ্রাসকল্পে উপকূলীয় এলাকার জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। * উপকূলীয় অঞ্চলের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ। এর মাধ্যমে উপকূলীয় দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস ও তৎপ্রেক্ষিতে দারিদ্র্য বিমোচনে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হবে, যা শিশুদের স্কুলমুখী করা এবং ঝরেপড়া রোধেও পরোক্ষভাবে অত্যন্ত ফলদায়ক ভূমিকা পালন করবে। * প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে নেদারল্যান্ডসের মডেলকে সামনে রেখে বাংলাদেশের জন্যও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ‘উবষঃধ চষধহ ২১০০’ প্রণয়ন করা হচ্ছে। এর আওতায় নেদারল্যান্ডসের নদীশাসন ও ফিজিবিলিটি স্টাডির আদলে উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য আলাদাভাবে মাস্টারপ্ল্যান করা যেতে পারে, যার আওতায় অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গৃহীত হতে পারে। একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে মানসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। আর এক্ষেত্রে উপকূলীয় অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এ অঞ্চলের জন্য আলাদাভাবে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে, যেন শতভাগ শিশু স্কুলমুখী হওয়ার পাশাপাশি তাদের ড্রপ আউট হারও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। কেননা, টেকসই শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এ দুটি বিষয়ের যুগপৎ সমন্বয় ঘটানো অত্যাবশ্যক। আর টেকসই শিক্ষাব্যবস্থার ভিতের ওপরই গড়ে উঠবে আগামী দিনের সুখী-সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’। লেখক : বিসিএস ক্যাডার (প্রশাসন)
×