ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফায়াজ শাহেদ

সৃজনশীল তারুণ্য

প্রকাশিত: ০৮:৫৯, ৩ জানুয়ারি ২০২০

 সৃজনশীল তারুণ্য

একবিংশ শতাব্দী যেন আধুনিক প্রযুক্তির সোনালি শতাব্দী। শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রযুক্তি হ্রাস নয়, বরং নতুন নতুন প্রযুক্তি আমাদের দেশ, সমাজ ও পরিবারে এসে পৌঁছাচ্ছে। জাতীয় জীবনে প্রযুক্তির ক্রমাগত এই উন্নতির ফলে আমাদের দেশে সাহিত্যচর্চায় এক বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশের মানুষ দিনের পর দিন প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, যা সাহিত্যের প্রতি অনীহার কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। এক সময় কোথাও ভ্রমণকালে যাত্রীদের হাতে সাহিত্যের বই দেখা যেত। এখন বইয়ের বদলে স্মর্টফোন নতুবা ল্যাপটপ নিয়ে সময় পার করতে দেখা যায়। যেসব শিশু মায়ের পাশে বসে ছড়া আবৃত্তি করত সেই শিশুদের ছড়া আবৃত্তির সুর এখন রূপ নিয়েছে ভিডিও গেমের মিউজিকের সুরে। বইমেলা-গুলোতেও পাঠকের অভাব লক্ষণীয়। সাহিত্যচর্চার এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুষ্টিমেয় শিক্ষার্থী যখন লেখালেখি তথা সাহিত্যচর্চা করে তারাও দেখা যাচ্ছে প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকার কর্তৃক যথাযথ মূল্যায়ন না পেয়ে কালের কোন এক দমকা হাওয়ায় ছিকটে পড়ছে হতাশার দেশে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যাদের রবীন্দ্র-নজরুলের উত্তরসূরি বলা যেতে পারে। তারা আধুনিক প্রযুক্তির এই রণক্ষেত্রে লড়াই করে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম নেতৃস্থানীয় সাহিত্যে রূপ দিতে সুদূরপ্রসারী চিন্তা করে যাচ্ছে। সরকার বিশ্বায়নের এই শতাব্দীতে প্রযুক্তিমুখী চিন্তার ফলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যয়বহুল বিজ্ঞানাগার স্থাপন করে দিচ্ছে, যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। ক্রীড়ার জন্যও দেখা যায় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমে প্রতিযোগী ও ক্রীড়ামোদীদের পরিতৃপ্ত করা হয়, যা অত্যন্ত প্রশংসার দাবিদার। সঙ্গীত, মঞ্চনাটক, আবৃত্তি তথা সংস্কৃতিচর্চার অপূর্ব সুযোগ-সুবিধা সরকার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সাহিত্যচর্চার মতো এত বড় একটি নান্দনিক শিল্পের জন্য সরকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যতিক্রমী কোন উদ্যোগ নিয়েছে বলে লক্ষ্য করা যায় না। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সৃষ্টিশীল নবীন লেখক-সাহিত্যিকদের শনাক্তকরণপূর্বক উন্নত সাহিত্যচর্চা কেন্দ্র স্থাপন করলে বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যে নেতৃত্ব দেয়ার উপযোগী হয়ে উঠবে। বিজ্ঞানচর্চার এই যুগে সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের বহুমাত্রিক অবহেলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক নবীন লেখকের অভিমত। সাহিত্যিকরা চাইলে দেশে বিরাজমান সাহিত্যচর্চার সঙ্কট ও দুর্দশা রুখে দিতে পারেন তাদের লেখনীর মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ কথা বিশ্বাস করতেন বলেই বলেছিলেন: ‘দেশের সাধারণ মানুষ, যারা আজও দুঃখী, যারা আজও চিরন্তন সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্য শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের আহ্বান জানাচ্ছি।’ জনগণের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ ও কৃষ্টিকালচার নিয়ে কথা বলে দেশীয় সাহিত্য। আর এই সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না ও কৃষ্টিকালচারের মাঝেই মিশে থাকে একটি জাতির অতীতের করুণ ইতিহাস। দেশের মানুষের মাঝে নৈতিকতার প্রদীপ জ্বালাতে হলে শিক্ষার বৈপ্লবিক গণজোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। আর শিক্ষার প্রধান অঙ্গের নাম সাহিত্যচর্চা। সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী এ ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘যিনি যাই বলুন সাহিত্যচর্চা যে শিক্ষার সর্বপ্রধান অঙ্গ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।’ বিজ্ঞান মানুষকে নৈতিকতা শেখায় না, বিজ্ঞান মানুষকে কোন বিষয়ের ওপর গভীর পর্যবেক্ষণের সামর্থ্য যোগায় কেবল। নৈতিকতা ও মনুষ্যত্ব শেখানোর শক্তি আছে কেবল সাহিত্যের। যে দেশে সাহিত্যিকদের যত বেশি মূল্যায়ন করা হয়েছে সেই দেশের সাহিত্য তত বেশি প্রাঞ্জল ও সমৃদ্ধ। আর সাহিত্যের উন্নতি মানে জাতীয় জীবনে স্বচ্ছতা আনয়ন করার ইতিহাস সুবিস্তৃত। নিজস্ব সংস্কৃতি ও স্বকীয়তাকে বিশ্ববাসীর কাছে মডেল হিসেবে উত্থাপন করতে হলে সাহিত্যচর্চার মাধ্যমেই তা সম্ভব। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন, ‘অন্তরের জিনিসকে বাইরের, ভাবের জিনিসকে ভাষায়, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলাই সাহিত্যের কাজ।’ কাজেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যদি নবীন লেখক-সাহিত্যিকদের জন্য সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র নির্মাণপূর্বক তাদের শনাক্তকরণে সরকার কর্তৃক কোন বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা না হয় তাহলে বাংলা সাহিত্যের সুন্দর আগামী অসুন্দরে পর্যবসিত হতে পারে। লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×