ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তফা সেলিমের সাক্ষাতকার

প্রকাশিত: ১২:২৫, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯

মোস্তফা সেলিমের সাক্ষাতকার

‘সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্যের চর্চা করতে গিয়ে আমি আচমকা আবিষ্কার করি, নাগরীলিপি ও সাহিত্য বাংলা সাহিত্যেরই এক বিপুল ঐশ্বর্য অথচ অনালোকিত অধ্যায়। সবিস্ময়ে দেখলাম, বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিতও। বাংলাভাষার এই বৈচিত্র্য জাতীয় শ্লাঘার একটি বিষয় হতে পারে’ বিলুপ্ত নাগরীলিপি, নাগরী সাহিত্য পুনরুদ্ধার ও প্রসারে কেন আপনি মেধা ও শ্রম বিনিয়োগে মনোযোগী হলেন? ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় আমার যথেষ্ট আনাগোনা ছিল। সেই সুবাদে ছাত্রজীবনেই নাগরীলিপি ও সাহিত্য সম্পর্কে কিছুটা জানা হয়। একটা সময় এই লিপির পুঁথি কেতাব হালতুন্নবীর একটি কপি আমার সংগ্রহে চলে আসে। খুব সম্ভব সেটা ২০০২ সালের ঘটনা। তারপর আমি এ বিষয়ে পড়াশোনা এবং অনুসন্ধান শুরু করি। যতই জানতে পারি, ততই অভিভূত হই। ক্রমশ এই লিপির সাহিত্যভা-ার এবং তার বৈচিত্র্যে আমার মুগ্ধতা বাড়তে থাকে। সিলেটি বলেই হয়তো আমি মানসিকভাবে এ লিপি ও সাহিত্য পুনরুদ্ধারে দায় অনুভব করতে থাকি। তবে শ্রম ও মেধা নিয়োজিত করেছি আরও পরে। কিভাবে নাগরীলিপি ও সাহিত্য পুনরুদ্ধার এবং এ বিপুল কর্মযঞ্জের মাধ্যমে আপনি ইতিহাসের সঙ্গী হয়ে উঠলেন? আমি সিলেটের মানুষ। সিলেটের আলো হাওয়ায় আমার বেড়ে ওঠা। তাই স্বাভাবিকভাবেই সিলেট নিয়ে আমার রয়েছে বাড়তি আবেগ। এ কারণে আমি রবাবরই সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্যে বিশেষ আগ্রহী। এই আগ্রহ থেকেই সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্যের চর্চা করতে গিয়ে আমি আচমকা আবিষ্কার করি, নাগরীলিপি ও সাহিত্য বাংলা সাহিত্যেরই এক বিপুল ঐশ্বর্য অথচ অনালোকিত অধ্যায়। সবিস্ময়ে দেখলাম, বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিতও। বাংলাভাষার এই বৈচিত্র্য জাতীয় শ্লাঘার একটি বিষয় হতে পারে। বাংলাভাষা যেমন ভাষা আন্দোলনেরে কারণে সমস্ত দুনিয়ায় সমাদৃত, তেমনি এই কারণেও তার গর্ব করার অধিকার রয়েছে। গোটা দুনিয়ার বহু ভাষার, এমনকী গুরুত্বপূর্ণ ভাষারও নিজস্ব বর্ণমালা নেই। কেবল বাংলাভাষা চর্চায় ব্যবহৃত হযেছ দুটো বর্ণমালা। প্রায় পাচশ’ বছরে চলেছে দাপটের সঙ্গে। অশ্চর্য হলেও সত্য, একটি সমৃদ্ধ সাহিত্য জগতও রয়েছে এই লিপির। মূলত মরমি গানের একটি বিশাল ভা-ার রচিত হয়েছে নাগরীলপিতে। তখন আমি মনে করেছি এগুলো আমাদের সকলের জানা দরকার। এই বিলুপ্ত লিপি ও সাহিত্য জাতীয় স্বার্থে সংরক্ষিত হওয়া জরুরী। এইবোধ থেকে আমি স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি। ২০০৯ সালে কাজ শুরু করি। সে বছরই প্রকাশ করি কেতাব হালতুন্নবী। সিলেটে বিশাল আয়োজনে ‘ফিরে দেখা সিলেটি নাগরী’ নামেও একটি বড় অনুষ্ঠান আয়োজন করি। এরপরই শুরু গবেষণা, বইপত্র প্রকাশনা এবং অন্যান্য কাজ। তারপর নাগরী লিপি ও সাহিত্য নিয়ে বিরামহীনভাবে কাজ করে চলেছি নানান আঙ্গিকে। এ-পর্যন্ত নাগরী লিপিতে আপনার সম্পাদিত এবং রচিত গ্রন্থ সম্পর্কে একটু ধারণা দেবেন? ইতোমধ্যে নাগরীলিপির ২৫টি গ্রন্থের সম্ভার ‘নাগরীগ্রন্থসম্ভার’ যৌথভাবে সম্পাদনা করেছি, আমি এবং মোঃ আব্দুল মান্নান। পাশাপাশি নাগরীলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে আরও পাঁচটি গ্রন্থ আমি রচনা করেছি; সিলেটি নাগরীলিপির সহজপাঠ, সিলেটি নাগরীলিপি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, সিলেটি নাগরীলিপি সাহিত্যে প্রণয়য়োপাখ্যান, নাগরীলিপি নবজীবনের জার্নাল, সিলেটি নাগরীলিপি বর্ণ পরিচয়। এছাড়া সম্পাদনা করছি ভেলাশাহ ফকিরের খবর নিশান। এছাড়াও অদূর ভবিষ্যতে এ লিপি নিয়ে আমাদের ভিন্নতর কিছু গ্রন্থের পরিকল্পনা রয়েছে। আপনার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এই লিপি ও সাহিত্য পুনরুদ্ধার কাজটি এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন, আপনি এটি নিয়ে গবেষণা করছেন, বইপত্র সম্পাদনা করছেন, পাশাপাশি এগুলো প্রকাশও করছেন। এছাড়া নানারকম সাংগঠনিক উদ্যোগের মাধ্যমে একে জনপ্রিয় করার চেষ্টায় সময় ও শ্রম দিচ্ছেন। এ নিয়ে বিদেশেও নাকি কাজ করছেন আপনি, এ দীর্ঘ পথচলা সম্পর্কে একটু বলবেন? মোস্তফা সেলিম : কেবল নাগরীলিপি ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা কিংবা বই প্রকাশের মধ্যে আমার কাজটি সীমাবদ্ধ থাকেনি, পাশাপাশি নানা সাংগঠনিক উদযোগ নিয়েছি। ছোটোবড় অসংখ্য সভা সেমিনার আয়োজন করেছি। দেশে বিদেশে নানারকম অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে বক্তৃতা দিয়েছি। রেডিও টেলিভিশন, সংবাদপত্রে নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি। ডকুমেন্টারি বানিয়ে তার শত শত প্রদর্শনী করেছি। বইমেলাসহ বিভিন্ন স্থানে নাগরীলিপির বইপত্র আলাদা গুরুত্ব দিয়ে প্রদর্শন করেছি। আমাদের উদ্যোগের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পৃক্ত হয়েছেন, একাত্মতা প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। আমাদের পাশে থেকে অনেকেই কাজটি এগিয়ে নেওয়ার আন্তরিক চেষ্টা করছেন। তাদের অনেকেই উদ্যোগী হয়ে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনামূল্যে নাগরীলিপির বইপত্র সরবরাহ করেছেন। নানারকম সংগঠন প্রচারের কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। নাগরীলিপি নিয়ে এখন বিপুল এক সচেতনতা তৈরি হয়েছে। শুধু আমি একা নই, এখন ঐতিহ্যবোধে অনুপ্রাণিত মানুষেরা একে এগিয়ে নেয়ার কাজটি করছেন। বাংলালিপির সঙ্গে নাগরীলিপির মৌলিক পার্থক্য কিংবা সামঞ্জস্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া সম্ভব? নাগরীলিপি ও বাংলালিপির মধ্যে পার্থক্য আসলে খুব বেশি নেই। বর্ণ নাম ও উচ্চারণ একই। তবে, বর্ণ সংখ্যায় তফাত রয়েছে। নাগরীলিপির বর্ণ সংখ্যা ৩২। এখানে স্বরবর্ণ ৫টি, ব্যঞ্জনবর্ণ ২৭। যুক্ত বর্ণ ১৬টি। বাংলাবর্ণের একই উচ্চারণের একাধিক বর্ণকে নাগরীলিপিতে বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু ছোটখাটো ব্যতিক্রম তো আছেই। আপনি কি মনে করেন নাগরীলিপি ও সাহিত্যের ব্যাপকভাবে চর্চা হওয়া দরকার? সিলেটের বাইরেও কি এর চর্চা ও প্রসারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন? নাগরীলিপি তো বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়, এটি এদেশের মানুষের ভাষাসম্পদ, অনন্য এক ঐতিহ্য। এর চর্চা হলে, আমাদের দেশের ভাষা সমৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকৃত হবে। তাছাড়া এই লিপির সাহায্যে যে সাহিত্য চর্চা হলো, তার তো সংরক্ষণ দরকার, সংরক্ষণে পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। নাগরীলিপি স্বতন্ত্র হলেও তো এই লিপিতে মূলত সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত বাংলা ভাষারই চর্চা হয়েছে। এই চর্চার মধ্যে দেশের ভাষা, বর্ণের যে বহুল বৈচিত্র্য রয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। ভাষা ঐতিহ্য সব অঞ্চলের জন্যই গৌরবের। নাগরী সিলেটের আঞ্চলিক হলেও ঐতিহ্যে বেশ গুরুত্ববহ। এই চিন্তা চেতনা থেকে সিলেটের বাইরে অবশ্যই এর প্রচার ও প্রসারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। বিকল্প বর্ণমালা হিসেবে সিলেটি নাগরীলিপি জাতীয় জীবনে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করবে বলে আপনি মনে করেন? মূলধারার বাংলা বর্ণমালার প্রভাবের কাছে একটা সময়ে হারিয়ে গেছে সিলেটি নাগরীলিপি এটি চরম বাস্তবতা। তবে নাগরীলিপির বর্ণমালা ছিল অনেকটাই আধুনিক। বাংলা বর্ণমালার সংস্কারের মাধ্যমে এর প্রবর্তকেরা আমাদের কাছে একটি দিকনির্দেশনা রেখেছেন। বাংলা বর্ণমালার বর্ণ জটিল এবং যুক্তবর্ণের যে জটিলতা, তার থেকে মুক্তির একটি রূপরেখা এখানে পাওয়া যায়। আদতে নাগরীলিপি ও সাহিত্য আমাদের অনুপম ঐতিহ্য। আর যে কোন ঐতিহ্যই নানান আঙ্গিকে জাতীয় জীবনে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তবে ততোটা করবে সেটা নির্ভর করবে জাতীয়ভাবে এ লিপি ও সাহিত্যের প্রসার ও চর্চার ওপর। আপনার বিভিন্ন লেখায় এবং বক্তৃতায় আপনি দাবি করেছেন, নাগরীলিপির নবজাগরণ হয়েছে, সেটা কিভাবে, একটু বুঝিয়ে বলবেন? নাগরীলিপির নবজাগরণ বিষয়টিকে দুভাবে আপনি ব্যাখ্যা করতে পারবেন। প্রথমত নাগরীলিপির হাজার হাজার বইপত্র এখন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিতে নাগরীলিপির বইপত্র সংরক্ষিত হয়েছে। দেশের বাইরে ভারতে, ইংল্যান্ডের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে এমনকী শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছে নাগরীলিপির বইপত্র। দেশের সংবাদপত্র এখন গুরুত্ব দিয়ে নাগরীলিপি বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশ করে। ক্রমাগত চেষ্টায় দেশের একাডেমিক লোকজন এই বিষয়ে কমবেশি এখন ধারণা রাখেন। এটি গেল একটি দিক। অন্যদিক হচ্ছে, সিলেটে শহরের প্রবেশ মুখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নাগরীচত্বর, সিলেটের ডিসি অফিসে নাগরীলিপির হরফকে মিনিয়েচার করে বসানো হয়েছে। সিলেটে বইয়ের দোকান থেকে কাগড়ের দোকানের নাম লিপিবদ্ধ হচ্ছে নাগরীলিপিতে শপিং ব্যাগে লেখা হচ্ছে নাগরী। বিশ্ববিদ্যালয়ে নাগরী ইনস্টিটিউট খোলা হয়েছে। স্কুল স্থাপিত হয়েছে। বিভিন্ন রকমের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে নাগরীলিপির প্রচার করা হচ্ছে। বিয়ের দাওয়াতপত্র রচনা হচ্ছে এই লিপিতে। সিলেটের বড় বড় অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্রও রচনা করা হচ্ছে এই লিপিতে। সিলেটের দেয়ালে দেয়ালে নাগরীলিপিতে লেখা শোভা পাচ্ছে। নাগরীলিপির প্রচারের জন্য বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপ কাজ করছে। আমি প্রতিদিনই নানা অভিজ্ঞতার মখোমুখি হই। কবরের এফিটাফ যেমন লিখে দিতে হয় তেমনি সুদূর ব্রিটেনের টেলিভিশনের নামটিও বাংলালিপির পাশাপাশি নাগরীলিপিতে লিখে দিতে হয় আমাকে। এককথায় এক অভূতপূর্ব নবজাগরণ এসেছে নাগরীলিপিকে ঘিরে। সত্যিকার অর্থেই আমি আপ্লুত, আনন্দিত। আমার দৃঢ় বিশ^াস, আমাদের স্বপ্নবীজ মহীরুহে রূপ নিতে যাচ্ছে, আমাদের লক্ষ্যও বাস্তবায়নের পথে। নাগরীলিপি ও সাহিত্য নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনায় ভিন্নতর কিছু আছে কি? সিলেটি নাগরীলিপি নতুন জীবন লাভ করেছে। শুধু সিলেট নয়, সারাদেশের মানুষের মধ্যে বিষয়টি নতুন অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। একটি লিপি বা ভাষার যখন পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করা হয়, তখন তার নমুনা বা নিদর্শনকে সংরক্ষণ করতে হয়। নাগরীলিপির এই নবজীবনকে চিরস্থায়ী করার জন্য এখন একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি অনভূত হচ্ছে। তাই সিলেটী নাগরীলিপি ও তার সাহিত্য সংরক্ষণের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য আমি কাজ করছি। আশা করছি, আগামী বছর জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারব। এছাড়া নাগরীলিপির পুথিপুস্তক সংরক্ষণ এবং প্রকাশের ক্ষেত্রে ভিন্নতর অনেক কিছুই আমাদের পরিকল্পনায় রয়েছে। সর্বশেষ কথা হচেছ, কাজটি আমরা অবশ্যই সযতেœ চালিয়ে যেতে চাই।
×