ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আবিদ আলির অনন্য রেকর্ড

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯

আবিদ আলির অনন্য রেকর্ড

গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট কিন্তু রেকর্ড আর পরিসংখ্যানেরও খেলা। টেস্টে শ্রীলঙ্কার দলীয় সাড়ে ৯শ’র ওপরে রান, ইনিংসে ব্রায়ান লারার ব্যক্তিগত ৪শ’, ওয়ানডেতে শচীন টেন্ডুলকরের ১শ’ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি, পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাটসম্যানের ৮টি ব্যক্তিগত ডাবল সেঞ্চুরি ইনিংস, টেস্ট, ওয়ানডে ও টি২০তে বোলারদের হ্যাটট্রিকের পর হ্যাটট্রিক, টানা চার বলে ৪ উইকেট, আরও কত কী! একটা সময় মনে হতো কিছু রেকর্ড হয়ত কোনদিনই ভাঙ্গবে না, কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেটিও ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গছে প্রতিনিয়ত। এই যেমন আবিদ আলি এমন এক রেকর্ড গড়লেন, ক্রিকেটের প্রায় দেড় শ’ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম। করাচী টেস্ট দিয়ে দীর্ঘ দশ বছর পর পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট প্রত্যবর্তনের ম্যাচটা ড্র হয়েছে বৃষ্টি কারণে। সেখানে পঞ্চম ও শেষ দিনে স্বাগতিকরা খেলার সুযোগ পেয়েছে ৭০ ওভারে। তাতেই ১০৯ রান করে অপরাজিত আবিদ। ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডের পর টেস্টেও নিজের অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরির অনন্য কীর্তি গড়েন ৩২ বছর বয়সী এ ব্যাটসম্যান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ পেতে পেতে বয়স ছিল ৩২ ছুঁইছুঁই। অনেক প্রতীক্ষার সেই অভিষেক রাঙ্গিয়ে ছিলেন দারুণভাবে। গত মার্চে ওয়ানডে অভিষেকে করেছিলেন সেঞ্চুরি। সেই আবিদ এবার টেস্ট অভিষেকেও করলেন সেঞ্চুরি। গড়লেন এমন এক কীর্তি, ক্রিকেট ইতিহাসে যা করতে পারেননি আর কেউ! ১০৫টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলার পর টেস্ট অভিষেক। সেই টেস্টেও ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছেন পঞ্চম দিনে এসে। দীর্ঘ অপেক্ষা শেষেই এসেছে অনির্বচনীয় স্বাদ। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুটি সংস্করণে অভিষেকে সেঞ্চুরি। রাওয়ালপিন্ডিতে রবিবার শেষ দিনের শেষ সেশনের শুরুর দিকে পেসার বিশ্ব ফার্নান্দোর বলে দুই রান নিয়ে তিন অঙ্ক স্পর্শ করেন ৩২ বছর বয়সী ডানহাতি ব্যাটসম্যান। তার নাম খোদাই হয়ে যায় ইতিহাসে। গত মার্চে দুবাইয়ে অভিষেক ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১১২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন আবিদ। একদিনের ক্রিকেটে অভিষেকে সেঞ্চুরি আছে আবিদসহ ১৫ জনের। টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরির স্বাদ আবিদকে দিয়ে পেলেন ১০৬ জন। কেবল আবিদের নামই আছে দুটি তালিকায়। টি২০ অভিষেকে সেঞ্চুরি আছে তিন জনের। তাদের কারও দেশ টেস্ট খেলার ধারে কাছে নেই। তিনজনের দুইজন টি২০ ছাড়া অন্য কোন সংস্করণ খেলেননি। একজন ওয়ানডে খেললেও করতে পারেননি সেঞ্চুরি। দুটি সংস্করণে সেঞ্চুরির সবচেয়ে কাছে আগে যে দুইজন গিয়েছিলেন, তাদের কেউই সেঞ্চুরি করতে পারেননি একটিতেও। প্রথম জন নিউজিল্যান্ডের স্টিভেন ফ্লেমিং। ১৯৯৪ সালে টেস্ট অভিষেকে ভারতের বিপক্ষে ৯২ রানে আউট হওয়ার তিনদিন পর ওয়ানডে অভিষেকে আউট হয়েছিলেন ৯০ রানে। আরেকজন রিকি পন্টিং। ১৯৯৫ সালে টেস্ট অভিষেকে বিতর্কিত সিদ্ধান্তে এলবিডব্লিউ হয়েছিলেন ৯৬ রানে। ২০০৫ সালে টি২০ অভিষেকে অপরাজিত ছিলেন ৯৮ রানে। ইতিহাসে নাম লেখানো ইনিংসের পর ক্রিজের অপরপ্রান্তে অপরাজিত সেঞ্চুরিয়ান সতীর্থ বাবরকে আজমকে বিশেষ ধন্যবাদ দিয়েছেন আবিদ, ‘কী বলতে পারি আমি? শুধু আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই। আল্লাহকে ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করতে পারব না। নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে একটু চাপে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবরকে ধন্যবাদ। সে বারবার বলেছে, আমার সময় আসছে। ওকে ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করতে পারব না।’ আবিদ অবশ্য প্রথম কোন পুরুষ ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ও ওয়ানডে, দুই ফরম্যাটের অভিষেকেই সেঞ্চুরি করলেন। এর আগে ইংল্যান্ড নারী দলের ক্রিকেটার এনিড ব্যাকওয়েল প্রথম কোন ক্রিকেটার হিসেবে এই কীর্তি গড়েছিলেন। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে এ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়া নারী দলের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকে করেছিলেন সেঞ্চুরি (১১৩ ও ৩৭)। টেস্ট অভিষেকের তিন বছরের একটু বেশি সময় পর ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক নারী একাদশের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হয় এনিড ব্যাকওয়েলের। সেই ম্যাচে ওপেন করতে নেমে ১০১ রান করে অপরাজিত থাকেন তিনি। তবে পুরুষদের ক্রিকেটে এতদিন এমনটি হয়নি। আর পাকিস্তানের হয়ে এর আগে রাওয়ালপিন্ডিতে ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেক টেস্ট খেলতে নেমে সেঞ্চুরি করেছিলেন আলি নাকভি এবং আজহার মেহমুদ। ১৯৯৯ সালে নিজের অভিষেকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন গ্রেট ইউনুস খান। এদিন সেই কৃীর্তি দেখিয়েছেন আবিদ আলি। তার সঙ্গী বাবর আজমও তুলে নেন সেঞ্চুরি। এ ম্যাচটি অবশ্য হয়েছে ড্র। দুবাইয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গত মার্চে ওয়ানডে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন আবিদ আলি। সেদিন ওপেনিংয়ে নেমে তিনি খেলেছিলেন ১১৯ বলে ৯ চারে ১১২ রানের চোখ জুড়ানো ইনিংস। ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে ১৫তম ব্যাটসম্যান হিসেবে এই রেকর্ড গড়েছিলেন। তবে পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের মধ্যে তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেকে সেঞ্চুরির ইতিহাস গড়েছিলেন আবিদ। ওয়ানডেতে তার আগে ১৯৯৫ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম পাকিস্তানী ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেকে সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন সেলিম ইলাহি। ২০১৭ সালে সেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই ওয়ানডে অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন পাকিস্তানের কিংবদন্তি ক্রিকেটার ইনজামাম-উল হকের ভাতিজা ইমাম-উল হক। বর্তমানে পাকিস্তান জাতীয় দলে নিয়মিত খেলছেন ইমাম। সেলিম ও ইমামমের পর তৃতীয় পাকিস্তানী ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন আবিদ আলি। ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডের পর টেস্ট অভিষেকেও সেঞ্চুরির সুবাস মিলিয়ে যাওয়ার আগে আরও এক কীর্তিতে নিজের নাম জড়িয়ে নেন আবিদ আলি। করাচিতে নিজের ও সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে হাঁকান আরও এক সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টেই সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানদের ছোট্ট তালিকায় জায়গা করে নেন তিনি। পাকিস্তানের হয়ে সাদা পোশাকের এমন দুর্দান্ত শুরু হয়নি আর কারও। ২১ চার ও ১ ছক্কায় ২৮১ বলে উপহার দেন ১৭৪ রানে মনোমুগ্ধকর ইনিংস। যেখানে পাকিস্তানের টপঅর্ডারের চার ব্যাটসম্যানই পেয়েছেন সেঞ্চুরি। শান মাসুদ ১৩৫, অধিনায়ক আজহার আলি ১১৮ ও ইনফর্ম বাবর আজম করেন অপরাজিত ১০০ রান। প্রথম চার ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি, টেস্ট ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় উদাহরণ এটি। ৩ উইকেটে ৫৫৫ রানে ইনিংস ঘোষণার পর ২৬৩ রানের বিশাল জয়ে সিরিজ জিতে নেয় পাকিস্তান। ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টে সেঞ্চুরির কীর্তি আছে আরও আট জনের। তবে পাকিস্তানের হয়ে আবিদই প্রথম। আর প্রথম তিন টেস্টে টানা সেঞ্চুরির নজির আছে কেবল মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের। আবিদকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত বর্তমান কোচ মিসবাহ উল হক বলেন, ‘আবিদ দারুণ প্রতিভাববান ব্যাটসম্যন। ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত পারফর্মার। আমরা ওর সামর্থ্যরে ওপর আস্থা রেখেছি। ওয়ানডের পর টেস্টেও সে অভিষেকে সেঞ্চুরি পেয়েছে। আশা করছি আগামীতেও এভাবে দলকে সার্ভিস দিয়ে যাবে।’ সাবেক অধিনায়ক মিসবাহ কেবল বর্তমান কোচই নন, একই সঙ্গে তিনি প্রধান নির্বাচকও। দায়িত্ব নেয়ার পরই যিনি জানিয়েছিলেন, বয়স নয়, পারফর্মেন্স বিবেচনায় নেবেন। কাজেও সেটি করে দেখাচ্ছেন তিনি।
×