ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জবুথবু রাজধানী

দাপুটে শুরু পৌষের, মাঘের আগেই যেন বাঘে পেয়েছে

প্রকাশিত: ১০:৩৬, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯

দাপুটে শুরু পৌষের, মাঘের আগেই যেন বাঘে পেয়েছে

মোরসালিন মিজান ॥ একটু একটু করে শীত নামে। কয়েকদিন আগেও তা-ই দেখা গেছে। কিন্তু হঠাৎ যেন বদলে গেল ছবিটা। শীত একেবারে কামড়ে ধরল। ঠা-া বাতাস হাড়ে গিয়ে লাগছে। কারণ আর কিছু নয়, পৌষ এসেছে। শীতের প্রথম মাসটির, বলতেই হবে, দাপুটে শুরু এখন দেখছি আমরা। গত সোমবার থেকে শীতকালের শুরু হলো। আজ বৃহস্পতিবার চুতর্থ দিন। এরই মাঝে জবুথবু অবস্থা ঢাকাবাসীর। মাঘের আগেই যেন বাঘে পেয়েছে। শুরুতেই কেন এমন জেঁকে ধরা? উত্তরে চাইলে আবহাওয়া অফিস বলছে, বাংলাদেশ বিষুব রেখার উত্তরে। প্রায় সাড়ে ২৩ ডিগ্রী অক্ষাংশে। কিন্তু শীতকালে অবস্থান পরিবর্তন করে সূর্য বিষুব রেখার দক্ষিণে চলে যায়। দক্ষিণে কিছুটা হেলে থাকে। দিন ছোট হয়। বড় হতে থাকে রাত। এর ফলে শীতের প্রকোপ বাড়ে। বাংলাদেশে যখন শীতকাল, পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোয় তখন গ্রীষ্ম। ওসব দেশে বাতাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উত্তর গোলার্ধ থেকে ঠা-া বাতাস দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। সেখান থেকে বরফ শীতল বায়ু এ দেশের উপর দিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চল থেকে যে ঠা-া বাতাসের প্রবল প্রবাহ সৃষ্টি হয় তা শৈত্যপ্রবাহ নামে পরিচিত। এ সময় তীব্র ঠা-া অনুভূত হয়। বর্তমানে যে হাওয়া বইছে সেটি শৈত্যপ্রবাহ না হলেও, কাছাকাছি। তাই ঠা-া বেড়েছে। বৃহস্পতিবার দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ১০.৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। রাজধানী ঢাকায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৬.২ ডিগ্রী। তবে তাপমাত্রা যা, তার চেয়ে বেশিই অনুভূত হচ্ছে ঠা-া। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই মুখ লুকিয়ে ছিল সূর্য। বেলা বাড়তে থাকলেও, সূর্য আর অস্তিত্বের জানান দিতে পারেনি। কবি কিশোর সুকান্ত তাই লিখেছিলেন, সকালের এক- টুকরো রোদ্দুরÑ/ এক-টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামী।/ ঘর ছেড়ে আমরা এদিক-ওদিকে যাইÑ/এক-টুকরো রোদ্দুরে তৃষ্ণায় ...। তৃষ্ণা এদিন আর মেটেনি। উল্টো শীতল হাওয়া বইছিল। এদিন ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অনেকেই শীতবস্ত্র গায়ে দিয়েছিলেন। এর পরও সুবিধা করতে পারেননি। আর যারা সাতপাঁচ না ভেবে বের হয়েছিলেন, তারা পড়েন যান বিপদে। শীতে জমে যাওয়ার মতো অবস্থা হয় তাদের। রাজধানীর দোকানগুলোতে এদিন শীতবস্ত্র কেনার ধুম পড়ে। মার্কেট শপিংমলে হঠাৎ ভিড় লক্ষ্য করা যায়। দুপুরের দিকে বসুন্ধরা শপিংমলে গিয়ে দেখা যায়, শীতবস্ত্র কিনতে এক রকম ছুটে এসেছেন ক্রেতা। শোয়েব নামের এক ক্রেতা বলছিলেন, অনেক দিন ধরেই শীতবস্ত্র কেনার প্ল্যান করছিলাম। কিন্তু হয়ে ওঠছিল না। আজকের শীত দেখে মনে হয়েছে, আর দেরি করলে বিপদ আছে! তাই শীতবস্ত্র কিনতে এসেছেন বলে জানান তিনি। ফুটপাথের দোকানগুলো বিশেষ চোখে পড়ে। পল্টন এলাকার ফুটপাথে কিছু দোকান। এসব দোকানের সামনে ছোটখাটো সমাবেশের মতো দেখা গেল। রুমেল নামের এক তরুণ এক জোড়া হাতমুজা কিনে ফেরার সময় বললেন, দুই দিন আগে ৩০ টাকা দাম চেয়েছে। আজ কিনলাম ১০০ টাকা দিয়ে! অবশ্য পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের শীতের সঙ্গে বাংলাদেশের শীতের পার্থক্য বিস্তর। কোন কোন দেশে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রীতে নেমে আসে। খুব কাছের দেশ চীনেও তাপমাত্রা মাইনাস নয় দশ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নিচে নামে! মেরু অঞ্চল বা এন্টার্কটিকার কথা তো বলাই বাহুল্য। সেখানে বাংলাদেশে তাপমাত্রা ছয় কিংবা পাঁচ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে খুব একটা নামে না। তাই শীত বাঙালীর অন্যতম প্রিয় ঋতু। এ ঋতুকে স্বাগত জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেনÑ ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আ য় আ য় আয় ...।’ একই রকম উচ্ছ্বাস ছিল নজরুলের কবিতায়। কবি লিখেছেনÑ ‘পউষ এলো গো!/পউষ এলো অশ্রু-পাথার হিম পারাবার পারায়ে।/ঐ যে এলো গো...।’ পৌষ নিয়ে প্রেম দেখানোর কারণও অনেক আছে। এ সময় গ্রামেগঞ্জে পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম পড়ে। শহরেও কম বেশি দেখা যায়। খেজুরের রস এ সময় ঘন হতে থাকে। আর পৌষ সংক্রান্তির মেলা তো ঐতিহ্যের অংশ। শীতকালে ফুলেরাও যেন বাড়তি আবেদন নিয়ে হাজির হয়। সৌন্দর্যের সবটুকু মেলে ধরে। মৌসুমী ফুলে ভরে ওঠে বাগান। হলুদ গাঁদা ফুল এরই মাঝে শীতকে স্বাগত জানিয়েছে। আর গোলাপ তো ফুল নয় শুধু, বিশেষ জাত। খুব প্রিয় গোলাপ সারা বছরই ফোটে। তবে এই এখন মৌসুম। গোলাপের মিষ্টি ঘ্রাণে ক্রমশ চারপাশ ভরে ওঠছে। ফুটছে ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, মোরগফুল। মুখ তুলে তাকাচ্ছে সূর্যমুখী। আকাশের দিকে তাকিয়েও এখন অনুমান করা যায়, শীত এসেছে। সেখানে ওড়ে বেড়াচ্ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে শীতের পাখিরা। প্রায় সারাদেশের বনে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের শাখায় এখন উৎসব চলছে পাখিদের। দেশীয় পাখিদের সঙ্গে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে যোগ দিয়েছে অতিথি পাখিরা। কবির ভাষায়Ñ শীতের পাখিরা বৈকাল থেকে উড়ে আসে নাতিশীতোষ্ণ দেশে...। পৌষে কৃষকের ফসল ঘরে তোলার কাজ শেষ হয়ে যায়। হাতে তেমন কাজ থাকে না। সবাই উৎসব আনন্দে মাতে। চলে নানা উৎসব অনুষ্ঠান। সব মিলিয়ে শীতকে স্বাগত জানাতেই হয়।
×