ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বারোমাসি লেবু চাষে সাফল্য

প্রকাশিত: ০৯:২২, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯

বারোমাসি লেবু চাষে সাফল্য

রফিকুল ইসলাম আধার, শেরপুর ॥ কৃষিসমৃদ্ধ অঞ্চল শেরপুরে এবার বীজবিহীন নতুন জাতের বারি-৪ বারোমাসি লেবু চাষে সাফল্য দেখা দিয়েছে। স্বল্প শ্রম ও উৎপাদন খরচে কয়েকগুণ লাভ হওয়ায় ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ প্রচুর রস ও সুঘ্রাণযুক্ত এ লেবু আবাদ শেরপুর সদরের চরাঞ্চল, নকলা ও সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতীর পাহাড়ী এলাকায় দিন দিন বাড়ছে। উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমির বেলে বা বেলে-দোআঁশ মাটিতে উৎপাদিত এ লেবু স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ হচ্ছে। ফলে ওই লেবু চাষ করে লাভবান হচ্ছেন স্থানীয় বেকার যুবক ও চাষীরা। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে কাগজি লেবু, পাতি লেবু, এলাচি লেবু ও বাতাবি লেবু চাষ হয়ে আসলেও আধুনিক উৎকর্ষের যুগে সেই তালিকায় কয়েক বছর আগে যোগ হয় হাইব্রিড জাতের লেবু। আবার হাইব্রিড জাতের লেবুর পর যোগ হয় নতুন জাতের বীজহীন (সিডলেস) বিনা-১ ও বারী-৪ লেবু। কৃষিসমৃদ্ধ কোন কোন এলাকায় বারী-৪ জাতের লেবু চাষে সফলতার মুখ দেখে প্রায় ৩ বছর আগে এলাকার সংসদ সদস্য তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর পরামর্শে নকলা উপজেলা কৃষি বিভাগের তরফ থেকে স্থানীয় বেকার যুবকসহ প্রান্তিক ক্ষুদ্র চাষীদের ওই বীজহীন লেবু চাষে উৎসাহিত করা হয়। সেই উৎসাহে উপজেলার বানেশ্বরদী, পাঠাকাটা, টালকী, অষ্টধর ও চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের প্রায় ৫০ জন কৃষক কাটা কলম সংগ্রহ করে বীজহীন লেবু চাষ করেন। রোপণের বছর বাদে প্রতি বছর একবার ডালপালা ছাটা, মাটি কোপানো, প্রতি ৩ মাসে একবার নিড়ানি ও ২ থেকে ৩ মাস অন্তর সেচ ও সামান্য জৈব সার দিতে হয়। ফলে একরে বার্ষিক খরচ হয় মাত্র ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। আর এক একর জমির লেবুতে আয় হয় কমপক্ষে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা। তাছাড়া নিজের উৎপাদিত কলম চারা দিয়ে ফিবছর নতুন বাগান তৈরি করা ছাড়াও প্রতিটি কলম করা চারা ৩০ থেকে ৫০ টাকা করে বিক্রি করা যায়। আর তাতেই আসে তাদের সাফল্য। ফলে সিডলেস লেবুতে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষক অন্য আবাদ ছেড়ে এ লেবু চাষের দিকে যেমন বেশি ঝুঁকছেন, তেমনি ওই লেবু চাষ করে অনেকেই পরিবারের ব্যয় নির্বাহসহ ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার আর্থিক যোগান দিয়ে পারিবারিকভাবে সাফল্য অর্জন করছেন। কেউবা করছেন বাড়ি-গাড়ি। এতে ওই লেবু চাষে এখন উৎসাহী হয়ে উঠছেন আরও অনেকেই। সরেজমিনে গেলে কথা হয় চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের উত্তর বাছুরআলগা গ্রামের লুৎফর রহমান, তার ছোট ভাই মোস্তাক আহমেদ ও ভগ্নিপতি আবুল হাসেমসহ অনেকের সঙ্গে। লেবু চাষী লুৎফর রহমান জানান, ২০১৬ সালে ৭৫ শতাংশ জমি বন্ধক নিয়ে ওই জমিতে ৩০৬টি সিডলেস লেবুর কলম করা চারা রোপণ করেন। বৃদ্ধি পেয়ে তার বাগানের পরিধি এখন দ্বিগুণ হয়েছে। চারা কেনা, রোপণ, জমি বন্ধক নেয়া, জমি তৈরি, সেচ ও সারসহ অন্যান্য খরচ মিলে প্রথম বছর তার লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়। পরের বছর ওইসব গাছে ফলন আসা শুরু হয়। রোপণের পরের বছর ২০১৭ সালে তিনি ২ লাখ টাকার লেবু বিক্রি করেন। ২০১৮ সালে তিনি প্রায় আড়াই লাখ টাকার লেবু বিক্রি করেছেন। এ বছর প্রথম দিকে লেবুর দাম ভাল থাকায় ৩ লাখ টাকার লেবু বিক্রি হয়েছে। তবে এখন দাম কমে যাওয়ার পরও আরও অন্তত লাখ টাকার লেবু বিক্রি করা সম্ভব। তিনি আরও জানান, লেবুর আয়ে তিনি জমি, বাড়ি ও গাড়ি করেছেন। তাছাড়া লেবুতেই ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া ও সংসার খরচ চলে তার। তার এমন সফলতা দেখে ছোট ভাই সিডলেস লেবুর বাগান করে সফল হয়েছেন। চাষী আবুুল হাসেম জানান, তার ৭০ শতাংশ জমির লেবু বাগান থেকে তার মাসিক আয় হচ্ছে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। এ হিসাবমতে তার বছরে আয় হয় ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা, যা অন্য কোন আবাদে অসম্ভব। লেবু চাষী লুৎফর রহমান বলেন, বর্তমানে প্রতি হাজার লেবু ৯শ টাকা থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে বছরের প্রথম দিকে দাম ভাল থাকায় প্রতি হাজার লেবু ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। লেবুর বাগান পরিচর্যায় স্ত্রী ও সন্তানরা সহযোগিতা করায় শ্রমিক ব্যয় কম হয়। চাষীরা জানান, লেবু বাগানের আয় দিয়েই তাদের সংসারের সব খরচ চলে। ভালভাবেই চলছে তাদের সংসার, তারা প্রত্যেকেই হয়েছেন লাখপতি। করেছেন বাড়ি গাড়ি। বর্তমানে লুৎফরের বাগানে অন্তত হাজার খানেক কলম কাটা আছে। ওই কলম করা চারা বিক্রি থেকে তার আয় হবে অন্তত অর্ধলাখ টাকা। এ ব্যাপারে জেলা খামারবাড়ির উপপরিচালক কৃষিবিদ আশরাফ উদ্দিন বলেন, সদর উপজেলার চরাঞ্চল, নকলা ও ঝিনাইগাতীর পাহাড়ি এলাকাসহ জেলার প্রায় ৫শ একর জমিতে বারী-৪ জাতের বীজবিহীন লেবু চাষ হচ্ছে। কৃষি বিভাগের তরফ থেকে ওইসব লেবু বাগানের মালিকদের নিয়মিত পরামর্শ সেবা দেয়া হচ্ছে। সঠিক পরিচর্যা করলে একবার চারা রোপণের পর একাধারে অন্তত ২০ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।
×