ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের চিত্রকলা এ সময়ে

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯

বাংলাদেশের চিত্রকলা এ সময়ে

মূর্তরূপে বিমূর্ত সুন্দরের সৃজন বা প্রকাশ হলো কলা। আর্ট নিয়ে প্লেটো বলেছেন, ‘আর্ট হচ্ছে ইমিটেশন বা নকল এবং সে কারণেই সত্য থেকে তা অনেক দূরে’। এ্যারিস্টোটল বলেছেন, ‘যেহেতু ইমিটেশনের মাধ্যমেই ক্রমান্বয়ে এ পৃথিবীতে মানুষের সচলতা এবং সজীবতা তাই শিল্প ইমিটেশন হওয়ার কারণেই সত্য বস্তুর চেয়ে অধিকতর জীবন্ত’। রবীন্দ্রনাথ শিল্পকে দেখেছেন এভাবে,‘আর্ট (শিল্প) হলো সত্যের ডাকে মানুষের সৃষ্টিমুখর অন্তরে সাড়া দেয়া’। বিভিন্ন যুগে দৃশ্যকলার বিভিন্ন শ্রেণী বিভাগ করা হয়েছে। ললিত কলা ও ফলিত কলা তার মধ্যে প্রধানতম। বিংশ শতাব্দীতে কলার প্রধান শাখা হিসাবে নয়টি বিদ্যাকে চিহ্নিত করা হয়। স্থাপত্য, চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত, ভাস্কর্য, নৃত্য, চিত্রকলা, কাব্য, চলচিত্র, ফটোগ্রাফি এবং গ্রাফিক আর্ট। বর্তমান সময়ে ভিডিও, ডিজিটাল শিল্প, পারফর্ম্যান্স শিল্প, বিজ্ঞাপন, এ্যানিমেশন, টেলিভিশন এবং ভিডিও গেমকেও শিল্পের মর্যাদা দেয়া হয়। সর্বোপরি বলা যায়, দৃশ্য বা অদৃশ্য কোন ভাবরূপ শিল্পীর চিত্তরসে নবরূপায়িত হয়ে যে স্থিতিশীল রূপ প্রকাশ ঘটে তাই শিল্প। চিরায়ত ও চিরন্তন নৈসর্গিক প্রকৃতিকে শিল্পীর নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত রং, রেখা, শব্দ বা রূপকের আশ্রয়ে প্রকাশ করে সেই অনুভূতি অন্যের মনে সঞ্চারের মাধ্যমে একটি পরিচয়বোধের সঞ্চারণ ঘটানোকেই শিল্প হিসাবে অভিহিত করা হয়। এখানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিল্পের অন্যতম প্রধান শাখা চিত্রকলার হালচাল এবং বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীদের চিত্রকলার বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করার প্রচেষ্টা থাকবে। একজন প্রতিকৃতিকারী তার মনের সৌন্দর্য নানাভাবে, নানা বর্ণে রঞ্জিত করে নকশার মাধ্যমে উপস্থাপন করে তখন চিত্রের আর্বিভাব হয়। একজন চিত্রকর দেশ-প্রেম, নাগরিক ও গ্রামীণ জীবন এবং জনপদের মানুষের নানা শোক-দুঃখ, হাসি-কান্না, জন্মের আদি কথোন, কৃষ্টি, ইতিহাস-ঐহিত্যকে সমন্বয় করে চিত্র অঙ্কন করার চেষ্টা করেন। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও জীবন-ব্যবস্থার অলিগলি এবং জীবনের বিভিন্ন সঙ্কট-সংঘাতে চিত্রকররা মননের সবটুকু উজাড় রং করে দেন ছবি আঁকার ক্যানভাসে। বাংলাদেশের চিত্রকলার হালচাল জানতে হলে বাংলার চিত্রকলার প্রাম্ভিক ইতিহাস ও ঐহিত্য জানা আবশ্যক। পাল-আমলে (৭৫০-১১৬২ খ্রি.) রাজা মহীপাল দেব (৯৯৩-১০৪৩)-এর সময়ে তালপাতায় অঙ্কিত নালন্দা মহাবিহারের ‘বৌদ্ধ-অনুচিত্র’গুলোকে বাংলার প্রাচীন নিদর্শন বলে মনে করা হয়। অঙ্কনশৈলীর বিচারে এ চিত্রকলা সর্বভারতীয় ধ্রুপদী চিত্রকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পশ্চিম ভারতের ‘অজান্তা-দেয়ালচিত্রের’ সমগোত্রীয় বলে ধারণা করা হয়। তবে ওই সময়ের পূর্বে এ অঞ্চলে চিত্রচর্চার ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল। (সূত্র : বাংলাপিডিয়া)। পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার ‘পা-ুরাজার ঢিবিতে’ বঙ্গীয় অঞ্চলে মানব সভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শন আবিষ্কার হয়েছে। বাংলায় প্রাচীন যুগের মানুষের চিত্রাংকনের দক্ষতার সর্বপ্রাচীন নিদর্শন পা-ুরাজার ঢিবিতে পাওয়া মৃৎপাত্রের গায়ে আঁকা নানা নকশাধর্মী অলঙ্কারণ। তাঁরা মূর্ত বা বিমূর্ত এবং পাখির রেখাচিত্র অঙ্কন করেছিল। তবে তাঁরা তাদের চিত্রকলায় ধর্মীয় ও মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গি সংযোন করতে ব্যর্থ হয়। মহাস্থানের প্রাচীন ‘পু-্রনগর’-এ প্রাপ্ত মৌর্যযুগের (খ্রি. পূর্ব ৩৩-১৮৫) এবং ‘চন্দ্রকেতুগড়-এ আবিষ্কৃত সুঙ্গ যুগের (খ্রি. পূর্ব ১৮৫-৭১) টেরাকোটা ফলকচিত্রগুলো এবং ময়নামতির গুপ্ত পরবর্তী (খ্রি. পূর্ব ৬ষ্ঠ-৭ম খ্রি.) এবং পাহাড়পুরের প্রাথমিক পালযুগের (৮ম-৯ম খ্রি.) পোড়ামাটির ফলকগুলোকে বিবেচনা করা চলে। এ ছবিগুলোতে ফুল-পাতা, পশু-পাখি, নর-নারী, দেব-দেবী এবং তাতে কাল্পনিক গল্পগাথাও ছিল। চিত্রগুলো উচ্চ শিল্পবোধ সম্পূর্ণ না হলেও তাদে প্রতিফলিত হয়েছে বাংলার লোকজ জীবনের বলিষ্ঠ প্রকাশ ভঙ্গি। এর পর বাংলায় এক সংস্কৃতির উদ্ভাব ঘটে। এর অনুপ্রেরণায় সতের ও আঠার শতকের প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত বিষ্ণপুর ও অন্যান্য জায়গায় বাংলার একক নিজস্ব চিত্রকলা বিকাশ লাভ করে। এ সময়ে চিত্রাঙ্গিক কাগজে আঁকা ‘জড়ানোট’ এবং ‘পাটচিত্র’কে স্বতন্ত্র চিত্রকলার উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়। আলিবর্দী খানের আমলে (১৭৪০-১৭৫০) মুঘল চিত্রশৈলী প্রভাবিত ‘মুর্শিদাবাদ চিত্ররীতি’ নামে একটি স্বতন্ত্র চিত্রকলার জন্ম হয়েছিল। ‘পরবর্তীতে উপনিবেশিক অর্থনীতির সহায়ক শক্তি হিসেবে শিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার লক্ষ্যে এখানে পাশ্চাত্যের আদলে ‘আর্ট-স্কুল’ প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ভারতীয় শিল্পীদের প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঐতিহ্য ছিল না, শিল্পকলা ছিল বশানুক্রমিক কৌলিক শিক্ষার অংশ। ভারতে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারত শিল্পে বৈশিষ্ট্যগত এবং শ্রেণীগত পালাবদলের সূচনা ঘটে। এভাবে বাংলা তথা ভারতবর্ষের শিল্পকলার ইতিহাসের প্রাচীন ও মধ্যযুগের অবসান ঘটে এবং আধুনিকতার সূচনা হয়। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় প্রথম চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ঢাকায় আধুনিক চিত্রকলার যাত্রা শুরু হয়। একটি ধর্মভিত্তিক নব্য স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থতায় একটি চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা করা ছিলো বিপ্লবাত্মক ঘটনা। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ছিলেন তরুণ খ্যাতিমান শিল্পী জয়নুল আবেদীন। তাঁর সহযোগীদের অদম্য উৎসাহ স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাহায্য করেছিল। বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. মহম্মদ কুদরতে-এ-খুদা, আমলা সলিমুল্লাহ ফাহমী প্রমুখ উদার মনারা এ কাজে তাঁরে সাহায্যের হাত বারিয়ে দেন। চারুকলা প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পরে কামরুল হাসানের উদ্যোগে এবং জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে সরকারী পর্যায়ে চারুকলার শিক্ষা কার্যক্রমের সমান্তর এক আন্দোলন শুরু হয়। ‘ঢাকা আর্ট গ্রুপ’ নামের সংগঠনটি ছিল এ আন্দোলনের অগ্রভাগে। শিক্ষাবিদ, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা এ আন্দোলনে সংযুক্ত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যাদের দ্বারা সৃজনশীল চিত্রকলার চর্চা সূচিত হয়েছিল তাঁদের মধ্যে অগ্রভাগে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং তাঁর সারথীরা হলেন- সফিউদ্দিন আহমেদ, কামরুল হাসান এবং শেখ মোহাম্মদ সুলতান। তাঁদের সৃজনশীলতা বাংলাদেশের চিত্রকলায় নতুন যুগের সূচনা ঘটে। চল্লিশের দশকের চিত্রশিল্পীদের সাধারণ ঐক্য সূত্রটি ছিল দেশীয় প্রকৃতি এবং জনজীবন। যা শিল্পীদের তুলির পরশে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত বাঙালী এবং বাংলাদেশের চিত্রকলার পথিকৃৎ জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-১৯৭৬) প্রাকৃতিক পরিবেশের এক রোমান্টিক রূপকার হিসেবে সমধিক পরিচিত। একজন বিশ^স্ত নিস্বর্গ শিল্পীকে বাংলার দুর্ভিক্ষ বিদ্রোহী ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করে। ১৯৪৩-এর বাংলার মন্বন্তরভিত্তিক চিত্রমালা তাঁকে ভারত তথা বিশ^ব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়। দুর্ভিক্ষের সকরুণ মানব ট্র্যাজেডির তাৎক্ষণিক সহানুভূতিপূর্ণ ও সফল রূপায়ণ হিসেবে তাঁর ছবিগুলো বহির্বিশে^ শিল্পী রসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দুর্ভিক্ষের স্কেচে, কেবল তুলির কালো রেখায় যার সূচনা সেটাকে বর্ণ প্রয়োগের ন্যূনতায় ও স্পেস ব্যবহারের মাধ্যমে পরিমিতিবোধে তিনি ক্রমশ এক নিজস্ব শৈলীতে রূপান্তর করতে সক্ষম হন। এই সময়ে তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলো, ‘বিদ্রোহী’, ‘মই দেয়া’, ‘সাঁওতাল যুগল’, ‘সংগ্রাম’ এবং লোকশৈলীর মর্টিফে জ্যামিতিক বিন্যাসে সন্নিবেশিত চিত্রগুলো ‘পাইন্যার মা’, ‘প্রসাধন’ এবং ‘গুণটানা’। সত্তরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে মারাত্মক বিপর্যস্ত মানুষের অসহায়তাকে অবলম্বন করে তাঁর রং তুলিতে চিত্রিত হয়েছে ‘মনপুরা ৭০’। মনপুরা ৭০ বাংলায় সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ে চিত্র বিশ^বাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছে। বিখ্যাত হয়েছেন জয়নুল আবেদীন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাঁর আঁকা ‘নবান্ন’ চিত্রকর্মটি এবং এই চিত্রকর্মটি তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যায়। সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষাপট, রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণ, মানুষের অন্তর্নিহিত অনুভূতি, সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া শিল্পীকে তাড়িত করে। মানুষের জীবনকে তিনি তুলির পরশে শিল্পে ফ্রেমবন্দী করেছেন। তাই সমকালীন চিন্তা-চেতনা ও সমাজব্যবস্থা জীবন্ত হয়েছে জয়নুলের শিল্পকর্মে। বাংলাদেশে আধুনিক ছাপচিত্রের জনক ও আধুনিক চিত্রকলা আন্দোলনের পুরোধা সফিউদ্দিন আহামেদ। তিনি ছাপচিত্রের পাশাপাশি জলরং ও তেলরঙের কাজে দক্ষতার পরিচয় দেন। বিগত সাত দশক তিনি বাংলাদেশের চারুকলা জগতকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব চিত্র তাঁর চিত্রকলায় ফুটে উঠেছে। চল্লিশের দশকে কলকাতার আর্ট কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাপশিল্পে দক্ষতা অর্জন করেন। দুই বাংলার রং ছিল তাঁর কাছে ভিন্ন। পশ্চিম বাংলার ধূসরতা এবং বাংলাদেশের নীলাভ সবুজের ছড়াছড়িকে মিশিয়ে নিয়েছেন। তাঁর ছাপশিল্পের সৃজনশীলতার স্বাক্ষর হচ্ছে, ‘বনের পথে’, ‘সাঁওতাল বালা’, ‘ঘরে ফেরা’ প্রাথমিক পর্বের উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, জল, মাছ, নৌকা এবং প্রতীকায়িত চোখ তাঁর সৃষ্টিকর্মের বিষয়াদি। ক্রমশ তিনি আধা বিমূর্ত জ্যামিতিকায়নের দিকে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং বাঙালীর লোককলার মটিফকে চিত্রতলে অন্তর্ভুক্ত করতে প্রয়াসী হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়ার মুখের ছবি দিয়ে আঁকা ‘এ জানোয়ারদের হত্যা করতে হরে’ পোস্টারটি বিখ্যাত হয়েছিল। যার চিত্রকর ছিলেন কামরুল হাসান (১৯২১-১৯৮৮)। কামরুল হাসানের চিত্রকলার বিষয়াদি নর-নারী (বিশেষত রমণীর শরীর), পশু-পাখি (প্রধানত গুরু ও শৃগাল), সাপ ও প্রকৃতি। এসবের মধ্যে তিনি আবহমান বাংলার গ্রামীণ সমাজের সামগ্রিক রূপ, বাংলার নিস্বর্গ, স্বৈরশাসকদের অত্যাচার, শোষণ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর গণহত্যার বরবরতার চিত্র তুলে ধরেছেন। তাঁর চিত্রকর্ম ষাটের দশকে বাঙালী জাতি সত্তার বিকাশের আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন মানুষকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করে। তিনি তাঁর চিত্রকর্মে আধুনিক ও লৌকিক রীতির মিশ্রণ ঘটিয়ে নিজস্ব শৈলীর সৃষ্টি করেন। লোকজ চিত্রকলা, পুতুল, ভাস্কর্য, কারুকলা ইত্যাদিতে তাঁর আগ্রহ এবং শিল্প চর্চায় এদের অনুপ্রেরণা প্রভাব লক্ষণীয়। তাঁর ছবিতে নারীর দেহ পুতুলের মতো ভরাট, গ্রীবা দীর্ঘ ও চোখ-নাক লৌকিক আদলে আবদ্ধ। ‘তিনকন্যা’, ‘গুণটানা’ আধুনিক ও লৌকিক রীতির সংমিশ্রণের শ্রেষ্ঠ কর্ম। শেকড় সন্ধানী সলুতান যিনি চিত্রকলার আধুনিকতার একটি নিজস্ব সংজ্ঞা গ্রহণ করেছিলেন। গ্রামীণ জীবন, কৃষি, কৃষক, নারী ও মৃত্তিকাসংলগ্ন মানুষের জীবনবোধ এবং শ্রেণি দ্বন্দ্ব, গ্রামীণ অর্থনীতির সামগ্রিক বাস্তবতা তাঁর চিত্রকর্মের বিষয়। বাঙালীর দ্রোহ ও প্রতিবাদ, বিপ্লব ও সংগ্রাম এবং নানা প্রতিকূলতায় কিভাবে টিকে থাকা যায়- সে বিষয় তিনি চিত্রকর্মে ধারণ করেছন। গ্রামীণ কৃষকদের জীর্ণশীর্ণ শারীরিক অবস্থা, শোষণ এবং মানুষের নিম্ন অবস্থান থেকে উত্তরণের চেষ্টা তাঁর শিল্পকর্মে প্রাণ প্রাচুর্য পেয়েছে। তিনি কৃষকদের শরীরকে করেছেন পেশিবহুল ও বলশীল । কৃষক রমণীর শরীরকে করেছেন সুডৌল ও সুঠাম গড়নের। নারীর প্রতিকৃতিতে দিয়েছেন যুগপথ লাবণ্য ও শক্তি। সৈয়দ মনজুরুর ইসলাম বলেন, ‘এস এম সুলতানের শিল্প সাধনায় অবয়ব ধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করার চেষ্টা করেনি। তাঁর আধুনিকতার মানে ছিল সাধারণ মানুষের জীবনের শাশ^ত বোধ ও শেকড়ের শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, মানুষের ভেতরে শক্তির উত্থানই তাঁর কাজে প্রাধান্য পেয়েছে। এটাই ছিল তাঁর নিজস্ব আধুনিকতা অর্থাৎ তিনি ইউরোকেন্দ্রিক, নগর নির্ভর, যান্ত্রিকতা আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পদের মতো কর্মবিশ^কে’। তাঁর শিল্পকর্মের পরতে পরতে দেশপ্রেম, সাধারণ মানুষকে নিয়ে অহঙ্কার, ভালবাসা, মমত্ববোধ প্রকাশ পেয়েছে। সমাজের নানা অসঙ্গতি, অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদ, মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন তাঁর তুলির পরশে বিশাল ক্যানভাসে রূপায়িত হয়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কোন কিছু তাঁর শৈল্পিক চোখ এড়ায়নি। তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্ম হলো- জমি কর্ষণ-১, জমি কর্ষণ-২, হত্যাযজ্ঞ, মাছকাটা, জমি কর্ষণের যাত্রা-১ এবং ২, যাত্রা, ধান মাড়াই, গাঁতায় কৃষক, প্রথম বৃক্ষরোপণ, চরদখল, পৃথিবীর মানচিত্র ইত্যাদি। তাঁর সৃষ্টিকর্মের জন্য দেশবিদেশে সম্মানিত হয়েছেন। বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ মোহাম্মদ কিবরিয়া। মাটি ও মানুষের নিবিড় সান্নিধ্যে থেকে অসাধরণ ছবি এঁকেছেন। তাঁর শিল্প জীবনে বিভিন্ন সময় তাঁর চিত্রকর্মে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা লক্ষ্য করা যায়। ৭০-এর দশকের ‘ছাই’ শিরোনামের চিত্রগুলোতে ক্রুশের মতো কম্পোজিশন, বর্গাকার ক্ষেত্রের মধ্যে পাথুরের বুনট এবং তারে শরীরে ছড়ানো ছেড়া কাঁটার মতো স্টেকচার এক দম বন্ধ করার অনুভূতির জন্ম দেয়। ৮০-এর দশকের চিত্রে বর্গক্ষেত্রগুলো মিলিয়ে গিয়ে অসমান, অনির্ধারিত জমিনে রূপ নিতে থাকে। লাল, নীল, কালো, ধূসর, শ্যাওলা, সবুজ, বাদামি রঙেরা ক্যাভাসে হয়ে ভাঙ্গন-জর্জর দেয়ালের মতো করে তোলে ছবির নানা তল। ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি স্পেস বড় ভূমিকা নেয় ‘শিরোনামহীন’ শিরোনামের সাদা রঙের ছবি দুইটি। ২০০২ সালের চিত্রে ক্যানভাসে জুড়ে দেয়া হয় ছেঁড়া কাগজ, পোড়ানো কাপড় অথবা মরচে ধরা টিন তাদের ভৌত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে চিত্রে আনে ভিন্ন ডাইমেশন। তিনি তার ভাবনাগুলো প্রকাশ করেছেন মাটির রংগুলো ব্যবহার করে। প্রকৃতির ভেতর সুর, সম্পন্দন আর মানুষের বোধ-অনুভূতিকে সম্পূর্ণ এক বিমূর্ত শিল্প ভাষায় অন্বেষণ করেছেন জীবনব্যাপী। প্রচ্ছদ শিল্পের পথিকৃৎ কাইয়ুম চৌধুরী তেল রং, জলরং, কালি- কলম, মোম রং রেশম ছাপ ইত্যাদি নানা মাধ্যমে কাজ করে চিত্রকলায় তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর ছবি আঁকার প্রবণতায় জ্যামিতিক আকৃতির অনুষঙ্গ ছিল। নকশা প্রধানই ছিলো তার ছবি এবং বর্ণিল পটভূতিতে মোটাদাগের নকশা তার প্রধানতম অঙ্কনশৈলী। কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রাবলী বর্ণোজ্জ্বল। আঁরি মাতিসের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি লাল, নীল ও সবুজ এই তিনটি রং খুব বেশি বেশি ব্যবহার করতেন। এই বর্ণভঙ্গী তাঁর চিত্রবালীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। বর্গাকার ক্যানভাসে দেশের লোকশিল্পের স্বরূপ তার শিল্পকর্মে স্থান পেয়েছে। পুতুল, পাখা, হাঁড়ি, শীতল পাটি, কাঁথা ইত্যাদি তিনি অনুষঙ্গ হিসেবে নিয়েছে। বাংলার রূপমাধুরীর অলঙ্কারিক শিল্পী হাসেম খান। বাংলার ফুল, পাখি, নিসর্গ, নদ-নদী ও নীল আকাশ তার চিত্রকর্মের মূল বিষয়। প্রচ্ছদ শিল্প, বই নকশাকরণ, ভাস্কর হিসেবে পরিচিত। জলরং ও তেল রঙের ব্যবহার করেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত বাঙালী চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহামেদ। চিত্রকলায় তিনি সংগ্রামী মানুষের প্রতিকৃতি এঁকেছেন। রং-তুলিতে অবিশ্রাম পথচলা ও গতি অনিঃশেষ শক্তির অভিব্যক্তি প্রকাশের সৃজনকর্মে তিনি হয়ে উঠেছেন অনন্য রূপকার। মানুষের মুক্তির জন্য সশরীরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং রং ও তুলির দ্বৈত অস্ত্র সহযোগে যুদ্ধ চালিয়েছেন। বাংলাদেশের বিমূর্ত চিত্রকলার দুর্বোধ্যতার সঙ্গে গাঁট ছাড়া না বেঁধে নির্মাণ করে স্বকীয় চিত্র শৈলী। তার চিত্রকলার ভিত্তিমূলে আছে শারীরিক প্রকাশভঙ্গি। বড় ক্যানভাসের পর্দায় গতিশীল ও পেশিবহুল অতিমানবীয় পুরুষের ছবি আঁকতে পছন্দ করেন। রং ও তুলির স্পর্শে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যথাযথভাবে তার চিত্রকর্মে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। নারীর চিরায়ত কোমলতা, দ্যুতির স্পন্দন, ¯িœগ্ধতা নারী বিষয়ক চিত্রকর্মের উপজীব্য। তাঁর চিত্রকর্ম পরবর্তী প্রজন্মকে গভীরভাবে প্রভাবান্বিত করবে। হামিদুর রহমান ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্রীয়ভাবে ধারণ করে শহীদ মিনার নির্মাণ করতে চেয়েছেন। তিনি তাঁর অঙ্কিত নকশায় অনুভূমিক ও উল্লম্ব আকারের কাঠামোর মাধ্যমে পুরো বাঙালী জাতির পরিচয়কে বের করতে সক্ষম হন। কেন্দ্রীয় কাঠামোর উভয় দিকে চারটি স্তম্বের মাধ্যমে একটি একাত্রিত স্তম্ভের ভারসাম্য এবং সাদৃশ্য রক্ষা করার ব্যবস্থা করেন। প্রকৃত নকশাতে তিনি স্টেইড কাচের মধ্যে হাজার চোখের ন্যায় গঠনও এঁকেছিলেন। যার মধ্যে সূর্যালোক এসে সামনের মর্মরখচিত মেঝেতে ভোর থেকে গোধূলি পর্যন্ত আলোকিত করে রাখবে। হামিদুর রহমান আরও বিখ্যাত সৃজনকর্ম : মাদার এ্যান্ড স্মোক (১৯৭২), ফ্লাওয়ার ইন মাই বডি। রেনেসাঁ পেইন্টারের দৃষ্টি নিয়ে, ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রকরদের মনমানষিকতা এই দুইটা মিলিয়ে ছবি এঁকেছেন বাঙালী চিত্রকর মুর্তজা বশীর। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রজন্মের চিত্রশিল্পী। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘মুর্তজা বশীর বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী’। মুর্তজা বশীর ফ্লোরেন্সের পথে প্রান্তরে দেখা সাধারণ মানুষের ছবি এঁকেছেন। মা ও মেয়ের বাজার করে ফেরার দৃশ্য, এ্যাকর্ডিয়ান বাদক, জিপসির খেলা দেখানো তাঁর চিত্রকলায় স্থান পেয়েছে। চারু শিক্ষা একটি নিময়ের মধ্যে হলেও ক্যানভাসে তিনি একটি নির্দিষ্ট বিষয় আটকে থাকেনি। কল্পনার স্রোতে না ভেসে ছবি এঁকেছেন জীবনে যা দেখেছেন তাকে উপজীব্য করে। সাবাশ বাংলাদেশ, সার্ক ফোয়ারার মতো বিখ্যাত ভাস্কর্যের স্থপতি মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্রশিল্পী নিতুন কু-ু। তিনি শিল্পী কামরুল হাসানের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধের সপক্ষে পোস্টার ডিজাইন ও অন্যান্য নকশা প্রণয়ন করেন। সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি। গ্রাম ও গ্রামের প্রকৃতিকে নির্ভর করে ছবি এঁকেছেন সৈয়দ জাহাঙ্গীর। দেশের সঙ্গে তাঁর যে আত্মিক টান রয়েছে তা তাঁর সৃষ্ট শিল্পকর্ম থেকে অনুভব করা যায়। ১৯৭৩ এবং ১৯৭৫ সালের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এঁকেছেন ‘আত্মার উজ্জীবন’। প্রকৃতি এবং ঋতুর পরিবর্তন ছিল তাঁর চিত্রের বৈশিষ্ট্য। সৈয়দ জাহাঙ্গীর ‘উল্লাস’, ‘ধ্বনি’, ‘অজানা অন্বেষা’-এর মতো শিল্পকর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশের চিত্রকলায় অবদান রাখেন। এদেশের চিত্রকলার আধুনিকতার স্বরূপ অনুসন্ধানে সে সব শিল্পীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তাদের মধ্যে রফিকুন নবী অন্যতম। তিনি সময়ের বৃত্তকে স্বীকার করে তার ভিত্তিতে প্রতিক্রিয়া জানানোর যে ভাষা সেই ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। শৈলী বিনির্মাণে থেকেছেন আত্ম সচেতন। তাঁর মতে, ‘বিষয় বস্তু উপলক্ষ মাত্র। একটা আঙ্গিক হয়তো একটা শৈলী গড়ে তোলার উপলক্ষ্য মাত্র’। জনজীবনের নানা ক্ষেত্রে শিল্পকলাকে কীভাবে প্রয়োগ করা যায় সেই পথ দেখালেন শিল্পী। বাস্তবতা আর সরলীকরণ এর ছন্দে গড়ে উঠল তাঁর চিত্রকর্মের শৈলী। ছবি আঁকার বিষয় হলো মানবতা। তিনি সাধরণ মানুষ ও পরিশ্রমী পল্লী জীবনের বেঁচে থাকার লড়াই, মৎস্যজীবীদের জীবন এসবের মধ্যে এক গণবাদী শিল্পীর নিবিড় পরিচয় তুলে ধরেছে। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘টোকাই’। টোকাই চরিত্রটি সমাজের নানা অসংতির তুলে ধরে। কালিদাস কর্মকার কোলাজ পেইন্টিং এবং ছাপচিত্রে নিজস্ব শিল্পী সত্তার পরিচয় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। লোকজ মোটিফ এবং প্রতীকের মিলবন্ধে গ্রামীণ সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, আঞ্চলিক প্রথা, প্রাচীন জীবনবোধ সর্বোপরি স্বদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস উঠে এসেছে। ১৯৮০ সাল থেকেই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনা বিদ্রƒপাত্মক শৈলীতে প্রকাশ করেছে চিত্রশিল্পী শিশির ভট্টার্যা। তাঁর শিল্পকর্মে রাজনৈতিক প্রতিবাদ, ব্যক্তিগত ও সামাজিক শ্লেষ, ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। পেইন্টিয়ের ক্ষেত্রে চারপাশের প্রতিদিনের ঘটনাগুলো শিশিরে চিত্রপটে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মূর্ত ও বিমূর্ত দুই ধারায়ই অবদান রাখেন বাঙালী চিত্রকর কাজী আব্দুল বাসেত। তিনি ‘ফিশ ওম্যান’ শীর্ষক চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ। পল উইগার্ড, হ্যান্স হফম্যান এবং বাবভিক্টকের মতো বিখ্যাত চিত্রশিল্প দ্বারা প্রকাশবাদী ধারায় প্রভাবিত। নারীর মাতৃ রূপ অঙ্কনে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। ইমপ্রেশনিজম ও কিউবিজমের প্রভাব তাঁর সৃষ্টিকর্মে লক্ষণীয়। জলরং, তেলরং প্যাস্টেল প্রভৃতি মাধ্যমে চিত্রকর্ম সৃষ্টি করেন। উত্তর উপনিবেশিক পর্বে বাংলাদেশের শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা ও মৌলিকতায় রশীদ চৌধুরী অন্যতম।
×