ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রুয়েটের পঞ্চম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রায়োগিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে

প্রকাশিত: ১০:২২, ২ ডিসেম্বর ২০১৯

  বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রায়োগিক শিক্ষার  ওপর জোর দিতে হবে

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি গবেষণা ও হাতে-কলমে শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষা অর্জিত হয় মন্তব্য করে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছে। কাজেই আমাদেরকে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। বাস্তবভিত্তিক এবং প্রায়োগিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি গবেষণা ও হাতে-কলমে শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষা অর্জিত হয়। এজন্য গবেষণা ও ল্যাবরেটরি কর্মের ওপর অধিক মনোনিবেশ করা জরুরী। রবিবার বিকেলে রাজশাহী প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) পঞ্চম সমাবর্তনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। রাষ্ট্রপতি বলেন, বিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে দেশ যতবেশি উন্নত সে দেশ ততবেশি সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ প্রকৌশলী সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, আমাদের বিপুল মানবসম্পদ থাকা সত্ত্বেও কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা কাক্সিক্ষত মাত্রায় অর্জিত না হওয়ায় আমরা আশানুরূপভাবে এগোতে পারিনি। বর্তমান সরকার কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনার আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এযাবতকালের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উন্নয়ন বাজেট প্রদান ও গবেষণা বরাদ্দ প্রদান করা হচ্ছে। বিদ্যমান সুবিধাসমূহের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত উচ্চশিক্ষা প্রদানে ব্রতী হবে বলে আমার বিশ্বাস। সার্টিফিকেট দেয়া এবং শিক্ষার প্রসারই শেষ কথা নয়, উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, আমাদের প্রয়োজন যুগোপযোগী শিক্ষা। বাস্তবভিত্তিক এবং প্রায়োগিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। গুণগত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার সঙ্গে ল্যাবরেটরির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি গবেষণা ও হাতে-কলমে শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষা অর্জিত হয়। এ জন্য গবেষণা ও ল্যাবরেটরি কর্মের ওপর অধিক মনোনিবেশ করা জরুরী। প্রযুক্তি উন্নয়নের বাহন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাই বলে প্রযুক্তির উদ্ভাবনই যথেষ্ট নয়। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও জনগণের উন্নয়ন করার মধ্যেই উদ্ভাবনের সার্থকতা। তাই যুগোপযোগী ও লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সকলকে মনোনিবেশ করতে হবে । জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও আহ্বানে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা এ স্বাধীনতা অর্জন করি। বঙ্গবন্ধু সবসময় রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাই তো তিনি স্বাধীনতার পর পরই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের পাশাপাশি বৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে আজ আমরা মহাকাশেও নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছি। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত। এই যে আমাদের সামনে বিশাল কর্মযজ্ঞ, তা বাস্তবায়নে দক্ষ প্রকৌশলীর প্রয়োজন। অবকাঠামো থেকে শুরু করে শিল্প-কলকারখানা, বিদ্যুত, টেলিযোগাযোগ, মেরিন, তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা, প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রকৌশলীদের ভূমিকা অনন্য। বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তা বাস্তবায়নে প্রধান কারিগর হচ্ছে প্রকৌশলীরা। সুতরাং প্রকৌশলীদের স্ব স্ব দক্ষতা অর্জন করে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে হবে। সনদপ্রাপ্ত প্রকৌশলীদের সম্বোধন করে তিনি বলেন, তোমরাই আজকের অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। তোমরা যে বিপুল স্বপ্ন নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়েছিলে আজ তা পাখা মেলতে শুরু করেছে। তোমাদের স্বপ্নের পাখা আজ দিগন্ত বিস্তৃত। অর্জিত জ্ঞানের পাখায় ভর করে তোমরা দেশ গড়ার কাজে ব্রতী হবে, দেশবাসী তা প্রত্যাশা করে। এই দেশ তোমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে রাখতে হবে, এ দেশ, এদেশের জনগণ তোমাদের এতদিন দিয়ে এসেছে। তাদের করের অর্থেই তোমরা আজ গ্র্যাজুয়েট ও জাতির কাছে ঋণী। তোমাদের মেধা, কর্ম ও মনন দিয়ে সে ঋণ শোধ করতে হবে। গ্র্যাজুয়েটদের উপদেশ দিয়ে আচার্য বলেন, সততা মানুষ জীবনের একটি মূল্যবান সম্পদ। কর্মজীবনে তোমরা সৎ পথে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাবে। তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতীকে উল্লেখ আছে ‘ঐশী জ্যোতিই আমাদের পথ প্রদর্শক’। প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর আবু মহসিন আহমেদ সততার পরাকাষ্ঠার প্রতীক হিসেবে এই কথা সংযোজন করেছিলেন। তার শুভ ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমিও চাই অশুভ হাতছানি যেন কখনই তোমাদের বিবেককে ধ্বংস করতে না পারে। আচার্য আবদুল হামিদ বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে মাথায় রেখে ন্যানো টেকনোলজি, রোবোটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো বিষয়গুলোকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা যাতে দেশের কল্যাণে, মানবতার কল্যাণে, ব্যবহৃত হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলে উদ্যোগী হবেন বলে আমার বিশ্বাস। প্রযুক্তি উন্নয়নের বাহন, তাই বলে প্রযুক্তির উদ্ভাবনই যথেষ্ট নয়। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও জনগণের উন্নয়ন করার মধ্যেই উদ্ভাবনের সার্থকতা। অন্যের অনুকরণ নয় বরং আমাদেরকে যাতে অন্যরা অনুকরণ করতে পারে সে লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, কেবল চ্যান্সেলর হিসেবে নয়, আমি তোমাদের গুরুজন হিসেবে বলতে চাই, উচ্চ শিক্ষা শেষে শুধু একটা ভাল চাকরি পাওয়াই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজে শিক্ষিত হওয়া ও অন্যকে শিক্ষিত করা এবং বৃহৎ মানবতার কল্যাণ করা। তাই ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধে উঠে মানবসত্তা দিয়ে দেশকে আলোকিত করবে, বিশ্বকেও সে আলোর আভায় রাঙিয়ে তুলবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে তোমরা সমাজের সকল অন্ধকার দূর করে আলোর পথে এগিয়ে যাও। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, কচু ছাড়া সব কিছুতেই ফরমালিন, নির্ভেজাল খাবার দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। খাদ্য ভেজালের কারণে ক্যান্সারসহ জটিল রোগ হচ্ছে। কিছু মানুষ দানব হয়ে যাচ্ছে। এ থেকে মানুষকে ফেরাতে হবে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগে শুধু পকেট মারলেই গণপিটুনি দেয়া হতো, এখন খাদ্যে ভেজালকারী মানুষকেও গণপিটুনি দিতে হবে। মানুষকে এ পথ থেকে ফেরাতে হবে। নইলে জাতি হিসেবে আমরা পঙ্গু হয়ে যাব। এর আগে দুপুর আড়াইটায় সমাবর্তন শোভাযাত্রা সহকারে রাষ্ট্রপতি সমাবর্তনের অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করেন। সেখানে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন ও পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ থেকে পাঠের পর রাষ্ট্রপতি সমাবর্তন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এরপরে ডিগ্রী উপস্থাপন ও প্রদান পর্ব, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পিএইচডি ডিগ্রী প্রাপ্তদের সনদপত্র প্রদান, বিশেষ অতিথির বক্তব্য, সমাবর্তন বক্তার বক্তব্য, সমাবর্তন স্মারক প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক রফিকুল আলম সেখ। এবারের সমাবর্তন বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াটেক এ্যাডভান্সড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সাইফুর রহমান। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক এম. আব্দুস সোবহান, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ছাদেকুল আরেফিন মাতিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এবার রুয়েটের পঞ্চম সমাবর্তনে অংশ নিতে ২ হাজার ৫৮৬ জন গ্র্যাজুয়েট নিবন্ধন করেন। এর মধ্যে ২ হাজার ৫১৬ জন স্নাতক ডিগ্রীধারী এবং ৭০ জন পিএইচডি গবেষকসহ স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারী ইঞ্জিনিয়ার।
×