ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফিরে দেখা

বারো ঘণ্টার বিভীষিকা

প্রকাশিত: ১০:৫০, ২৮ নভেম্বর ২০১৯

বারো ঘণ্টার বিভীষিকা

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ২০১৬ সালের ১ জুলাই। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার। রমজানও শেষের দিকে। সবাই ঈদের কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত। সব মিলিয়ে ঈদের আমেজে ছিল ঢাকাবাসী। ইফতার পর্যন্ত সবকিছুই চলে স্বাভাবিক। রাত সোয়া আটটার দিকে হঠাৎ গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় শুরু হয় জঙ্গীদের গুলি। খবর পেয়ে এগিয়ে যায় পুলিশ। বাধার মুখে পড়ে প্রথমে তারা পিছু হটে। এ সময় জঙ্গীদের ছোড়া গ্রেনেডে প্রাণ হারান দুই পুলিশ কর্মকর্তা। রাত যতই বাড়তে থাকে জঙ্গীদের নৃশংসতাও ততই বাড়তে থাকে। তাদের বেয়োনেটের আঘাতে ছিদ্র হতে থাকে অসহায় ও নিরীহ নারী-পুুরুষের শরীর। ঝাঁঝড়া হয়ে যায় তাদের বুক। কারও কারও প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ে হলি আর্টিজানের মেঝেয়, কারও দেহ টেবিলের ওপর, কারওবা সিঁড়িতে। রাতটি নানা শঙ্কায় কাটলেও সকাল হওয়ার আগেই সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডোদের ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ শেষ হলে একে একে মরদেহ বের করতে থাকে পুলিশ। সেদিনের বর্বরোচিত হামলায় ১৭ বিদেশীসহ নিহত হন ২২। তাদের মধ্যে দুই পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। জঙ্গীদের গুলি ও বোমায় আহত হন পুলিশের অনেকে। ওই রাতে অভিজাত গুলশানের হলি আর্টিজানে ঘটে ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ। পরদিন ২ জুলাই সকালে সেনা কমান্ডোদের উদ্ধার অভিযানে পাঁচ জঙ্গী ও রেস্তরাঁর একজন পাচক নিহত হয়। ১২ ঘণ্টার এই কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় শ্বাসরুদ্ধকর জিম্মি নাটক। রেস্তরাঁর আটক আরেক কর্মী জাকির হোসেন শাওন পরে হাসপাতালে মারা যান। তিন বছর আগের ওই হামলার ঘটনায় বুধবার দুপুরে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাতজনের ফাঁসি হয়েছে। খালাস পেয়েছে একজন। বীভৎস-ভয়াল ওই রাতের দশ ঘণ্টা বিভীষিকাময় ঘটনাপ্রবাহ ছিল এমন : ১ জুলাই : সন্ধ্যায় প্রথম খবর পাওয়া যায় গুলশানে পুলিশের সঙ্গে জঙ্গীদের গোলাগুলি চলছে। তখনও ধারণা করা যায়নি আসলে কী ঘটছে। রাত সাড়ে আটটায় হলি আর্টিজান রেস্তরাঁর ভেতর থেকে জঙ্গীদের ছোড়া গ্রেনেড হামলায় দুই পুলিশ অফিসারসহ ৬ জন আহত হন। রাত ৯টায় খবর পাওয়া যায় গোলাগুলির ঘটনায় গুলশানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে, রাত দশটায় খবর আসে ঘটনার ভয়াবহতা। জঙ্গী রেস্তরাঁয় থেকে গ্রেনেড হামলা চালাচ্ছে, গোলাগুলি করছে। তাদের গ্রেনেড ও গুলিতে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিনের নিহত হওয়ার খবর আসে। এরই মধ্যেই পরিষ্কার হতে থাকে ওখানে বড় ধরনের একটি জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটছে। হলি আর্টিজানে দেশী-বিদেশী বেশকিছু মানুষ খেতে এসেছিলেন, দুর্বৃত্তরা তাদের জিম্মি করেছে। রাত এগারোটায় র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ জানান, জঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা করে শান্তিপূর্ণ সমাধান চান তিনি, রাত সাড়ে এগারোটায় রেস্তরাঁয় পরিবারের চার সদস্যসহ আটকাপড়া ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ করিম তার চাচা আনোয়ার হোসেনকে ফোন করে জানান, পুলিশকে অনুরোধ করুন ভেতরে যেন গুলি না চালায়। গুলি চালালে তারা (জঙ্গীরা) আমাদের মেরে ফেলবে, রাত বারোটায় : ওসি সালাউদ্দিনের পর মৃত্যুর খবর আসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামের, সাড়ে বারোটায় জিম্মি করে রাখার বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর মার্কিন নাগরিকদের নিরাপদে থাকার পরামর্শ দেয় দূতাবাস, রাত একটায় : জিম্মিদশা থেকেই ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসে একজন লেখেন- সবাই দোয়া করুন, জানি না বাঁচমু না মইরা যামু’, রাত একটা ১০ মিনিটে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর চোখও ততক্ষণে বাংলাদেশের দিকে। কূটনৈতিক জোনে হামলার ওই ঘটনা ব্রেকিং নিউজের পাশাপাশি লাইভ টেলিকাস্টও শুরু করে তারা। এ সময় এক টুইট বার্তায় হামলার দায় স্বীকার করে আল-কায়দার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার (একিউআইএস) সংগঠন আনসার আল ইসলাম। রাত দেড়টায় : সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়, রাত পৌনে দুটোয় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করা হয়। আনসার আল ইসলামের পর হামলার দায় স্বীকার করে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। সাইট ইন্টেলিজেন্সের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম খবর দেয়, রাত দুটোয় : সেনাবাহিনী, র‌্যাব, বিজিবি, ডিবি, সোয়াত, সিআইডি, ফায়ার ব্রিগেড ও পুলিশ অবস্থান নিলেও জিম্মি উদ্ধারে কীভাবে অভিযান পরিচালিত হবে সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছিল। পরে জিম্মি উদ্ধারে ব্যাপক নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে সিলেট থেকে রওনা দেয় সেনাবাহিনীর কমান্ডো টিম, শনিবার ভোর সাড়ে পাঁচটায় সিলেট থেকে গুলশানে পৌঁছায় সেনা কমান্ডো টিম। সকাল সাতটা ৫০ মিনিটের দিকে জিম্মি উদ্ধারে শুরু হয় ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ মুহুর্মুহু গুলি-বিস্ফোরণের শব্দে প্রকম্পিত তখন হলি আর্টিজান এলাকা। সকাল পৌনে নয়টায় : ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটির ডিসি জসিম উদ্দিন জানান, একজন একজন করে জিম্মিদের উদ্ধার করা হচ্ছে। এ সময় অভিযান শেষ হওয়ার কথা জানান র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মিজানুর রহমান। শনিবার দুপুরে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, সমন্বিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ছয় সন্ত্রাসী নিহত ও একজনকে জীবিত গ্রেফতার করা হয়েছে। দুপুর দেড়টার দিকে সেনাসদর দফতরে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে সেনা কর্মকর্তা নাইম আশরাফ চৌধুরী বলেন, জিম্মিদের উদ্ধারে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ শুরুর আগেই ২০ জনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর রেস্তরাঁয় অংশ নেয়া নিহত পাঁচ বন্দুকধারীর ছবি প্রকাশ করে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স। পরে ভয়াবহ ওই হামলার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিহতদের স্মরণে দুদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন তিনি।
×