ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

প্রদর্শনী ॥ ফিলিং দ্যা ভয়েড

প্রকাশিত: ১৩:২১, ২৫ অক্টোবর ২০১৯

প্রদর্শনী ॥ ফিলিং দ্যা ভয়েড

কর্মই যাকে চির তারুণ্যের মাঝে আবদ্ধ করে রেখেছে তিনি বর্তমান সময়ের আধুনিক ভাবধারার বহুমাত্রিক শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। বয়স যত বাড়ছে তাঁর কাজও যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আমার তো মনে হয় হামিদুজ্জামান খান এই বয়সে এসেও যে পরিমাণ কাজের রেসে থাকেন তাঁর সঙ্গে এই রেসে পাল্লা দেয়াটা আজকের যে কোন তরুণ শিল্পীর জন্যও এক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কাজের ক্ষেত্রে যেন কোন ক্লান্তি নেই; বিরামহীন কাজ করে চলেছেন এই শিল্পী। প্রতিদিন তাঁর স্টুডিওতে রুটিন করে কাজ করাটাকে যেন তিনি এক উপাসনা মনে করেন। অন্যদিকে বিভিন্ন আর্ট ক্যাম্পে অংশগ্রহণ, দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ এবং প্রায় প্রতি বছর এক বা একাধিক একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী করা তাঁর নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর বয়সী বা সমসাময়িক কোন শিল্পীকে আমাদের বর্তমান সময়ের শিল্প ভুবনে এতটা অংশগ্রহণমূলক সচরাচর খুব কমই চোখে পড়ে। গত ১১ অক্টোবর শুক্রবার লালমাটিয়ার দ্বীপ গ্যালারিতে প্রায় অর্ধশতাধিক শিল্পকর্ম নিয়ে ‘ফিলিং দ্যা ভয়েড’ শিরোনামে তাঁর একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। প্রতি সপ্তাহের সোমবার ছাড়া যে কোন দিন বেলা তিনটা থেকে রাত নয়টার মধ্যে আগামী ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত প্রদর্শনীটি দেখা যাবে। অতীতে আমরা হামিদুজ্জামান খানের অনেক বড় ক্যানভাসে বড়বড় কাজ দেখেছি। কিন্তু দ্বীপ গ্যালারির পরিসর বিবেচনায় অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির কাজ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। এতে অনুমান করা যায় যে এই প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে তাঁকে একটি আলাদা প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। শিল্পকর্মগুলো ক্ষুদ্রাকৃতির হলেও কাজের আবেদন আমাদের কাছে এক বিশালতাকে উপস্থাপন করেছে। হামিদুজ্জামান খানের কথা মনে পড়লে একজন আধুনিক ভাস্কর্য শিল্পীকে আমরা চোখের সামনে দেখতে পাই। কিন্তু আদতে তিনি ভাস্কর্য, চিত্রকর্ম ও স্থাপনা শিল্পের এক বহুমাত্রিক শিল্পী। এই প্রদর্শনীতে একটি স্থাপনা শিল্প বা ইনস্টলেশন, কয়েকটি ভাস্কর্য এবং বেশিরভাগই চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে। গ্যালারিতে প্রবেশ করেই হাতের বাম পাশের দেয়ালে প্রাচীন লিপির আদলে কিছু শিল্পকর্মের মাধ্যমে গড়া একটি স্থাপনা শিল্প বা ইনস্টলেশন চোখে পড়ে। প্রাচীনকালে মানুষ এরূপ শিলালিপির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করত। শিল্পী কাঠ দিয়ে তৈরি এই লিপি আদলের শিল্পকর্মের মাধ্যমে তাঁর দীর্ঘদিনের চর্চিত জীবনের ভাব প্রকাশ করতে চেয়েছেন। স্থাপনা শিল্প এমন একটি বিষয় যেটি একটি পরিবেশ বা আবহ তৈরি করে। হতে পারে স্থায়ী বা অস্থায়ী। গ্যালারির দেয়ালে স্থাপিত এই অস্থায়ী স্থাপনা শিল্পটিও প্রদর্শনীতে একটি সুন্দর আবহ তৈরি করেছে। কেবল কাঠের ব্যবহারই নয়; ব্রোঞ্জ ও মার্বেল দিয়ে তৈরি বেশ কিছু ভাস্কর্যও চোখে পড়বে প্রদর্শনীতে। জল রং ও এ্যাক্রিলিক মাধ্যমে করা শিল্পীর কয়েকটি সিরিজ চিত্রকর্মে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমরা দেখতে পাই। প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিকতাসহ জীবনের নানা অনুষঙ্গ ফুটে উঠেছে চিত্রকর্মগুলোতে। যেমন ‘ফেস’ বা মুখ সিরিজের চিত্রকর্মগুলোতে নানা রূপ ও রঙের মুখাবয়ব দেখতে পাওয়া যায়। কোনটা স্পষ্ট আবার কোনটা অস্পষ্ট। কোন কোন মুখাবয়বে আলো খেলে যায়। আবার কোনটা মলিন। এমনটা কেন এঁকেছেন শিল্পী? প্রশ্ন জাগে মনে। কোন কোন মানব মুখ দেখলেই তার ভেতরটাও খানিকটা পড়ে ফেলা যায় এমন ধারণা থেকেই হয়ত স্পষ্ট মুখাবয়বের ভাবনা। আবার কোন মানব মুখে তার ভেতরের কিচ্ছু পড়া যায় না এমন ধারণা থেকেই হয়ত অস্পষ্ট মুখাবয়ব। অন্যদিকে পৃথিবীর কোন মানুুষের মুখের সঙ্গে অপর কোন মাানুষের মিল নেই সেটিও মনে হয় শিল্পী মনে উকি দিয়েছে। ‘রেইন’ বা বৃষ্টি সিরিজের চিত্রকর্মগুলোতে বৃষ্টির নানা রূপ ও রং ফুটে উঠেছে। আমাদের ঋতু বৈচিত্র্যের এক অন্যতম সময় বর্ষা। বৃষ্টির মাধ্যমে নানা রূপে আবির্ভূত হয় বর্ষা। বৃষ্টি নিয়ে গান, কবিতা, গল্প, সিনেমা, নাটক শিল্পের নানা অনুষঙ্গ রচিত হয়েছে। চিত্রকর্মও হয়েছে বিস্তর। শিল্পী এখানে তাঁর আপন অনুভবের বৃষ্টির চিত্র উপস্থাপন করেছেন। দিগন্তজোড়া বর্ষার মাঠের বৃষ্টি, টিনের চালার টাপুর-টুপুর বৃষ্টি, নগর জীবনের বৃষ্টি এমন নানা অনুভবে ভেসে যাওয়া যায় চিত্রকর্মগুলো দেখে। ‘আনভেইলিং’ বা অপাবরণ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলোতে নিসর্গের রং ও রূপ তুলে ধরেছেন বোধ হয়। আবার আলো আঁধারির খেলাও রচিত হয়েছে। পৃথিবীর সবকিছু যে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার তা কিন্তু নয়। কিছু বোধগম্য হয় আবার কিছুটা হয় না। আনভেইলিং ৫ চিত্রকর্মে তেমনটিই মনে হয়েছে। ‘সিকরেট গেইজ’ বা গোপন অনুমান শিরোনামের চিত্রকর্মগুলোতে শিল্পী মনের নানা অব্যক্ত কথা ফুটে উঠেছে। শিল্প রসিকদের অনুমান করে নিতে হবে। ‘আনটাইটেল্ড’ বা শিরোনামহীন চিত্রকর্মগুলোতে আমাদের চারপাশের নানা বিষয় উপস্থাপন করেছেন। ‘সিড’ বা বীজ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে একটি পূর্ব প্রেক্ষাপট ছাড়া সরাসরি কোন কিছুই সৃষ্টি হয় না। পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি হয় তার জন্য একটি বীজ প্রয়োজন হয়। প্রদর্শনীতে পৃথিবীর এতসব জটিল বিষয়বস্তুর মাঝে ‘মিটিং অব মাইন্ডস’ বা মনের সভা শিরোনামের একটি চিত্রকর্মে একজোড়া মানব-মানবীর মুখাবয়ব আপনাকে খানিকটা রোমান্টিক আবহ দেবে। দুটি মনের মিলন ছাড়া বা ভালবাসা ছাড়া পৃথিবীর কোন কিছুই সুখকর নয়। এই চিত্রকর্ম দেখে তেমনটাই অনুভব করা যায়। সময়ের ¯্রােতকে তীব্রভাবে অনুভব করতে পারা বহুমাত্রিক শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। যিনি প্রতিনিয়ত তাঁর কাজ নিয়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিরীক্ষা করে চলেছেন। এই প্রদর্শনীতেও সেটি সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। আর তাঁর শিল্পকর্ম বরাবরই বৈচিত্র্যপূূর্ণ। এই প্রদর্শনীতে সেটিও লক্ষণীয়। দ্বীপ গ্যালারির চলমান প্রদর্শনীতে প্রবেশ করে কোন শিল্পরসিক আশা করা যায় নিরাশ হবেন না। নিঃসন্দেহে একটি ভাললাগা নিয়েই বের হবেন এটি নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়।
×