ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পেঁয়াজের বাজার অস্থির, লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ছে

প্রকাশিত: ১১:০৫, ১ অক্টোবর ২০১৯

পেঁয়াজের বাজার অস্থির, লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পেঁয়াজের দাম এক শ’ টাকা ছাড়াল। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৪০ টাকা। সোমবার পাইকারি বাজারেই বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকা। খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। ক্রেতাদের অভিযোগ, অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে পেঁয়াজের বাজারে আগুন। এমন অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেল পাইকারি ব্যবসায়ীদের কথায়। তারা বলছেন, ভারতের রফতানি বন্ধ ঘোষণার পরই আমদানিকারকরা তাদের দাম বাড়াতে বলেন। তবে বাণিজ্য সচিব জানিয়েছেন, দেশী পেঁয়াজ ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ মিলিয়ে মজুদ সন্তোষজনক রয়েছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। এদিকে বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণ খুঁজতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রধান করে দশটি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। এসব টিম দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজার পর্যবেক্ষণ করবে। একই সঙ্গে আজ মঙ্গলবার থেকে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে খোলাবাজারে বিক্রির জন্য ট্রাকের সংখ্যাও বাড়ানো হবে বলে জানান বাণিজ্য সচিব। জানা যায়, ভারত পেঁয়াজ রফতানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। এ খবরে দেশের বাজারে হু হু করে বেড়ে যায় পেঁয়াজের দাম। রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি বাজারে রবিবার সকাল-সন্ধ্যা ব্যবধানেই দাম বাড়ে ১০-২০ টাকা। পরদিন সোমবার পাইকারি বাজারে দেশী পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা কেজি। ভারত ও মিয়ানমার থেকে আসা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে এক শ’ থেকে ১১০ টাকা দরে। খুচরা বাজারে দেশী আর ভারতীয় পেঁয়াজের দামের কোন ভেদাভেদ নেই। সব পেঁয়াজই এখন কেজিপ্রতি ১২০-১৩০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। সোমবার সকালে কাওরানবাজারে গিয়ে দেখা যায়, পাইকারি বাজারে প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) পেঁয়াজ ৫২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে এক কেজি কিনতে হচ্ছে ১১০ টাকায়। ভারতীয় পেঁয়াজও অনেকটা দেশী পেঁয়াজের মতো দেখতে মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে এক পাল্লা ৪৫০ টাকায়। খুচরা বাজারে দাম কিছুটা বেশি। কাওরানবাজারের মতো রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে রাতারাতি বেড়ে গেছে পেঁয়াজের দাম। এদিকে রাতারাতি এত দাম বেড়েছে কেন জানতে চাইলে কাওরানবাজারের পাইকারি বিক্রেতা আলমগীর হোসেন জানান, রবিবার দুপুরের পরও প্রতি কেজি দেশী পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন ৭২ টাকায়। সন্ধ্যায় তিনি ৯০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছেন। সোমবার সকাল থেকে তিনি ১১৫ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, দুপুরের পর থেকেই কেনা দাম বেশি পড়ছে। ফলে বিক্রিও বেশি দামে করতে হচ্ছে। মিরপুরের ৬ নম্বর বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা কবির আহমেদ নামে এক ক্রেতা জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিদিনই পেঁয়াজ লাগে। রবিবার রাতে শুনলাম ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করেছে। পেঁয়াজের দাম বাড়তে পারে। কিন্তু একদিনে এত বাড়বে? আজ দেশী পেঁয়াজ ১৩০ টাকা চাচ্ছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ৪০ টাকা দাম বেড়ে গেল- একদিনে কেন এত বাড়ল? সরকার কেন এর তদারকি করে না? তিনি বলেন, কোন পণ্যের দাম বাড়লে খরচ বাড়ে আমাদের। কিন্তু আমাদের তো বাড়তি আয় নেই। তাই পণ্যের দাম বাড়লে বিপাকে পড়ি আমরা সাধারণ ভোক্তারা। আমাদের দেখারও কেউ নেই। মুগদার মুদি দোকানি আল আমিন জানান, গত কয়েক সপ্তাহ দেশী পেঁয়াজের কেজি ৮০ টাকা ও ভারতের পেঁয়াজ ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি করেছি। কিন্তু রবিবার শ্যামবাজারে পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে দেখি, সেখানেই বিক্রি করছে ৮০ টাকা। ভারতের রফতানি বন্ধের খবরে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, আমরা পাইকারি বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনে খুচরা বিক্রি করি। পাইকারি বাজারে দাম বাড়লে আমাদের কিছু করার থাকে না। অধিকাংশ ব্যবসায়ী জানালেন, রবিবার রফতানি নীতি সংশোধন করে পেঁয়াজকে রফতানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। রফতানি বন্ধের ওই সিদ্ধান্ত রাতারাতি কার্যকর করা হয়। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সব দেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ থাকবে। ভারতের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের খবরটি রবিবার বেলা তিনটার দিকে ভোমরা ও সোনামসজিদ স্থলবন্দরে আসে। আর তখনই বাংলাদেশের পথে থাকা সব ট্রাক আটকে দেয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে সময় লাগেনি। পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের পেঁয়াজ-রসুন ব্যবসায়ী সমিতির নেতা ও আলহাজ ভা-ারের মালিক শহিদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, রবিবার সকাল থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত প্রতি কেজি ভারতীয় পেঁয়াজ ৫৫ টাকা, মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা এবং দেশী পেঁয়াজ ৫৭ থেকে ৬২ টাকা বিক্রি করেছি। কিন্তু দুপুরের পর আমদানিকারকরা আমাদের ফোন করে জানিয়েছেন, ভারত ও মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৭৫ টাকার নিচে বিক্রি করবেন না। কারণ ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করেছে। বর্তমানে ভারতের কলকাতাতেই প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ রুপী। তিনি বলেন, আমদানিকারকদের নির্দেশে আমরা রবিবার দুপুরের পর পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ করে দিই। পরে বিকেলে তারা আবার আমাদের ফোন করে বলে দেয় ভারত ও মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৭৫ টাকা এবং দেশী পেঁয়াজ ৮০ টাকা বিক্রি করতে। পরে সন্ধ্যা থেকে আমরা প্রতি কেজি পেঁয়াজ প্রকার ভেদে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করছি। এতে স্বাভাবিক ভাবেই খুচরা বাজারে তা আরও বাড়বে। তিনি বলেন, আমি প্রতিদিন ৮ থেকে ৯ টন পেঁয়াজ বিক্রি করি। আর শ্যামবাজারে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫ টন মেট্রিক টন পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়। পেঁয়াজের মজুদ যথেষ্ট : বাণিজ্য সচিব ॥ সোমবার সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিজ কক্ষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দিন বলেন, দেশী পেঁয়াজ ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ মিলিয়ে মজুদ সন্তোষজনক রয়েছে। মনে করি এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই। যারা পেঁয়াজের বাজার দর বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, এর কোন যুক্তি নেই। যারা মজুদ করবেন এবং বাজারকে অস্থির করার চেষ্টা করবেন তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখানে ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যাতে পেঁয়াজ নিয়ে কোন সমস্যা সৃষ্টি না হয় সেজন্য আমরা কৃষি ও অন্যান্য মন্ত্রণালয় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা নিচ্ছি। আমাদের ঘাটতি খুব বেশি না। যেহেতু আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছি, কাজেই পেঁয়াজ-রসুন-আদা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে পদক্ষেপ নিয়েছি। যাতে ভবিষ্যতে আমদানির দিকে তাকিয়ে থাকতে না হয়। বাণিজ্য সচিব বলেন, গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে এলসি ওপেন করা আছে। একইসঙ্গে দেশী পেঁয়াজের মজুদ পরিস্থিতি জানতে একজন যুগ্ম সচিবকে পাঠিয়েছিলাম এ বিষয়ে তথ্য আনার জন্য। সেখানে দেখা গেছে রবিবার পেঁয়াজের মূল্য মোটামুটি প্রতি কেজি ৬০ টাকা ছিল। কিন্তু ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের খবরে একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা বসে নেই। এ বিষয় নিয়ে আজ সকালে বসেছিলাম। তিনি বলেন, একটি ভাল খবর হলো মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আনার যে প্রক্রিয়া ছিল সেটার দুটি জাহাজ এসে পৌঁছেছে নৌবন্দরে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি জাহাজের পেঁয়াজ রবিবার খালাস হয়েছে। আর একটি জাহাজ আজ খালাস হবে। মিয়ানমার থেকে দুটি চ্যানেলে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। এছাড়া তুরস্ক ও মিসর থেকে পেঁয়াজ আনার প্রক্রিয়া চলমান। আসতে যতটা সময় লাগতে পারে। তবে সময়টা আমি বলতে চাচ্ছি না। যে কোন মুহূর্তে আসতে পারে। দাম বাড়ার কারণ খুঁজতে ১০ কমিটি ॥ এদিকে বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণ খুঁজতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রধান করে দশটি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব টিম বাজার পর্যবেক্ষণ করবে। একই সঙ্গে আজ মঙ্গলবার থেকে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে খোলা বাজারে বিক্রির জন্য ট্রাকের সংখ্যাও বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব। সোমবার বাণিজ্য সচিব সাংবাদিকদের বলেন, দেশী পেঁয়াজের মজুদ যথেষ্ট রয়েছে। মজুদ পরিস্থিতি জানতে ১০ টিম পাঠাচ্ছি, যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে ১০ জেলায় যাবে। যেখান থেকে বেশিরভাগ পেঁয়াজ আসে। এছাড়া বিভিন্ন স্থলবন্দর যেমন বেনাপোল, বাংলাবান্ধাসহ বিভিন্ন বন্দরে আমাদের কর্মকর্তারা থাকবেন। তাদের কাজ হবে মনিটরিং করা। ৪৫ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি করছে টিসিবি ॥ দুর্গাপূজা সামনে রেখে বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঢাকা মহানগরসহ সারাদেশে এক সপ্তাহের জন্য ট্রাকে করে পেঁয়াজসহ কয়েকটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রিতে নেমেছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। সোমবার থেকে আগামী ৬ অক্টোবর পর্যন্ত (শুক্রবার ছাড়া) ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে এসব পণ্য সাশ্রয়ী মূলে বিক্রি করা হবে বলে টিসিবির প্রধান তথ্য কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির জানিয়েছেন।
×