ফিরোজ মান্না ॥ মানবপাচার রোধে বাংলাদেশ ‘পালেরমো প্রোটোকল’ অনুসমর্থনে স্বাক্ষর করেছে। মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে এই প্রোটোকলের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে পদক্ষেপ নেয়া হবে। মানবপাচারকারী যেই হোক তাকে শাস্তির আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় সক্রিয়ভাবে কাজ করবে। ২০১২ সালের মানবপাচার প্রতিরোধ আইনের কঠোর প্রয়োগ করারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, আইনগতভাবে কার্যকর যোগ্য এই প্রটোকলের অনুসমর্থনের নথি জাতিসংঘে পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি মানবপাচার নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক এ কথা বলেছেন। মানবপাচার রোধে সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয় ধারাবাহিকভাবে পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছে। মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ রয়েছে বলেও পররাষ্ট্র সচিব মন্তব্য করেন। বলপূর্বক শ্রম, সেবা ও যৌনকর্মে বাধ্য করা এবং অভিবাসী পাচার বৈশ্বিক সমস্যা। এগুলো বাংলাদেশের জন্যও ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবার পাচারের তথ্য গোপন করায় এ বিষয়ে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। মানবপাচার বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির বলেন, অবৈধভাবে দেশের বাইরে যাওয়ায় বাংলাদেশের অনেক অভিবাসী মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছেন। চলাচলে সীমাবদ্ধতা, ঋণের চক্রে পড়া, জোরপূর্বক শ্রম, যৌন নির্যাতন, জোরপূর্বক বিবাহ এবং দাসত্বের মতো শোষণমূলক আচরণের শিকার হচ্ছেন অভিবাসীরা। দরিদ্র ও প্রান্তিক নারী ও পুরুষ এবং শিশুরাই মানবপাচারকারীদের লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছেন। সব স্তরে সরকার, উন্নয়ন অংশীদার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সুশীল সমাজ, বেসরকারী খাত এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক অংশীদারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানবপাচারের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মানবপাচার বা চোরাচালান উভয়ই বৈশ্বিক ঘটনা। এটি বাংলাদেশের জন্য এখন হুমকিস্বরূপ। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ট্রাফিকিং ইন পার্সন (টিআইপি) রিপোর্ট ২০১৯ অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বহু মনুষ অবৈধভাবে দেশের বাইরে যাচ্ছেন। এই অভিবাসীরা পাচারকারীদের শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ কারণে টিআইপি প্রতিবেদনে টানা তিন বছর বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পর্যায়ের ‘ওয়াচ লিস্টে’ রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার মানবপাচার নির্মূলে যথাযথ উদ্যোগ নিচ্ছে না। মানবপাচার প্রতিরোধে সরকার ও অভিবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার পরামর্শ আসে প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ থেকে স্বপ্ন নিয়ে যারা ইউরোপ আমেরিকা কিংবা মালয়েশিয়ায় যাচ্ছেন- তারা দালালের হাতে পড়ার পরই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন বলে আসিফ মুনির তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন। তখন তাদের সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় দালাল চক্রের হাতে। দালালদের নেটওয়ার্ক বিশ্বজুড়ে। এমন কোন দেশ নেই যে দালাল চক্র কাজ করছে না। দালাল চক্রের হাতে পড়ে বহু স্বপ্নচারী মানুষ নিঃস্ব হয়েছেন আবার অনেকে সাগর ডুবে মারা গেছেন। এরপরও বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ যুবক দেশে থাকতে চান না। তারা মনে করেন যেন তেনভাবে বিদেশ যেতে পারলেই নিরাপদ জীবন পাবেন। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পলিটিক্যাল-ইকোনমিক কাউন্সেলর ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন সম্প্রতি বলেছেন, মানবপাচারকে আমরা মারাত্মক অপরাধ হিসেবে দেখছি। সবশেষ টিআইপি প্রতিবেদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয় পর্যায়ের লিস্টে আছে, যেটি একটি উদ্বেগের বিষয়। কারণ, পাচারের শিকার অনেক মানুষ এখন ভুক্তভোগী। এই প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হলো, পাচারকারীদের আইনের আওতায় এনে বিচার করার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের গঠনমূলক কর্মপরিকল্পনা আছে। এখন এর প্রয়োগের ওপর জোর দিতে হবে।
সূত্র জানিয়েছে, সমাজে যারা প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত এবং ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন তারাই বেশি পাচারের শিকার হচ্ছেন। এই সমস্যা সমাধানে সমন্বয়, সক্ষমতা বৃদ্ধি, সম্পদ ও পরিসংখ্যান অনেক জরুরী। তবে এই বিষয়গুলো বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। মানবপাচার প্রতিরোধে সৃজনশীল এবং সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি একটি উন্নয়নমূলক বিষয়। যারা পাচারের শিকার হচ্ছেন বা বেঁচে আসতে পারছেন তাদের অবশ্যই সহযোগিতা করতে হবে।
মানবপাচার বিষয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অভাব, নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে সচেতনতার অভাব এবং অভিবাসনের জন্য অনেক বেশি খরচের কারণে মানুষ অনিরাপদভাবে দেশের বাইরে যাচ্ছেন। জাতিসংঘের মাইগ্রেশন নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক হিসেবে অভিবাসীরা যে দেশে থাকছেন, যে দেশ থেকে যাচ্ছেন এবং যে দেশগুলো দিয়ে যাচ্ছেন সেখানে তাদের অধিকার ও ভাল থাকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে।