ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

ভয়ঙ্কর ১০ বিষধর সাপ

প্রকাশিত: ১২:১৬, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ভয়ঙ্কর ১০ বিষধর সাপ

পৃথিবীর যে কয়েকটি প্রাণীর নাম শুনলে মানুষ আঁতকে ওঠে, তার মধ্যে সাপ অন্যতম। সাপকে ভয় পায় না, এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা। যদিও সাপ প্রকৃতি ও পরিবেশ-প্রতিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। এর বিষ দিয়ে তৈরি হয় ক্যান্সারসহ বিভিন্ন কঠিন রোগের প্রতিষেধক। এর চামড়া যথেষ্ট দামী। তারপরও সাপ একটি ভীতিকর এবং প্রাণসংহারী প্রাণী। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মৃত্যু ঘটাতে সাপের এক ফোঁটা কিংবা তারচেয়ে কম পরিমাণ বিষই যথেষ্ট। বেশিরভাগ সময় সাপ আত্মরক্ষার্থে মানুষকে ছোবল দেয়। আবার কখনও কখনও পালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেও কামড় বসায়। যদিও সব সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যু হয় না। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় তিন হাজার প্রজাতির সাপ রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় পাঁচশ’ প্রজাতির সাপ বিষধর। বাকিগুলো নির্বিষ। আমাদের দেশে রয়েছে ৯৪ প্রজাতির সাপ। এরমধ্যে ২৮ প্রজাতির সাপ বিষধর। যার ১২ প্রজাতি হচ্ছে আবার সামুদ্রিক। বাকি প্রজাতিগুলোর সাপের বিষ তেমন কার্যকর নয়। তারপরও আশ্চর্যজনক তথ্য হচ্ছে, আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় সাত লাখ সাপের কামড়ের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে প্রায় ৬ হাজার মানুষ সাপের বিষে প্রাণ হারায়। আর মৃত্যুর বেশির ভাগ ঘটনা ঘটে প্রত্যন্ত পল্লীঅঞ্চলে। সাপের কামড়ে আক্রান্ত শতকরা মাত্র তিন ভাগ মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করে। বাকিরা ওঝাদের কাছে দৌড়ায়। এর প্রধান কারণ সচেতনতা ও হাতের কাছে প্রতিষেধকের অভাব। আশার কথা হচ্ছে, সাম্প্রতিককালে সাপ নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের মাঝে আশাব্যাঞ্জক সচেতনতা ধীরে হলেও তৈরি হচ্ছে। অনেকে বাণিজ্যিকভিত্তিক সাপের খামার গড়ে তোলারও উদ্যোগী হয়েছে। বিশেষ করে বিষধর সাপের খামার। সাপের বিষের বাণিজ্যিক মূল্য পৃথিবী জুড়েই রয়েছে এবং এর চাহিদাও ব্যাপক। তাই বিষধর সাপের চাহিদা খামারীদের কাছে দিন দিন বাড়ছে। বিষ মূলত এক ধরণের লালা। যা সাপের শরীরে উৎপন্ন হয়। পৃথিবীতে যেসব প্রজাতির বিষধর সাপ রয়েছে, তা নিয়ে তথ্য-উপাত্ত ও গবেষণার অন্ত নেই। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তবে সর্পবিশারদদের মধ্যে দশ প্রজাতির বিষধর সাপ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা সবচেয়ে বেশি। এগুলো হচ্ছে- ইনল্যান্ড তাইপেন বিষধর সাপ হিসাবে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি নামডাক ইনল্যান্ড তাইপেনের। অস্ট্রেলিয়ার ঘন অরণ্য ঘেরা প্রান্তদেশে এদের বেশি দেখা মেলে। এরা এক ছোবলে যে পরিমাণ বিষ ছোড়ে তাতে একশ’ মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। এমনকি সরিষার দানার মতো অতি ক্ষুদ্র এক ফোঁটা বিষ অন্তত দশজনকে মৃত্যু ঘটাতে যথেষ্ট। এর বিষে কয়েক সেকেন্ডে মানুষের শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে পড়ে। হার্ট বন্ধ হয়ে যায়। এটি লম্বায় সর্বোচ্চ ৮ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। সর্পবিজ্ঞানীরা এ সাপটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইস্টার্ন ব্রাউন অস্ট্রেলিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা পৃথিবীর দ্বিতীয় ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ হচ্ছে ইস্টার্ন ব্রাউন। এরা শুধু চলমান মানুষ বা অন্য প্রাণীদের ছোবল মারে। স্থির প্রাণীদের শরীরে সাধারণত এরা কামড় বসায় না। এরা ১০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। চার থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত ফনা তুলতে পারে। এর গায়ের রং বাদামি। মানুষের চোখের পলক পড়ার আগে যেমন এরা ছোবল মারতে পারে, তেমনি চোখের পলকেই বিষক্রিয়ায় মানুষের মৃত্যু ঘটে। এর বিষ মুহূর্তে ¯œায়ুতন্ত্রকে অকেজো করে দেয়। এরা চলাফেরাও করে দ্রুত। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, ইস্টার্ন ব্রাউন সহসা মানুষকে আঘাত করে না। বেলচার সি পানিতে বাস করা বেশির ভাগ প্রজাতির সাপ নির্বিষ হলেও ব্যতিক্রমী হচ্ছে- বেলচার সি। এক হাজার মানুষ মেরে ফেলার জন্য বেলচার সি সাপের কয়েক মিলিগ্রাম বিষই যথেষ্ট। উত্তর-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার সাগরে এদের বেশি দেখা যায়। এরাও লম্বায় ৭ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। গায়ের রং অনেকটা সবুজাভ। যে কারণে এদেরকে পানি থেকে আলাদা করা কষ্টকর। যার ফলশ্রুতিতে জেলেরাই এগুলোর প্রধান শিকার হয়ে থাকে। এর ছোবলে কয়েক সেকেন্ডে মানুষের মৃত্যু হয়। এর বিষ খুব দ্রুত রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। এদের প্রধান খাদ্য সাগরের মাছ। প্রাণীবিজ্ঞানীরা এদেরকে ভয়ঙ্কর বিষধর হিসেবে বিবেচনা করে। পাইথন দানবাকৃতির কারণে পাইথনকে বলা হয় সাপ জগতের দৈত্য। এটি ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা এবং ৬-৭ ফুট পর্যন্ত মোটা হয়ে থাকে। এদের কোন বিষ নেই। তারপরও সর্পবিজ্ঞানীরা এদেরকে ভয়ঙ্কর সাপের তালিকায় স্থান দিয়েছে। একজন মানুষ কিংবা একটি গরুকে পাইথন অনায়াসে গিলে খেতে পারে। এটি এরা করেও থাকে। একটি প্রাণীকে যখন এরা গিলে খায়, তখন এটির মুখ ১৮০ ডিগ্রী পর্যন্ত বিকশিত হয়। এদের পাকস্থলির পরিপাকতন্ত্র খুব শক্তিশালী। যে কারণে এদের হজম শক্তি প্রবল। তবে সহসা এরা জ্যন্ত প্রাণীকে গিলে ফেলে না। প্রথমে এরা এমন প্রচ- শক্তিতে পেঁচিয়ে ধরে যে, আক্রান্ত প্রাণীটি কয়েক মিনিটে মৃত্যুবরণ করে। এরপরই তা গিলে ফেলে। নিজের শরীরের চেয়ে বড় প্রাণীদেরও এরা অনায়াসে গিলে ফেলে। আফ্রিকার ঘন অরণ্যের জলাশয়ে এক সময় এদের প্রচুর দেখা যেত। এখন এর সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। ব্যাক মাম্বা বিষের দিক থেকে আরেকটি ভয়ঙ্কর সাপ হচ্ছে ব্যাক মাম্বা। এদেরও বাস আফ্রিকায়। এদের গতি বিদ্যুতের মতো। ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটতে পারে। লম্বায় ১০-১২ ফুট। গায়ের রং সবুজ-কালোয় মেশানো। ছোবল দেয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এদের বিষ মানুষের মাথায় পৌঁছাতে পারে। এদের বিষের পরিমাণও বেশি। এরা একটি ছোবলে যে পরিমাণ বিষ ঢেলে দেয়, তা দিয়ে ২০ জনের মৃত্যু ঘটানো সম্ভব। তবে এরা কিন্তু কিছুটা ভিরু প্রকৃতির। সবুজ গাছের কান্ডে মিশে থাকে বলে সাধারণত এদের পৃথক অস্তিত্ব অনুভব করা যায় না। গাছ কাটতে গিয়ে আফ্রিকানরাই বেশির ভাগ এদের কামড়ের শিকার হয়। কালকেউটে অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকার জঙ্গল ছাড়াও এশিয়া মহাদেশে দেখা মেলে কালকেউটের। এমনকি আমাদের দেশেও কালকেউটে একেবারে বিরল নয়। এদের বিষ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। সর্পবিজ্ঞানীদের মতে এদের বিষের থলি খুব বড়। এক ছোবলে ২-৩ চামচ পরিমাণ বিষ ঢেলে দিতে পারে। যা ২০-২৫ জন মানুষ মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। এরা পানি এবং মাটি দু’জায়গাতেই সমান তালে ছুটতে পারে। এরা ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। ৬-৭ ফুট উচু ফনা তুলতে পারে। গায়ের রং অনেকটা কালো। এরা গর্জনও করতে পারে। এ জন্য এদের আরও বেশি ভয়ঙ্কর লাগে। এদের সংখ্যাও দিন দিন কমে আসছে। ভাইপার নামেই আতঙ্ক ভাইপার। এশিয়ার প্রায় সবগুলো দেশেই আছে বিষধর এ প্রজাজির সাপ। এদের বিষের তীব্রতা এত বেশি যে, দংশনের কয়েক ঘণ্টায় মানুষের শরীরের মাংস খুলে পড়ে। অর্থাৎ এরা মানুষের শরীরে পচন ধরিয়ে দেয়। সে পচনে বীভৎস গন্ধও ছড়ায়। এরা পাঁচ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ঘন জঙ্গল কিংবা বাড়িঘরের আবর্জনার মধ্যে এদের বাস। এদের গতি এবং ক্ষিপ্রতা খুব বেশি। চোখের পলকে এরা উধাও হতে পারে। এদের কামড়ে এশিয়া মহাদেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটে। স্পিটিং কোবরা আমাদের দেশে ‘জাতি’ বা ‘জাত’ সাপ হিসেবে যেটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত, তা আসলে কোবরা গোত্রের। এ প্রজাতির মধ্যে স্পিটিং কোবরা বিষের দিক থেকে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এরা ১০ ফুট দূর থেকে লক্ষ্যবস্তুর দিকে বিষ ছুড়ে দিতে পারে। বিশেষ করে মানুষের চোখের দিকে খুব নিখুঁতভাবে বিষ ছুড়তে পারে। আর সে বিষের প্রভাবে নির্ঘাত অন্ধত্ব। এদের ছোবলও ভয়ঙ্কর। কয়েক মিনিটে মৃত্যু অনিবার্য। তবে এরা খুব সুন্দর। বিশেষ করে এরা যখন ফনা তোলে, তখন খুব সুন্দর দেখায়। এরা ১০-১২ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় এদের বেশি দেখা যায়। অবশ্য কোবরা প্রজাতির সব সাপই বিষাক্ত। ডেথএডার ডেথএডার নামেই বোঝা যায় এদের ভয়ঙ্করপনা। যদিও এদের আকার ছোট। লম্বায় মাত্র ২-৩ ফুট। তবে শরীর মোটা। এরা এক ছোবলে একশ’ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বিষ ঢেলে দিতে পারে। যা এক থেকে দেড় শ’ মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। এরা একবার ছোবল দিয়ে চোখের পলকে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। এদের বিষ সরাসরি মানুষের ¯œায়ুতে পৌঁছে। যা ¯œায়ুতন্ত্রকে বিকল করে দেয়। ঘানা ও অস্ট্রেলিয়ায় এদের দেখা মেলে। আফ্রিকাতেও কমবেশি দেখা পাওয়া যায়। বুক্রেইট এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা পাওয়া সাপ বুক্রেইট হিংস্রতা ও বিষের দিক থেকে এতটাই ভয়ঙ্কর যে, নিজ প্রজাতির সাপকেও এরা রেহাই দেয় না। এদের বিষের পরিমাণও বেশি। এদের একটি ছোবল ২০টি কোবরার সমান। এর ছোবলে মৃত্যু নিশ্চিত। তবে খুব দ্রুত চিকিৎসায় বাঁচার সম্ভাবনা থাকে। এটি লম্বায় ৫-৬ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের শরীরের রঙ অনেকটা হলুদ। তার মাঝে কালো দাগ। দেখতে বেশ সুন্দর। বিষাক্ত সাপের ছোবলে মৃত্যু অনিবার্য হলেও অধিকাংশ সাপই বিরক্ত বোধ না করলে বা কেউ উত্ত্যক্ত না করলে সহসা এরা কামড় বসায় না। তাই এদেরকে না মেরে এড়িয়ে চলাই উত্তম। সাপকে সাপের মতোই বেড়ে উঠতে দিতে হবে। কারণ, এরা আমাদের জীব বৈচিত্র্যের অন্যতম অংশীদার। পরিবেশ রক্ষায় এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
×