ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সোনার হরিণের খোঁজে ইউরোপ যাত্রা ॥ দালাল চক্রের নির্যাতন নিপীড়নের শেষ নেই

প্রকাশিত: ১১:১২, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

সোনার হরিণের খোঁজে ইউরোপ যাত্রা ॥ দালাল চক্রের নির্যাতন নিপীড়নের শেষ নেই

ফিরোজ মান্না ॥ ভাল চাকরি আর নিরাপদ জীবনযাপনের আশায় ইউরোপ যাত্রা। দালালের হাতে লাখ লাখ টাকা দিয়ে এমন স্বপ্নচারী মানুষগুলো যখন ঘর থেকে বের হন- তখন থেকেই বিপদ শুরু হয়। তাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় দালাল চক্র। তখন থেকেই তারা জিম্মি হয়ে পড়েন। ইউরোপ পর্যন্ত যেতে দেশে দেশে দালাল চক্রের কাছে বিক্রি হন। বিক্রি হতে হতে কারও ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ধাপে ধাপে বিরাট অংকের টাকা দিয়ে ইউরোপে যেতে পারেন। আবার যাদের ভাগ্য সহায় হয় না- তারা বিভিন্ন দেশের জেলে স্থান পান। পাচারকারীরা প্রথমে তাদের ইউরোপের উদ্দেশে বিমানে ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ লিবিয়ায় পাঠায়। লিবিয়ায় দালালরা তাদের একটি ঘরে বন্দী রাখে। এরপর শুরু হয় লোমহর্ষক ভয়ঙ্কর সব ঘটনা। ইউরোপগামীদের ওপর দালাল চক্র চালায় নির্মম নির্যাতন। দফায় দফায় টাকা নেয়ার পর সাগর পথে পাঠানো হয় ইতালির উদ্দেশে। সেখানেও দালাল চক্রের আরেকটি অংশের হাতে আটক থাকতে হয়। যারা তীরে ভিড়তে পারেন তাদের কাছ থেকে আবারও টাকা আদায়ের নির্যাতন চলে। কয়েক দফা টাকা দেয়ার পর ভাগ্য সহায় হলে অবৈধভাবে কাজের সুযোগ পান অনেকে। আবার কেউ কেউ জেল হাজতে স্থান পান। অনেকে ইতালির উপকূলে পৌঁছাতে পারেন আবার অনেক সাগরে ডুবে মারা যান। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এই প্রক্রিয়াকে বলছে অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন। এই অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন দেখার দায়িত্ব তাদের না। রাষ্ট্রের অন্য সংস্থাগুলো অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন রোধ করবে। অথচ মন্ত্রণালয় থেকে জনশক্তি রফতানিকারক হিসেবে দালাল চক্রের কয়েকজন লাইসেন্স নিয়েছে। সম্প্রতি তিউনিসিয়ায় পর পর কয়েকটি নৌকা ডুবির ঘটনায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক হিসাবে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত ১৭ হাজার অভিবাসী সাগর পথে ইউরোপে ঢুকেছেন। জানা গেছে, মানব পাচারের সবচেয়ে বড় রুট এখন ভূমধ্যসাগর। এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে বাংলাদেশের লোকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। ভাগ্য বদলাতে অনেকে দেশী-বিদেশী মানব পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হচ্ছেন। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে মানব পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশীদের নাম বারবার আসছে। বিপজ্জনক পথে মানবপাচার যে বন্ধ হয়নি, তার সর্বশেষ উদাহরণ লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি যাওয়া বাংলাদেশের লোকজনের নৌকাডুবির ঘটনা। সম্প্রতি তিউনিসিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে অনেক বাংলাদেশী নাগরিকের সলিল সমাধি হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, দালাল চক্রের মাধ্যমে যারা বিদেশ যাচ্ছেন তাদের জন্য মন্ত্রণালয়ের কোন দায়-দায়িত্ব নেই। তারা তো মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যাচ্ছেন না। আমরা এ ধরনের অভিবাসনকে অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন বলি। এটা রোধ করবে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে যারা লাইসেন্স নিয়ে এমন কাজ করছেন তাদের সম্পর্কে যে কেউ অভিযোগ করলে তার লাইসেন্স বাতিল করা হবে। এমন কি তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। তবে ঢাকার বাইরে কয়েকটি লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। যারা এখনও বায়রার সঙ্গে যুক্ত হননি। তাদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে সমস্যার উপায় খুঁজে বের করতে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে আলোচনায় বসার সুপারিশ করা হয়েছে। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির শিকার হওয়া লোকজন কাদের মাধ্যমে গেছে, সেটা খুঁজে বের করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এমন দাবি করেছে ন্যাশনাল লেভেল শেয়ারিং ফর এডাপশন অব কমপ্রিহেনসিভ ল’ এগেইনস্ট ট্রাফিকিং ও রেফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। তারা বলেছেন, যে হারে মানবপাচার হচ্ছে তাতে এটা দেশের যে কোন নাগরিককেই নাড়া দেবে। মানবপাচার নিয়ে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের কথা বলা হলেও আসলে তা করা হয়নি। পাচারকারীদের দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে সমস্যা সমাধান হবে না। পাচারকারীরা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ মানবপাচার হচ্ছে তা পৃথিবীর অন্য কোন দেশেই নেই। তাই সরকারকে এখনই সতর্ক হওয়া উচিত। এজন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও শ্রম মন্ত্রণালয় যৌথভাবে বিষয়টি নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। তা না হলে ভবিষ্যতে অবস্থার আরও অবনতি ঘটবে। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, সাগর পথে ইউরোপে পাড়ি দেয়ার ঘটনা কোন নতুন কিছু না। এই ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। প্রায়ই বাংলাদেশসহ আফ্রিকার বহু মানুষ ইউরোপে যাওয়ার জন্য ভূমধ্যসাগর পাড়ি জমাচ্ছেন। তাদের বেশিরভাগই নৌকাডুবিতে মারা যান। সাগরভাসা মানুষদের উদ্ধার প্রক্রিয়াও দীর্ঘ। এ বছর বেশিরভাগ ঘটনা ঘটেছে তিউনিসিয়ার উপকূলে। চাকরির আশায় দালাল চক্র বাংলাদেশ থেকে লোক সংগ্রহ করে লিবিয়ার উপকূল দিয়ে ইউরোপে পাচার করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এ বছরের শুরু থেকে ১৬৪ জন সাগরে ডুবে মারা গেছেন। সাগরপথে কড়াকড়ির কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর আবারও সাগর পথে শুরু হয়েছে মানবপাচার। গোপনে পাচারকারী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত সাগর পথে ইউরোপ পাড়ি দেয়ার সময় নৌকা ডুবে মারা গেলেও খবর আসে না। এবার বেশি সংখ্যক বাংলাদেশী মারা যাওয়ার বিষয়টি বিশ্ব গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবে অন্তত ৬৫ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে মৃতের তালিকায় ৩৭ বাংলাদেশী ছিল। আর জীবিত উদ্ধার হয়েছেন ১৪ বাংলাদেশী। এদিকে, দেশে ২০১২ সালে মানবপাচার রোধে আইন করা হয়। ওই আইনে মানবপাচারকারীর সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। অথচ মানবপাচারের কোন মামলাই কারও তেমন কোন বড় শাস্তি হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ২০১২ সালে মানবপাচার আইন হওয়ার পর থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ৭১৬টি মামলা হয়েছে। কিন্ত এই মামলাগুলোর নিষ্পত্তির হার খুবই সামান্য। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এসব মামলার অধিকাংশই এখন পর্যন্ত বিচার হয়নি। পাচার রোধে যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেয়ায় গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘টায়ার-২ ওয়াচ লিস্টে’ রেখেছে। মানবপাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান অনেক উপরে। পুলিশ মানবপাচারের মামলা নিতেও আগ্রহী নন। কারণ এসব মামলায় তদন্ত কাজ করতে আর্থিক সুবিধার কথা চিন্তা করেন। কারণ পাচারকারীর সঙ্গে পুরিশের ভাল যোগাযোগ রয়েছে। তাই মামলাগুলোর বিচার শেষ হয় না। এমন কি কোন কোন মামলার আসামিও ধরা পড়ে না। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দফতরের (ইউনিডক) ২০১৮ সালের মানবপাচারবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্তত ৫ শতাংশ নাগরিককে পাওয়া গেছে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে মানবপাচারের শিকার হওয়া এসব লোক মূলত ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নাগরিক। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার লোকজন বিশ্বের ৪০ দেশে মানবপাচারের শিকার হচ্ছে। মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে বিদেশগামী বাংলাদেশীরা বলছেন, মূলত উন্নতজীবনের আশায় এসব ঝুঁকিপূর্ণ পথে তারা দেশের বাইরে পা রাখেন। তবে সরকারের তথ্য অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। বর্তমানে তা কমে হয়েছে ২১ শতাংশে এসেছে। এরপরেও কেন মানব পাচার হচ্ছে। এ নিয়ে ইউনিডকের দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগ জানিয়েছে, মানবপাচারকারীদের বিচার করার জন্য ২০১২ সালের ‘বাংলাদেশের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ওই ট্রাইব্যুনাল গঠনের আর অগ্রগতি হয়নি। পাচার আইনে বিচার দীর্ঘসূত্রতার কারণে মানবপাচার আইনে করা মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। গত কয়েক বছরে দেশে মানবপাচার আইনে ৪ হাজার ৬৬৮টি মামলা হয়েছে। এই মামলাগুলোর মধ্যে মাত্র ২৪৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি মামলাগুলোর স্থবির অবস্থায় পড়ে আছে। আইনে থাকলেও সাত বছরে এ সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল না গঠন করাই এ দীর্ঘসূত্রতার জন্য দায়ী। প্রতি জেলায় ট্রাইব্যুনাল করা কঠিন। তবে যেসব জেলা থেকে মানবপাচার বেশি হয়েছে সেসব জেলায় ট্রাইব্যুনাল হতে পারে। আইন অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা শেষ না হলে ট্রাইব্যুনাল সেটি উচ্চ আদালতে পাঠাবে। মানবপাচার ও অভিবাসন ভিন্ন বিষয়। পৃথিবীর উন্নয়নে অভিবাসন অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু আমাদের দেশে মানবপাচারের ৯০ শতাংশ হয়ে থাকে অবৈধ অভিবাসন কেন্দ্রিক। এসবের মূল কারণ অনিয়ম-দুর্নীতি।
×