ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গু ॥ প্রয়োজন সকলের সচেতনতা

প্রকাশিত: ০৯:০৯, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ডেঙ্গু ॥ প্রয়োজন সকলের সচেতনতা

চলতি বছর বিশ^জুড়ে চলছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। বাংলাদেশের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্সের মতো দেশেও তীব্র আকার ধারণ করেছে মশকবাহিত ভাইরাসটি। মোট ১০টি দেশের ডেঙ্গু পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে কম। অথচ হই-চইয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে। বিশ^জুড়ে ক্রমেই ডেঙ্গুর বিস্তার লাভ করছে। নানা কারণে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকির মধ্যে আছে। বাংলাদেশে প্রায় সমগ্র দেশেই ডেঙ্গুর আক্রমণ ঘটেছে সে বিবেচনায় সবাই এখন ডেঙ্গু ঝুঁকিতে। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ০.০১% অন্যদিকে চলতি বছরের একই সময়ে সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গুর প্রকোপ ০.০৯% অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে ০.০৮% বেশি। অথচ বিশ^ পরিবেশ সংস্থার মূল্যায়ন অনুযায়ী পরপর তিনবার সিঙ্গাপুর বিশে^র শ্রেষ্ঠতম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ঢাকা শহরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা তো বসবাসের জন্য অযোগ্য সিটির তালিকায় ঢাকাকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে। সিঙ্গাপুরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বিশে^র জন্য মডেল আর সেখানেই কিনা ডেঙ্গুর প্রকোপ বাংলাদেশের চেয়েও বেশি। তাহলে বোঝা যায় অন্যান্য আরও অনেক কিছুই ডেঙ্গুর প্রকোপের পিছনে কাজ করে। এডিস মশা নিধনের জন্য ওষুধ ছিটালেই যে সব সমাধান হয়ে যাবে এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। মাহাথির মোহাম্মদের দেশ মালয়েশিয়াতেও এডিস মশা নিধনের জন্য ওষুধ কম ছিটানো হয়নি অথচ সেখানেও চলতি বছর ০.১৯% ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে ০.১৮% বেশি। এছাড়া যথাক্রমে কম্বোডিয়ায় ০.০২%, ফিলিপিন্সে ০.০৯%, ভিয়েতনামে ০.০৮%, লাওসে ০.১১% এবং নিউ কেলিডোনিয়ায় ১.৩৩% ডেঙ্গুর আক্রমণ ঘটেছে। থাইল্যান্ডে (মোট জনসংখ্যা ৬ কোটি প্লাস) চলতি বছরে লাখো মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে শতাধিক। বাংলাদেশে (মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি প্লাস) এ যাবত আনুমানিক ৩০০০০ আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ৫০-৬০ জনের। মালয়েশিয়ায় (মোট জনসংখ্যা ৩ কোটি প্লাস) লাখো মানুষ আক্রান্ত, মৃত্যু হয়েছে প্রায় একশ’ জনের, ফিলিপিন্সে (মোট জনসংখ্যা ১০ কোটি প্লাস) কয়েক লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে চার শতাধিক মানুষের। বর্ণিত দেশগুলোতে দলমত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ জনগণ কেউ কাউকে দোষারোপ করছে না বা কেউ নিজের দায়িত্ব পালন না করে অন্যের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপানোর চেষ্টা করছে না, বরং সবাই একত্রে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে চলেছে, দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এখানে চলছে দায়িত্ব এড়ানোর তুমুল প্রতিযোগিতা, চলছে একে অন্যকে নসিহত করার পাল্টাপাল্টি হীনম্মন্যতা অথচ নিজের কি করা উচিত বা নিজে ডেঙ্গু মোকাবেলা করার জন্য কতটুকু দায়িত্ব পালন করেছে তার খতিয়ান না দিয়ে অন্যের কাজের তহবিল ঘেঁটে বেড়াচ্ছে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কি হতে পারে। অভিযোগ উঠেছে ঢাকার মশার ওষুধ অকার্যকরী তাই কাজ হয়নি, মশাও মরেনি; তাই ঝাকে ঝাকে এডিস মশা মানুষকে কামড় দিয়েছে আর তাই ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে। সিঙ্গাপুরের মশার ওষুধ নিশ্চয়ই কার্যকরী ছিল, সেখানে ন্যায্যভাবে মশার ওষুধ ছিটানো হয়েছে এটিও নিশ্চিত, তাহলে সেখানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হলো কি করে? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতের এডিস মশা রয়েছে, তাদের আচার আচরণ, ডিম দেয়ার প্রয়োজনে এডিস মশা মানুষের রক্ত সংগ্রহ করবে নাকি পশুর রক্ত সংগ্রহ করবে সে পার্থক্য, অপ্রতিকূল পরিবেশে মশার বংশ বিস্তারের স্থান পরিবর্তনের কৌশল অবলম্বন, এডিস মশার আচার-আচরণ যেমন রক্ত সংগ্রহের সময়ানুবর্তিতা পরিবর্তন ইত্যাদি বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। বাংলাদেশও সেই ব্যতিক্রমের উর্ধে নয়। বাতাসের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের নিচে চলে গেলে এডিস মশার কামড়ানোর মাত্রা অনেক কমে যায়। যে জন্য শীতকালে অর্থাৎ নবেম্বর হতে পরবর্তী বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এডিস মশার কামড়ের মাত্রা অনেক কমে যায়। যে জন্য উক্ত সময়ে ডেঙ্গুর আক্রমণও অনেক কমে যায়। প্রতি বছর মে হতে অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুর আক্রমণ ঘটে থাকে এবং জুলাই হতে সেপ্টেম্বর উক্ত ৩ মাসে ডেঙ্গুর আক্রমণ সবচেয়ে বেশি ঘটে। মশা নিধনের ওষুধ বেশি বেশি প্রয়োগ করলেও তার পাশর্^ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। মশার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের জন্য উপকারী অন্যান্য কীটপতঙ্গও ধ্বংস হয়ে যাবে। এত পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। সে জন্য বিজ্ঞানীরা মশার বংশ বিস্তারের স্থান নির্মূলের পরামর্শ দেন, এতে পরিবেশের কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরে বিল্ডিং ও স্থাপনাগুলো আরও বেশি ঘনত্বপূর্ণ। এসবের ভিতরে এডিস মশার লক্ষকোটি বংশ বিস্তারের স্থান লুকিয়ে আছে যা নাগালের বাইরে যেগুলো নির্মূল করা আসলেই দুরূহ। কিছু কিছু মশক নিধন ওষুধ প্রয়োগের পর পরিবেশের ভিতরে স্থায়ী আসন করে নেয়। দৃশ্যমান এবং নাগালের ভিতরের বংশবিস্তারের স্থান ধ্বংস করা সহজ। তবে অপ্রতিকূল অবস্থায় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মশা কৌশল পাল্টিয়ে ফেলে, এখন এডিস মশা গাছ এমনকি নারিকেল গাছ, তাল গাছের ভিতরে জমে থাকা পানিতে বংশ বিস্তার করে। বার্ড ফ্লু ঠেকানোর জন্য মিলিয়ন বিলিয়ন মুরগি নিধন করা হয়, তা পরিবেশের ভারসাম্য ক্ষতি করে না, কিন্তু গাছ-পালা নিধন তো সম্ভব নয়, এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। বংশ বিস্তারের জন্য এডিস মশার সবচেয়ে পছন্দের দুটি জায়গা হলো যথাক্রমে ডাবের খোসা ও টায়ারের মধ্যে জমে থাকা পানি। এদিক বিবেচনায় ঢাকা শহরের হাজারো ডাব বিক্রেতা ও হাজারো ওয়ার্কশপ কর্মীদের স্বাস্থ্য শিক্ষা জ্ঞানদান করা যেতে পারে। সংক্রামক ব্যাধির সবচেয়ে কার্যকরী পথ হলো ভেকসিন। এইডস এর কার্যকরী ভেকসিন আবিষ্কারও সম্ভব হচ্ছে না, যদিও পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় আট লাখ মানুষ এইডসে মৃত্যুবরণ করে। ডেঙ্গুর কার্যকরী ভেকসিনও আবিষ্কার সম্ভব হচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতে আবিষ্কার হবে তার সম্ভাবনাও কম। যদিও পরীক্ষামূলকভাবে ডেঙ্গু ভেকসিন প্রয়োগ করা হচ্ছে কিন্তু তার কার্যকারিতা হতাশাজনক। ট্যাকনিক্যাল কারণ অর্থাৎ ম্যালেরিয়া, এইডস ও ডেঙ্গু উক্ত তিনটি জীবাণু থেকে ভেকসিন তৈরির উপাদান বের বরা সম্ভব হচ্ছে না, যে জন্য ভেকসিন তৈরি করা যাচ্ছে না। তবে ম্যালেরিয়া ও এইডস নিয়েই মানুষ বসবাস করছে এবং আগামীতে ডেঙ্গু নিয়েও মানুষ বসবাস করবে। উল্লিখিত ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর আক্রমণ সবচেয়ে কম। তবে এতে আত্মতুষ্টির কোন সুযোগ নেই। যেহেতু ডেঙ্গুর কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে কাজেই একে প্রতিরোধ করতে হবে। প্লেগের কথা মানুষ ভুলে গেছে। জলবসন্ত নির্মূল হয়ে গেছে, পোলিও নির্মূল হওয়ার পথে। কলেরা মহামারী বিলুপ্তপ্রায়। প্রথম বিশ^যুদ্ধের সময় ১৯১৮-১৯১৯ সালে ফ্লো মহামারীতে বিশে^ প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। গত ১০০ বছরে ফ্লো ভাইরাস বহুবার তাদের বিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু মানুষের সতর্কতার কাছে পরাজয় বরণ করেছে, বিশ^মহামারী আর ঘটাতে সক্ষম হয়নি। জীবাণুরা মহামারী আকারে মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে থাকে কিন্তু পরিশেষে মানুষই জয়লাভ করে থাকে। তবে প্রতিটি যুদ্ধের পূর্বে মানুষ যেমন প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকে তেমনি জীবাণুরাও মহামারী ঘটানোর পূর্বে প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকে এবং জীবাণুদের সেই প্রস্তুতি পর্বকে সময়মতো শনাক্ত করতে পারলে সময় উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। অনেক রোগেরই ভৌগোলিক সীমারেখা থাকে যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্যালেরিয়া কিন্তু ঢাকায় ম্যালেরিয়া নেই। ইয়োলো ফিভার আফ্রিকায় রয়েছে কিন্তু বাংলাদেশ, ভারত বা চীনে নেই। তবে অদূর ভবিষ্যতে ইয়োলো ফিভার যে বাংলাদেশে আসবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই কেন না আফ্রিকার ইয়োলো ফিভার আক্রান্ত দেশের লোকেরা হরহামেশা বাংলাদেশে যাতায়াত করে চলেছেন। ডেঙ্গু এক সময় ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু এখন সারাদেশে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে চলেছে। দেশে অনেক রাজনৈতিক দল রয়েছে, প্রত্যেক দলেরই অসংখ্য কর্মীবাহিনী রয়েছে অনেক দলের পাড়া মহল্লা পর্যন্ত কর্মী বাহিনী রয়েছে। তারা তাদের লোকজনদের নির্দেশ দিতে পারেন যাতে প্রতিটি গ্রামে/মহল্লায় তারা যেন এডিস মশার বংশ বিস্তারের স্থানগুলো নির্মূল করেন। পারস্পরিক দোষারোপের প্রতিযেগিতা না করে বরং এডিস মশার বংশ বিস্তার বিনাশের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে কেউ বাঁধা দিবে না, বরং কোন দল বা গোষ্ঠি বা গ্রুপ কতটা এলাকায় এডিস মশার বংশ বিস্তারের স্থান ধ্বংস করল তার খতিয়ান দেখে জনগণ তাদের মূল্যায়ন ঠিকই করবে। এটাই হলো জনসমক্ষে দেশপ্রেমের নজির স্থাপন করা উত্তম উপায়। মনে রাখতে হবে বংশ বিস্তার বিনাশ পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি, ভেকসিনের পরই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। কেননা বংশবিস্তার নেই তো এডিস মশাও নেই, আর এডিস মশা নেই তো তার কামড়ও নেই, আর ডেঙ্গুও নেই। লেখক : অধ্যাপক, পরিচালক বিআইএইচএস জেনারেল হাসপাতাল (বারডেমের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান) ও সাবেক পরিচালক প্রশাসন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×