ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টুকুর অভিযান

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৩১ আগস্ট ২০১৯

টুকুর অভিযান

বনের একটা গাছের ছোট্ট গর্তে বাস করে এক কাঠবিড়ালি ও তার ছানা ‘টুকু’। সে ভীষণ দুরন্ত আর সাহসী। তার খুব ইচ্ছা করে পুরো বনটা ঘুরে দেখার। কিন্তু মা তো তাকে কিছুতেই গর্ত থেকে বের হতে দেয় না! মায়ের ধারণা, টুকু বাসা থেকে বের হলেই গহীন বনে হারিয়ে যাবে। বনের রাজা সিংহ তাকে ধরে নিয়ে যাবে। বনের সবাই রাজামশাইকে ভীষণ ভয় পায়। তার সামনে যেয়ে দাঁড়াবে এমন সাহস কারও নেই! মায়ের মুখে টুকু শুনেছে, সিংহ নাকি বিশালদেহী। যখন সে গা দুলিয়ে সবার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় তখন সবাই ভয়ে থরথর করে কাঁপে। তার গর্জনে পুরো বন কেঁপে উঠে। তার গলার নিচে আছে লম্বা লম্বা কেশর। টুকুর ইচ্ছা সে একদিন বনের রাজার সঙ্গে দেখা করবে। আজ টুকুর জন্মদিন। সে বৃষ্টির পানিতে গোসল সেরে মায়ের তৈরি নতুন পোশাকটা গায়ে জড়িয়ে নিল। মা তার পছন্দের মিষ্টি খেজুরের পিঠা বানিয়েছে। এক কামড় পিঠা চিবুতে চিবুতে টুকু এক ঢোঁক ডাবের পানি খেয়ে ঢেঁকুর তুলল। মা ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘আমার টুকুসোনা, বলো তোমার জন্মদিনে কী উপহার চাও তুমি?’ টুকু তার মায়ের কোলে চড়ে বায়না ধরল, ‘মা, আমি পুরো বনটা একবার ঘুরে দেখতে চাই।’ ছেলের মুখে এমন কথা শুনে আঁতকে উঠে টুকুর মা, ‘বলে কী এইটুকু ছেলে? তুমি তো বিশাল বনে হারিয়ে যাবে বাবা। চারদিকে কত বিপদ!’ টুকুও নাছোড়বান্দা। সে বাইরে যাবেই! অবশেষে টুকুর আবদার মেনে তার মা তাকে অনুমতি দিল। টুকু তার ঝুলি গুছিয়ে নিল অভিযানের জন্য। সঙ্গে নিল কিছু পাতা আর মিষ্টি খেজুরের রস। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, টুকু বুকভর্তি নিঃশ্বাস নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। দেখে তাদের গাছের নিচে পথের ওপর পড়ে আছে ছোট্ট একটা টুনটুনির ছানা। ছানাটি চিঁ-চিঁ করে কাঁদছে। টুকু জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কী হয়েছে?’ ছানাটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি আমার বাসা থেকে পড়ে গেছি। দয়া করে আমাকে বাসায় পৌঁছে দাও?’ টুকু খুবই দয়ালু। সে ছানাকে কোলে নিয়ে গাছে চড়ে তার বাসায় রেখে এলো। ছানাটি খুশি হয়ে তাকে একটা সুন্দর পালক উপহার দিল। টুকু উপহার নিয়ে খুশিমনে হাঁটতে শুরু করল। নদীর ধারে আসতেই সে দেখতে পেল একটা সজারু পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। সে চিৎকার করে টুকুর সাহায্য চাইলো, ‘বাঁচাও, বাঁচাও!’ টুকু দৌড়ে তার কাছে ছুটে গেল। ঝুলি থেকে পাতাগুলো বের করে এগিয়ে ধরল সজারুর দিকে। সজারু পাতা কামড়ে ধরে ভেসে এলো পাড়ে। ডাঙ্গায় এসে গা ঝেড়ে বলল, ‘তুমি আমাকে সাহায্য করেছ। এই নাও, তোমাকে একটা কাঁটা উপহার দিলাম।’ সজারুর থেকে বিদায় নিয়ে টুকু আবার হাঁটতে শুরু করল। সন্ধ্যা নেমে আসছে। চারদিকে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। টুকু দেখতে পেল ঝোপের মাঝে কিছু ছোট ছোট বাতি জ্বলছে আর নিভছে। এগুলো নিশ্চয়ই জোনাকিপোকা! টুকু তার মায়ের সঙ্গে শুনেছে, জোনাকি রাতের অন্ধকারে মিটিমিটি জ্বলে আলো দেয়। টুকু জোনাকি পোকাগুলোর কাছে গিয়ে অনুরোধ করল, তারা যেন টুকুকে আলো দিয়ে পথ দেখতে সাহায্য করে। জোনাকি পোকাগুলো সবাই খুশি মনে একজোট হয়ে দাঁড়াল আর চারদিক আলোকিত হয়ে গেল। সেই আলোতে পথ ধরে এগিয়ে চলল টুকু। আজ সে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে। এবার একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়। সামনেই খরগোশের বাড়ি দেখতে পেয়ে টুকু থামলো। জোনাকি পোকাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিল। ছোট্ট কাঠবিড়ালি টুকু এবার আশ্রয় নিল খরগোশের বাড়িতে। অতিথিকে খরগোশ খুব খুশি হয়ে আপ্যায়ন করল। জানতে চাইল, ‘আচ্ছা টুকু, তুমি এই বিরাট বনে একা কেন ঘুরে বেড়াচ্ছ?‘ টুকু তার অভিযানের কথা সব খুলে বলল। সঙ্গে এও বলল, সে বনের রাজা সিংহের সঙ্গে দেখা করতে চায়। যদি খরগোশ তাকে সিংহের গুহা চিনিয়ে দেয় তবে সে খুবই উপকৃত হবে। খরগোশ প্রথমটায় ভয় পেলেও টুকুর অনুরোধে অবশেষে রাজি হলো। সকাল হলেই খরগোশের সঙ্গে সিংহের গুহায় পৌঁছাল টুকু। খরগোশ লুকিয়ে রইল ঝোপের আড়ালে। টুকু গুহার ভেতর উঁকি দিয়ে দেখল সিংহ ঘুমাচ্ছে। সে সামনে এগুতেই পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সিংহের গায়ের ওপর। তার ঝুলিতে থাকা সজারুর কাঁটা বিঁধল গিয়ে সিংহের গায়ে। সিংহের ঘুম ভেঙে গেল। গর্জন করে বলল, ‘কে রে আমার ঘুম ভাঙাল?’ টুকু রাজাকে কুর্নিশ করে বলল, ‘আমি টুকু, রাজামশাই।’ সিংহ চোখ কুঁচকে তাকে দেখল, ছোট্ট একটা প্রাণী। একে খেলে তার পেট ভরবে না। টুকু রাজাকে জানাল সে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য কতদূর পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। সিংহ সব শুনে আর টুকুর সাহস দেখে খুবই খুশি হলো। কারণ, বনের সবাই তাকে খুব ভয় পায়। কেউ কাছে আসে না। সিংহের একা থাকতে একটুও ভাললাগে না। টুকু আর সিংহের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। টুকু বিভিন্ন কসরত করে, খেলা করে আর সিংহ গা দুলিয়ে হাসে। টুকু বলল, ‘রাজামশাই আমি আপনার জন্য একটি উপহার এনেছি।’ এই বলে সে ঝুলি থেকে খেজুরের রস বের করে সিংহকে খেতে দিল। এমন মিষ্টি মধু সিংহ এর আগে কখনই খায়নি। সে বলল, ‘বন্ধু, তুমি আমাকে উপহার দিয়েছ। আমিও তোমাকে কিছু দিতে চাই। এই নাও আমার একটি রাজকীয় কেশর।’ টুকু খুব খুশি হয়ে কেশরটি নিয়ে রাজাকে কুর্নিশ করল। তারপর সিংহের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চলল তার বাড়ির দিকে। বাড়ি ফিরে টুকু তার মাকে তার অভিযানের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। ঝুলি থেকে বের করে সবার উপহারগুলো দেখাল, সেই সঙ্গে সিংহের কেশরটাও! গর্বে টুকুর মায়ের বুক ভরে উঠল। তাকে বুকে জড়িয়ে বলল, ‘আমার টুকু, বীর টুকু!’
×