ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বস্তির জীবন মানবেতর

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ২৯ আগস্ট ২০১৯

বস্তির জীবন মানবেতর

অন্নহীন, চীরবস্ত্রধারী, পীড়িত এক ব্যক্তি। কখন যে বস্তিতে এসেছে ক্ষুধার রাজ্যে সে কথা হয়ত ভুলেই গেছে। কেমন করে সে আজও বেঁচে আছে ভাবতেই সে নিজেই অবাক হয়ে যায়। কারণ তার বেঁচে থাকার কথা নয়। বস্তির একেকটি মানুষের জীবন কাহিনী যদি লেখা হয় তাহলে সে হবে এক জীবন্ত মহাকাব্য। আকাশে বাতাসে অনুরণিত হবে ক্রন্দন রোল। হতাশা আর অনিশ্চিত যাত্রা। ১৯৮১ সালের কথা। হরিজন সম্প্রদায়ের এক বস্তির কথা। তারা কিছুই জানে না। আদালতের রায় নিয়ে এসে পুলিশের সাহায্যে এক জোতদার কয়েক ঘণ্টায় শত শত নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধকে উচ্ছেদ করল। গড়ে ওঠা বস্তি নিমিষেই শেষ। তারা কোথায় যাবে? কোথায় আবার বসত করবে? এক সমাজকর্মী (অলিখিত) যুবক তাদের পক্ষে সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) মানে সি.ও. (ডেভ.) এর কাছে লিখিত আবেদন করল। সি.ও. সাহেব সার্কেল অফিসের সামনের রাস্তার ধারে বসবাস করার পরামর্শ দিলেন। শুরু হল বসবাস। থানা থেকে উপজেলা হল। উন্নয়ন হল। উপজেলা কিন্ডার গার্ডেন স্কুল হল ঐ রাস্তার পাশে। হরিজন, তাদের গৃহ পালিত পশু শুয়র, হরিজনদের শিশুদের কোলাহল। এমন পরিবেশে কি বসবাস করা যায়? ইতোমধ্যে ঐ যুবক হরিজনদের মাছ হাটিতে রাত্রি যাপনের সচিত্র প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন সাপ্তাহিক একতায়। উপজেলা প্রশাসন সরকারের সহযোগিতায় এবার ছোট যমুনা নদী পার করে তাদের রেখে আসলেন যমুনা নদীর তীরে। পাকা বাড়িঘর, ল্যাট্রিন পেয়ে হরিজন সম্প্রদায়ও খুশি। উপজেলা প্রশাসনও স্বস্তির নিঃশ^াস ফেললেন। নিজ দেশে এরা যাযাবর। নগর-মহানগরে যে বস্তিগুলো গড়ে উঠেছে তা একদিনে গড়ে ওঠেনি। এ মানুষেরাও এক দিনে সর্বহারা হয়নি। রাষ্ট্র-সমাজ এর শোষণ, শাসন, নিপীড়ন, নির্যাতনের ফসল। দুর্নীতি, সন্ত্রাসের ফসল। বস্তির মানুষ যদিও মানুষ। তবু বলতে হয় কোন মানুষ? অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ^াস নিয়ে সমাজের সকল অপরাধ কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত হয়ে দিনে দিনে বেড়ে ওঠা। এ মানুষদের অর্থনৈতিক মুক্তি দিলেও কি বদলাবে? মানসিক মুক্তি দিতে হবে। মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন একজন মানুষ। কুশিক্ষা থেকে সুশিক্ষায়, কুসংস্কার থেকে সংস্কারে, অন্ধকার জগৎ থেকে আলোর জগতে নিয়ে আসতে হবে। তবেই হবে সমাধান। মুক্তিযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায়ের কণ্ঠে শোনা গান- একখানা ডলার ভিক্ষা চাইলে ধমক মারে শাট আপ! কেন যে বিদেশে আইলাম বাপরে বাপ! যে দেশের অর্থনীতি ব্যবস্থায় ভিক্ষুক জন্মে সে অর্থনীতি গ্রহণ না করে, যে দেশের অর্থনীতি ব্যবস্থায় ভিক্ষুক জন্মে না সে দেশের অর্থনীতি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বস্তির জীবনের অবসান ঘটবে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক শ্রেণী কাঠামো চরম বৈষম্যমূলক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা না হলে তার উদ্ভাবিত উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়িত হলে, কোনো বাঙালি জন্মসূত্রে দরিদ্র হতো না। দরিদ্র হওয়ার সেই সুযোগও বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় থাকতো না। কেননা তখন সাংবিধানিকভাবেই সম্পদের বেশীর ভাগ অংশের মালিক হতো রাষ্ট্র। এরপর সমবায় এবং নির্দিষ্ট সীমার ব্যক্তি। এতে শ্রেণী কাঠামোয় আমূল প্রগতিশীল পরিবর্তন হতো। জাতীয় সম্পদ ও উৎপাদন পর্যায়ে ব্যক্তি-খানা-পরিবারভিত্তিক মালিকানা জনিত বৈষম্য শূন্যের কোঠায় নেমে আসত। বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ছিল বিশ^ দৃষ্টিভঙ্গির। এই দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল সবার ঊর্ধ্বে মানুষ। নৈতিক ও ন্যায়বোধ বিচারে সব মানুষই সমান। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা দর্শন ছিল শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য আর অসমতার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ উন্নয়ন দর্শন ছিল বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও অসাম্প্রদায়িক আলোকিত মানুষের সমৃদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোর পুরো চিত্রই বদলে যেত। বস্তির জীবন হতে মুক্তি পেতে হলে জাতীর জনকের দর্শন বাস্তবায়ন করতে হবে। ফুলবাড়ী, দিনাজপুর থেকে
×