ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা স্কুল ফিডিং কর্মসূচীর আওতায় আনা হচ্ছে

প্রকাশিত: ১০:২৫, ১৯ আগস্ট ২০১৯

 প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা স্কুল ফিডিং কর্মসূচীর আওতায় আনা হচ্ছে

তপন বিশ্বাস ॥ দেশে শিক্ষার হার শতভাগে উন্নীত করতে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাকে স্কুল ফিডিং কর্মসূচীর আওতায় আনা হচ্ছে। এতে হাওড়, বাঁওড়, পার্বত্য এলাকা, চা বাগান, উপকূলীয় এলাকাকে প্রাধান্য দেয়া হবে। পাউরুটি, দুধ, বিভিন্ন ফল, আমড়া, কলা পেঁয়ারা, ডিম, ডাল, সবজি, খিচুড়িসহ বিভিন্ন খাবার পরিবেশন করা হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের টিকা, ভিটামিন ট্যাবলেট, কৃমিনাশক ওষুধ, রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তোলা হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় স্কুল ফিডিং নীতিমালা-২০১৯ আজ মন্ত্রিসভায় উঠছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, স্কুল ফিডিং অতীতে ক্ষুদ্র পরিসরে চললেও এখন সরকার এ কর্মসূচীর কলেবর আরও বৃদ্ধি করবে। ২০১১ সাল থেকে দেশের ৯৩টি জেলায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচী চালু করা হয়েছে। ৩২ লাখ ৩১ হাজার শিশু এ কর্মসূচীর সুফলভোগী। বর্তমানে জনপ্রতি বিশেষভাবে প্রস্তুত পুষ্টিকর ৭৫ গ্রাম বিস্কিট সরবরাহ করা হচ্ছে। কিছু কিছু বিদ্যালয়ে পরীক্ষামূলকভাবে রান্না করা খাবার শিশুদের সরবরাহ করা হচ্ছে। সুষ্ঠু জাতি গঠনে সমৃদ্ধ শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে স্কুল ফিডিং কর্মসূচীকে সার্বজনীন কর্মসূচীতে রূপান্তর করতে চায় সরকার। আর তা করতে পারলে দেশের প্রতিটি প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা দুপুরের খাবার পাবে বিদ্যালয়ে। দুর্গমচর, হাওড়, উপকূলীয় অঞ্চল, পার্বত্য এলকা, চা বাগানসহ পিছিয়ে পড়া অঞ্চল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ কর্মসূচীর আওতাভুক্ত হবে। ২০২১ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী এ কর্মসূচী চালুর সরকারী পরিকল্পনা রয়েছে। সাংবিধানিকভাবে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে বিশ্রাম, বিনোদন এবং অবকাশ ভোগের অধিকার নাগরিকদের রয়েছে। নতুন এই নীতিমালা আজ সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের লক্ষ্যে উপস্থাপনের জন্য এজেন্ডাভুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার তেজগাঁওয়ের কার্যালয়ে এই সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। শিশুদের কি ধরনের খাবার দেয়া হবে তাও নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে। বিশেষ করে ভাত, খিচুড়ি, ডিম, ডাল, সবজি, ইত্যাদি খাবার তালিকায় থাকবে। এসব খাবার গ্রামের স্থানীয় কমিউনিটি ও শহরে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করবে। স্কুল চলাকালে প্রতিটি শিশুকে উপযুক্ত পরিমাণে পুষ্টিকর বিস্কিট সরবরাহ করা হবে। সেই ক্ষেত্রে সময়ে সময়ে স্বাদের পরিবর্তনের মাধ্যমে বৈচিত্র থাকতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিবেশন করা হবে। সেই ক্ষেত্রে পাউরুটি, শুকনো ফল, দুধ স্থানীয়ভাবে সরবরাহ করা হবে। মৌসুমি ফল বিশেষ করে কলা, পেয়ারা, আম, আমড়া স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ ও শিশুদের জন্য তা সরবরাহ করা হবে। খাদ্য তালিকা প্রস্তুতের সময় ভৌগলিক বাস্তবতাকে আমলে নেয়া হবে। সেই ক্ষেত্রে চরাঞ্চল, হাওড়, বাঁওড়, ও পাহাড়ী এলাকার বিষয়টি মাথায় রাখা হবে। মৌসুম যেমন বর্ষাকাল, শীতকাল, গ্রীষ্মকাল বিবেচনায় নেয়া হবে। এলাকার সঙ্গে পরিবেশ পরিস্থিতি আমলে নিয়ে খাবারের ধরণ, স্বাদ ও রুচি বিবেচনায় নিয়ে খাদ্য প্রস্তুত করা হবে। উন্নয়ন সহযোগী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী সংগঠনসহ অন্যান্য অংশীজন কর্মসূচী গ্রহণ থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সকল স্তরে সম্পৃক্ত হয়ে অর্থায়ন করাসহ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন। এ কর্মসূচীর মাধ্যমে সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার হবে। স্কুল ফিডিং কর্মসূচীর ফলে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা জীবন ও পুষ্টি বিষয়ে সম্যক ধারণা পাবে। তারা খাদ্যের পুষ্টিমান ও খাবার গ্রহণের বিষয়ে সচেতন হবে। বিভিন্ন রোগের টিকা, ভিটামিন এ ট্যাবলেট, কৃমিনাশক ওষুধ, রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপদ পানি পানের বিষয়ে তারা সচেতন হবে। খাদ্য তালিকায় শাকসবজি রাখা এবং তা উৎপাদনে সচেতন হবে। এ নীতিমালায় বলা হয়েছে, দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল ভিত্তি হচ্ছে শিশু জনগোষ্ঠী। যারা প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে লেখাপড়া করছে। খাদ্য সহায়তার ফলে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা পুষ্টিহীনতা থেকে মুক্তি পাবেন। শিশুদের বিদ্যালয়ে অবস্থান ও ক্ষুধা নিবারণে স্কুল ফিডিং কর্মসূচী বিশেষ অবদান রাখবে। চলমান কর্মসূচীর ফলে ড্রপ আউট ও নীরব চ্যুতি অনেক কমে আসছে। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে সব ধরনের বৈষম্য নিরসন, খাদ্য নিরাপত্তা বলয় বৃদ্ধি পাবে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। ২০২১ সালের মধ্যে সরকার দেশের সকল প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়কে এ কর্মসূচীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যা শিশুদের শিক্ষার অধিকার, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বিশাল এ কর্মযজ্ঞ পরিচালনার জন্য একটি সমন্বিত নীতিমালা থাকা জরুরী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের সকল প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় এ কর্মসূচীর আওতায় আনা এবং তা সফলভাবে চালু রাখতে সরকারী সহায়তার পাশাপাশি স্থানীয় বিত্তশালীরা সহায়তা করতে পারবেন। সমাজের দানশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চাইলেই তাদের দান অনুদানে স্কুলের ছেলে মেয়েদের খাবারের জন্য অর্থ সরবরাহ করতে পারবেন। সরকারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই সরকার ধাপে ধাপে এর আওতা বাড়ানোর চিন্তা করছে। সেই ক্ষেত্রে খাদ্য ঘাটতির এলাকগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসূচীর আওতায় আসবে। অর্থসামাজিক ও ভৌগলিকভাবে অনগ্রসর এলাকাকে প্রধান্য দেয়া হবে। স্কুল ফিডিং কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে একটি সেল গঠন করা হবে। প্রয়োজনে একটি কর্তৃপক্ষও গঠন করা হতে পারে। এ কর্মসূচী বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণের জন্য একটি উপদেষ্টা কমিটি থাকবে। সরকার সমাজের যে কোন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি পদে নিয়োগ দিতে পারবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দিষ্ট মেয়াদে উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি নিয়োগ দেবে। এ কমিটির কাজ হচ্ছে কর্মসূচী বাস্তবায়নে সব ধরনের পরামর্শ দেয়া। বিদ্যালয়ভিত্তিক এ খাদ্য কর্মসূচীর সফল বাস্তবায়নে সরকার বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর কারিগরি সহায়তায় একটি গবেষণা কেন্দ্র চালু করবে। তারা কর্মসূচীর বিভিন্ন দিক ও বিভাগ নিয়ে গবেষণা করবে। ওই কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যায়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা হবে। উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান স্কুল ফিডিং কর্মসূচী নিয়ে গবেষণা এবং পরামর্শক হিসেবে কাজ করবে। অর্থায়ন, সম্পদের কার্যকর ব্যবহার, কর্মসূচীর গুণগতমান রক্ষা, কর্মসূচীতে প্রয়োগ করা যায় এমন পদ্ধতি উদ্ভাবন করবে। গবেষণা কেন্দ্রটি বিশ্বব্যাপী এ সংক্রান্ত ভাল অনুশীলন, উত্তম প্রয়োগ সমূহের রিসার্স সেন্টার হিসেবে কাজ করবে। স্কুল ফিডিং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল প্রতিষ্ঠানকে তথ্য সরবরাহ করে সহায়তা করবে। গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিত করবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সময়ে এ নীতিমালা পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংশোধন করবে। অর্থ, কৃষি, পরিকল্পনা, স্থানীয় সরকার, খাদ্য, শিল্প, বাণিজ্য, মহিলা ও শিশু, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহ জাতীয় স্কুলভিত্তিক খাদ্য সহায়তা নীতিমালা ২০১৮ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের কর্মকর্তারা এ কর্মসূচী বাস্তবায়নের অর্থের উৎস হিসেবে সরকারী বরাদ্দ প্রথমেই থাকবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, পাশাপাশি বিভিন্ন পরিসেবার সারচার্জ, লেভি আরোপ, দাতা সংস্থা থেকে পাওয়া অর্থে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া স্থানীয় সরকার তহবিল, কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিট, বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, কমিউনিটিভিত্তিক সংগঠন ও অভিবাকদের অংশগ্রহণ থেকেও অর্থ নেয়া হবে। সরকার বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ রাখবে। পাশপাশি বার্ষিক ব্যয় ও সম্ভাব্য অর্থের উৎস নির্ধারণ করতে পারবে।
×