ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গতবারের মতো পশুর সঙ্কট এড়াতে অনেকে আগেই কিনছেন

হাটে ভিড় বেড়েছে ক্রেতার, বিক্রিও জমজমাট

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ১০ আগস্ট ২০১৯

 হাটে ভিড় বেড়েছে  ক্রেতার, বিক্রিও  জমজমাট

ওয়াজেদ হীরা ॥ হাট হাট হাট। রাজধানীজুড়ে পশুরহাটে চলছে কেনাকাটা। গত বছরের মতো শেষের দিকে পশু সঙ্কটের ভোগান্তি এড়াতে আগে আগেই পছন্দের পশু কিনতে সব হাটে ক্রেতার ভিড়। পছন্দের গরু-ছাগল কিনে ক্রেতার মুখে যেমন হাসি তেমনি দাম পেয়ে উচ্চমূল্যের অভিযোগ থাকলেও পাল্টা সুরে বিক্রেতারা বলছেন গরু পালনে খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ বেশি। যদিও এসব বিষয় নিয়ে থেমে নেই বেচাকেনা। সময় যত গড়াবে বিক্রি আরও বাড়বে। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে সরকারী ছুটি। শুক্রবার সকাল থেকেই রাজধানীতে বসবাসরত মানুষ অনেকেই ধরেন বাড়ির পথ। আর যারা রাজধানীতে থাকছেন তারা ধরেন গরুর হাটের পথ। হাটে হাটে দেখা যায় মানুষ আর মানুষ। সকালের দিকে ক্রেতা কিছুটা কম উপস্থিতি মনে হলেও বিকেলের দিকে উপস্থিতি বাড়তেই থাকে। সন্ধ্যার পর ব্যাপক ক্রেতা সমাগম হয় বিভিন্ন হাটে। যদিও গরুর হাটে ‘ধাক্কাধাক্কি’র ভিড়টি এখনও চোখে পড়েনি। আজ শনিবার রাতের বিক্রিতে সবচেয়ে বেশি ভিড় হবে বলেও বিক্রেতারা মনে করছেন। রাজধানীর মোট ২৪টি পশুর হাট এবার। অধিকাংশ ক্রেতাই কমপক্ষে দুটি হাট ঘুরে গরু কিনছেন। একহাটে গরুর দাম দেখছেন, অন্যহাটে গরু দামে হলেই নিয়ে নিচ্ছেন। রাজধানীর মেরাদিয়া হাট, রূপনগর হাট, শাজাহানপুর হাট, তেজগাঁও হাটে জমজমাট বিক্রি দেখা গেছে। এছাড়াও রাজধানীর গাবতলী, আফতাবনগর, কমলাপুর হাটে দেখা গেছে এখনও গরু রাখার মতো অনেক জায়গা খালি রয়েছে। ইজারা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক গরু এখনও পথে রয়েছে। আশপাশ জেলার গরুগুলো শনিবার রাতে প্রবেশ করবে। তবে গরুর চড়া দাম নিয়ে অনেকটা অভিযোগ অধিকাংশ ক্রেতার। রাজধানীর ইস্কাটনের বাসিন্দা তারিফুর রহমান শাজাহানপুরের হাট থেকে গরু কিনেছেন। বেশি দাম হলেও তিনি বলেন, গতবার শেষের দিকে হঠাৎ গরুর সঙ্কট হয়। এই সুযোগে কিছু বিক্রেতা উচ্চমূল্যে বিক্রি করেছেন। আমিও অনেক টাকায় কিনেও পছন্দের রঙের গরু পাইনি। এবার আগেই কিনলাম। মগবাজারের বাসিন্দা কমলাপুরের হাটে বলেন, হাটে আসার আগে ভেবেছিলাম হাটে মানুষ মনে হয় কম। এখন তো গরু কেনার কথা নয়। কারণ গরু রাখা বা দেখাশোনা করা আমাদের রাজধানীবাসীর জন্য কষ্টকর। হাটে এসে মনে হলো আমিই দেরিতে এসেছি। অনেকেই কিনে বাড়ির পথ ধরেছেন। কয়েকটি বাজারের একাধিক ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর ঈদের আগেরদিন হঠাৎ করেই কয়েকটি বাজারে গরুর সঙ্কট দেখা যায়। যদিও সেটি বেশিক্ষণ ছিল না। তবে যতক্ষণ এই সঙ্কট ছিল কিছু ব্যবসায়ী তাদের গরু নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে ক্রেতাদের অনেকটা বাধ্যই করেছেন কিনতে। সেই অভিজ্ঞতার কথা এ বছর অনেকেই ভুলে যাননি। যদিও রাজধানীর বাসিন্দাদের গরু রাখার জায়গার কারণে সবাই শেষের দিকেই কিনতে চায়। কেননা গরুকে নিয়ম করে খাওয়ানো, গোসল করানো কিংবা পর্যাপ্ত দেখভাল করার অভিজ্ঞতা না থাকা একটা কারণ। আবার বাসার নিচে থেকে আগে গরু কিনলে গরু চুরি হওয়ারও শঙ্কা থাকে। ফার্মগেটের বাসিন্দা সাজ্জাতুল ইমরান সরকার জানান, গতবার কোরবানির গরু কেনার পর নিজের বাসার নিচ থেকে চুরি হয়। তাকে আবার গরু কিনে কোরবানি দিতে হয়েছে। তবুও তিনি এবার আগেই গরু কিনতে হাটে আসেন। পছন্দের গরু কিনে বলেন, দশটি দেখে একটি কিনব সে জন্যই আগে কিনি। গতবারও আগেই কিনেছিলাম, ভাগ্যটা ভাল ছিল না। আবার শেষে যেটা কিনলাম সেটি আমার পছন্দ না হলেও গরু ছিল বাজারে কম। ছুটির দিন সকাল থেকেই ক্রেতাদের সমাগমে হাট যেমন জমে উঠেছে তেমনি হাসি ফুটেছে বিক্রেতাদের মুখেও। বিক্রেতারা মনে করছেন গরু আগে থেকেই বিক্রি হলে কম হোক বেশি হোক কিছুটা লাভের আশা থাকে। কুষ্টিয়ার বিক্রেতা নাজমুল হোসেন গাবতলীর হাটে ১২টি গরু এনেছেন। শুক্রবার ৪টি গরু বিক্রি হয়েছে বিকেল পর্যন্ত। তিনি বলেন, আমার সঙ্গে যারা এসেছে সবারই কম বেশি একটি দুটি করে বিক্রি হয়েছে। এটা অবশ্যই আমাদের ভাল লাগে। এরকম বিক্রি হলে শনিবারের মধ্যেই বাড়ি চলে যেতে পারব। আফতাব নগর হাটে দেখা গেল সকাল থেকেই মানুষের ভিড়। কেউ দেখছেন, কেউ দাম জানতে চাচ্ছেন। বগুড়ার বেপারি আসাদুল তিনটি গরু এনেছিলেন। সবগুলো বিক্রি শেষ হলেও সঙ্গীদের কারণে যেতে পারছেন না। তবে আশা করছেন ঈদ বাড়িতে করতে পারবেন। তার চার সঙ্গীর ১৬টি গরুর মধ্যে এখনও ১০টি রয়ে গেছে। আসাদুল বলেন, আমার নিজের একটি গরু ছিল আর দুটি কিনে এনেছিলাম। কেনা গরুতেও কিছুটা লাভ হয়েছে বলে জানান। একাধিক বিক্রেতা জানান, বর্তমানে গরুর বাজার মোটামুটি ভাল। তবে ক্রেতারা বলেছেন উচ্চমূল্যের কথা। বিক্রেতারা বেশি দাম চাচ্ছেন এবং গরু ছাড়তে চাইছে না সেটিও বলছেন ক্রেতারা। একাধিক বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান বাজারে ভূষির দাম, খৈলের দাম, চাউলের কুড়া, চাউল ভাঙ্গা বা খড় সবকিছুই এতো মূল্য বেশি যে কারণে গরুর মূল্যও বেশি। এছাড়াও রয়েছে পরিবহন খরচ, লেবার খরচ। যে কারণে গরুর দাম খুব একটা কম হবে না বলেও জানান বিক্রেতারা। রাজধানীর কমলাপুর পশুর হাটে তোলা হয়েছে সাড়ে ৩০ মণ ওজনের ষাঁড়, বিক্রেতা তার নাম দিয়েছেন ‘বাহাদুর’। ‘বাহুবলী’ নাম দেয়া হয়েছে আরেকটির, তার ওজন সাড়ে ২৭ মণ। হাটে আসা অধিকাংশ ক্রেতার নজরে কাড়ছে ষাঁড় দুটি। ৩০ মণের ষাঁড়টির দাম হাঁকা হচ্ছে ১৪ লাখ টাকা। আর সাড়ে ২৭ মণের গরুটির দাম ১৩ লাখ। গরু দুটি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে আনা হয়েছে বলে জানা গেছে। বিক্রেতা ফিরোজ হাসান অনিক বলেছেন, বাহাদুরের দাম আমরা ১৪ লাখ টাকা চেয়েছি, এখন পর্যন্ত সাড়ে ৮ লাখ টাকা বলেছেন ক্রেতারা। তবে ১৩ লাখ টাকা হলে বিক্রি করব বলে প্রত্যাশা আছে, বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। শুক্রবারও পশুবাহী অসংখ্য ট্রাক হাটে হাটে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। ইজারাদার সূত্রে জানা গেছে শনিবার রাতেও অনেক পশুর ট্রাক আসবে। গরুর মতো ছাগল/খাসি বিক্রিও বেড়েছে। বৃহস্পতিবারের তুলনায় কয়েকগুণ বিক্রি বেড়েছে বলে জানা গেছে। আবার কেউ গরু পরে কিনবেন তাই আগে খাসি কিনে নিচ্ছেন। হালিম ভূইয়া নামের ক্রেতা তেজগাঁও পলিটেকনিক মাঠের হাট থেকে খাসি কেনেন। তিনি বলেন, গরু কিনব ঈদের আগের রাতে। গরু রাখতে অসুবিধা তবে খাসি রাখতে সমস্যা নয়। ৪২ হাজার টাকায় খাসি কিনেন তিনি। বলেন গরুর মতো খাসিরও অনেক দাম। সবকিছুরই তো দাম কি আর করার। এই হাটের ছাগল/খাসির বাজারে দেখা যায় ক্রেতাদের উপস্থিতি বেশ। দরদামও হচ্ছে ভাল। তবে দাম ছাড়নে না বিক্রেতারা সেটিও বলেন কেউ কেউ। তেজকুনিপাড়ার বাসিন্দা আলী হোসেন বলেন, যদি কম দামের খাসিও কেনেন তাও দশ হাজারের ওপরে আর দেখলে মনে হবে এটি একটি বাচ্চা। একটু বড় খাসি কিনতে গেলে কমপক্ষে ত্রিশের ওপরে উঠতে হবে। দাম আরেকটু কমতে পারে বলেও আশা করেন তিনি। হাটে কড়া নিরাপত্তা ॥ ঈদ উপলক্ষে পশুর হাটে লাখো মানুষের সমাগমে লেনদেন হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। বিগত বছরের মতো এবারও পশুর হাটগুলোতে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হাটের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এবার সমন্বিতভাবে কাজ করছে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও এলিট ফোর্স র‌্যাব। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, হাটে যে কোন ধরনের নাশকতা এড়াতে হাট ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইজারাদারদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ডিএমপি। এ ছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ডিএমপির বিভিন্ন বিভাগের পুলিশের উপ-কমিশনারদের (ডিসি) সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করার পর এ নিরাপত্তা পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। নিরাপত্তা পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যেকটি হাটে পুলিশের কন্ট্রোল রুম এবং সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। জাল টাকা শনাক্তে স্থাপিত পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসানো হয়েছে ইলেকট্রিক মেশিন এবং প্রজেক্টর। প্রজেক্টরে জাল টাকা ও অজ্ঞান পার্টি থেকে নিরাপদ থাকতে পুলিশের নির্মিত সচেতনতামূলক প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ হাট ও জনসমাগম এবং লেনদেন বিবেচনায় প্রায় প্রতিটিতে ১০০ থেকে ২৫০ পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। হাট ও হাটের আশপাশে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মোতায়েন রয়েছে সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরা। ১০০ ফুট অন্তর বসানো হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। দূরবীন হাতে হাটের সার্বক্ষণিক চিত্র পর্যবেক্ষণ করছেন পুলিশ সদস্যরা।
×