অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ আজ ৭ জিলহজ ১৪৪০। সৌদি আরবের আকাশে যখন ৯ জিলহজ। এদিন বিশ্বজাহানের সর্ববৃহৎ মানব সমাবেশ পবিত্র হজ অনুষ্ঠানমালার প্রধানতম দিবস ইয়াওমুল আরাফা বা আরাফার দিন। আরাফা একটি বহুল পরিচিত ঐতিহাসিক পরিভাষা ও পবিত্র স্থানের নাম। মক্কা মসজিদুল হারাম থেকে সোজাসুজি প্রায় ৯ মাইল ব্যবধানে এক উপত্যকাময় বিশাল ময়দান। এদিন এখানে লোকে লোকারণ্য। সাদাশুভ্র ইহরামের পোশাক পরা মজনু নারী-পুরুষ হাজীদের পদভারে উদ্বেলিত এ উপত্যকা। লক্ষ লক্ষ অগুনতি হাজীদের উত্তাল সাগরে আমি ও আমার কাফেলার লোকজন নির্ধারিত একটি তাঁবু বা খিমায় অবস্থানরত আজ। আজ এখানে স্থাপিত আছে এক এক আরব মুয়াল্লিমের নিয়ন্ত্রণে এক একটি বিশাল মাকতাব বা অঞ্চল। প্রতিটি অঞ্চলে অসংখ্য সামিয়ানা টাঙানো। মূলত এখানেই হাজীরা আশ্রয় নিয়ে আছে। হাজীদের আরেকটি বিশাল অংশ মসজিদে নামিরাকে ঘিরে আছে ইমাম সাহেবের খুতবা শোনার জন্য। মজনু দলের আরেকটি অংশ বসে আছে জাবালে রাহমাতে বা রাহমাতের পাহাড়ে, যেখানে আজ থেকে ১৪শ’ বছর আগে আমাদের নবীজী বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। আর বিশালকায় রাস্তাগুলোও লোকে লোকারণ্য। সবার মুখে যেন সেই মধুর আওয়াজ লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক. . .। আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার . . .। খোদাতায়ালার মহিমা কীর্তনের অতুল সুমধুর সুর ও সমাবেশ এটি। এখানে লক্ষ লক্ষ হাজীকে একটু স্বস্তি দিতেও সৌদি সরকারের কার্পণ্য নেই। সযতেœ সৃষ্টি করা হয়েছে নিম গাছের বাগান। আর উপর থেকে হেলিকপ্টার ও ফোয়ারার মাধ্যমে বর্ষিত হচ্ছে শীতল জলরাশি, হাদিয়া দেয়া হচ্ছে নানা পানাহার, ছাতা, কম্বল ইত্যাদি।
আরাফা মানে পরিচয়, পরিচিতি ও পরিচয়ের স্থান। পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী আদম-হাওয়া (আ.) বেহেশত থেকে দুনিয়ায় প্রেরিত হয়ে আদম শ্রীলঙ্কার পাহাড়ে অপরজন জেদ্দা উপকূলে প্রায় দুই শ’ থেকে আড়াই শ’ বছর কান্নাকাটি করার পর এ আরাফার ময়দানে পরস্পরের সাক্ষাত ও পরিচয় ঘটেছিল। এরপর থেকে এ ময়দানের নাম আরাফা। পরবর্তীতে হজের জন্য হযরত ইবরাহীমসহ অসংখ্য নবী-রাসুল এখানে এসেছেন। আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এ ময়দানের জাবালে রাহমাতে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তার বিদায় হজে। এ বরকতপূর্ণ ময়দানেই আল্লাহ হাশরের বিচার সম্পন্ন করবেন। আজ তাই আমরা এখানে আসতে পেরে বড় শোকরগুজার, অনুপ্রাণিত, উদ্দীপ্ত। এখানে যেন আমরা সবাই আরাফাতী ভাইবোন। একেকজনের ভাষা ভিন্ন হতে পারে কিন্তু অনুভূতি ও ইবাদতে সবাই অভিন্ন। হুজুর (সা.) বলেছেন, আল ্হাজ্জু আল আরাফা। অর্থাৎ হজ মানেই আরাফা দিবস। তাই যে যেখানেই পারছে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার কাছে প্রার্থনা, ফরিয়াদ ও রোনাজারিতে মত্ত। একই সঙ্গে একটি অজানা উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কা কাজ করছে সবার মনে মনে। কিভাবে সূর্যাস্তের পর বিশাল জনসমুদ্র ডিঙিয়ে মুযদালিফায় পৌঁছবে, গাড়ি পাবে কিনা, গাড়ি পেলেও সিট পাবে কিনা। গাড়িতে হোক অথবা পায়ে দলে অসংখ্য রাস্তা মাড়িয়ে মিনার তাঁবু বরাবর অবস্থান করা যায় কিনা!
এভাবে সত্যিকার অর্থে ইবাদত, বন্দেগী, খোদাতায়ালার মাগফিরাত ও দিদার লাভের তামান্না সর্র্বোপরি নিঃসরিত পেরেশানি ও উৎকণ্ঠা স্মরণ করিয়ে দেয় আখিরাতের হাশরের ময়দানে নানা ব্যতিব্যস্ততা ও জবাবদিহিতার কথা। হাদিস শরীফে আছেÑ আল্লাহ ধূলিমলিন ইবরাহিমী মজনুতে পরিণত অনাহার, অর্ধাহার ও রোগশোক, সফরের ক্লান্তিতে শ্রান্ত এসব হাজীকে ক্ষমার চাদরে আচ্ছাদিত করেন।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: