ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবারও পুরনো মিথ্যাচার ও ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ!

প্রকাশিত: ০৯:২২, ৭ আগস্ট ২০১৯

আবারও পুরনো মিথ্যাচার ও ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ!

কাপুরুষদের অস্ত্র সব সময়ই মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্র। এদেশে গুজবের ক্ষেত্র ও পরিধি কত বড় তার প্রমাণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসুস্থতা বিষয়ক গুজব! আমার ধারণা আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনেকে পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও দ্বিধায় পড়েছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অরাজকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা ধারাবাহিতভাবে মিথ্যাচার করে, তাদের কথা অনেকে বিশ্বাস করছেন, এটি শুভ লক্ষণ নয়! অনলাইনকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে যে পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে তা নিয়ে আমাদের সচেতনতা, সতর্কতা ও সক্ষমতা কতটুকু রয়েছে তা বোধহয় ভাবা প্রয়োজন। যে প্যাটার্নে উস্কানি ও অপপ্রচার চলছে তা গভীর কোন ষড়যন্ত্রের আভাস দিচ্ছে! সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকের মাঝে যে কট্টর সাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি দেখা যায় তাতে আমাদের মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে কি-না আশঙ্কা হয়! এর ইন্ধন দাতাদের দ্বৈতনীতিকে অনুসারীরা চোখ মেলে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না! ডোনাল্ড ট্রা¤েপর কাছে দেয়া প্রিয়া সাহার অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় এ দ্বৈতনীতি আরও সু¯পষ্টভাবে দেখা গেছে। প্রিয়া সাহার প্রতিবাদ আওয়ামী লীগ থেকেই প্রথম হয়েছিল। কিন্তু এ ইস্যুতে দেশপ্রেমের কথা বলে ভারত ও হিন্দু বিদ্বেষী যে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চলেছে তা কপটতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এই তো সেদিনের কথা, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ওয়াশিংটন টাইমসে কলাম লিখে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন। সাবেক বিচারপতি সিনহা, নরেন্দ্র মোদির কাছে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সহায়তা চেয়েছিলেন। ফটোগ্রাফার শহীদুল আলমের রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য প্রিয়া সাহার চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর ছিল। জামায়াত নেতৃবৃন্দ জাতিসংঘ, ওআইসি ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছিল। বিএনপি, জামায়াত ও খেলাফত মজলিসের উদ্যোগে লন্ডনে আয়োজিত এক সভায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করা হয়েছিল। এমন আরও দৃষ্টান্ত দেয়া যাবে। উল্লিখিত দেশবিরোধী কোন ঘটনায় যারা ন্যূনতম প্রতিবাদ জানায়নি, তারা আজ দেশপ্রেমিক হয়ে গেছে- এমন বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়েছে, কিন্তু এ উত্তরণ আমাদের মানবিক বিকাশে কতটুকু ভূমিকা রাখছে জানি না! সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেককে দেখছি জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছে। আমাদের মূল্যবোধের এতটা অধঃপতন হবে তা কিছুকাল আগেও ভাবা যেত না। জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন’, এ ছাড়া আরেক গানের কলি উল্লেখ করে বলা হচ্ছেÑ এ গানে ‘তোমার তরে ঠেকাই মাথা’ এমন শিরকপূর্ণ কথা আছে। ওনারা মাটির পরিবর্তে দেয়ালে, ছাদে, গাছে মাথা ঠেকানোকে সঠিক মনে করেন জানি না, তবে সাহিত্য বোঝার মতো জ্ঞান না থাকলে তা নিয়ে কথা না বলাই ভদ্রতার পরিচায়ক। এ প্রজন্মের একটি অংশ জাতীয় সঙ্গীত জানে না এবং এ গানে কি আছে তা না জেনেই পরিবর্তনের দাবি করছে। সোনার বাংলা গানে যেখানে বাংলাকে মা বলা হয়েছে, তা বিকৃত করে মা বলতে কোন দেবীকে বোঝানো হয়েছে (!) - এমন মিথ্যাচার চলছে। এ জাতীয় অপপ্রচার অত্যন্ত নিন্দনীয় ও দেশদ্রোহিতার শামিল। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছিলেন না, এটাও নব্য জেহাদীদের কেউ জানে না! মাতৃভূমিকে তারা কবে পিতৃভূমি দাবি করবে কে জানে! রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করার অপপ্রচার পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসছে। কথা সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক কুলদা রায় লিখেছেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত একটি বইয়েও কোন সূত্র ছাড়া এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছিল, যা অনেকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন। রবীন্দ্রনাথের ঢাবি প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার কথা শুধু বাংলাদেশ নয়, কলকাতায় কেউ কেউ এমন দাবি করেন। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্র গবেষক ও সাহিত্য বিশারদরা সকলেই বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতা ছিল না এবং এর দালিলিক প্রমাণও পাওয়া যায়। ১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছিল। ১৯৩৬ সালে তাকে ডিলিট উপাধি দেয়া হয়েছিল। এ সম্মাননা কি বিরোধিতা করার কারণে দেয়া হয়েছিল? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম প্রসঙ্গই বিবেচ্য ছিল না। কারণ, তখন এ অঞ্চলে মুসলিম : হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত ছিল প্রায় ৬০:৪০। নবাব সলিমুল্লাহ ও জগন্নাথ রায় চৌধুরীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পঞ্চাশের দশকেও ডাকসুর পদ বন্টন হতো হিন্দু-মুসলিম শিক্ষার্থীদের আনুপাতিক হারে। ধর্ম বিবেচ্য ছিল না বলেই মাওলানা আকরাম খাঁর মতো অনেক মুসলিম ব্যক্তিত্ব ঢাবি প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দিন ‘বন্দে মাতরম’ ও ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে মুখরিত ঢাকায় সর্বভারতীয় নেতারা হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ওপরই জোর দিয়েছিলেন। মিথ্যাচার ও অপপ্রচারকে ভিত্তি করে যে মহল স্বাধীনতার পর থেকে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে, তারা দেশ বা ধর্ম কোনটির প্রতিই শ্রদ্ধাশীল নয়। দেশ, দেশের মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধ স¤পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ধর্মের নামে যে অপরাজনীতি করে তাতেও তারা ধর্মকে মর্যাদার আসনে ঠাঁই দেয়নি। যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের সাক্ষী মিনা ফারাহর বিরুদ্ধে যারা ইসলাম বিদ্বেষী বই ‘গড অন ট্রায়াল’ লেখার কারণে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল, তাকে হেনস্তা করেছিল; যে মিনার বিরুদ্ধে মুসলিম সন্তানকে চিতায় পোড়ানোর প্রতিবাদে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে সমাবেশ হয়েছিল। রাসুলের বিরুদ্ধে কটূক্তিকারী সেই মিনা ফারাহ রাজাকারদের পক্ষাবলম্বন করায় পরমমিত্রে পরিণত হয়েছে! ইতালিয়ান সাংবাদিক অরিয়ানো ফালাচির মুসলিম বিদ্বেষ সারা বিশ্বে আলোচিত। ‘... সন্তানরা ইঁদুরের মতো বংশ বিস্তার করে’Ñ এমন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হিংসাত্মক মন্তব্য ছাড়াও তার বেশিরভাগ লেখাই ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে। সেই অরিয়ানো ফালাচিকে তারা আপন করে নিয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে ও শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লাখ নয় তা প্রমাণে! বিএনপি-জামায়াত ও তাদের অনুসারীদের অগণিত দৃষ্টান্ত দেয়া যায়Ñ যাতে প্রমাণ হয় তারা দেশ ও ধর্ম কোনটির প্রতিই শ্রদ্ধাশীল নয়। দেশ, দেশের মানুষ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কোন কিছুই তাদের কাছে নিরাপদ নয়। কিন্তু আশঙ্কা বিষয় হচ্ছে, অপপ্রচারের শিকারে পরিণত জনগণের একটি অংশ গুজবে প্রভাবিত হয়। অপপ্রচারকারী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি ও সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে এ অপতৎপরতা রোধ করা যাবে না। স্বাধীনতার আগে ইসলাম বিপন্ন হওয়ার দাবি তুলে জনগণকে প্রতারিত করা হতো, স্বাধীনতার পর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য হওয়ার জুজু। গত ৪৮ বছর ধরে এই ধুয়া তুলেই অপরাজনীতি চলেছে। সম্প্রতি জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে অন্যান্য ইসলামী দলের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাতে দেখা যাচ্ছে। দেশের চলমান উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে অশুভশক্তি যেভাবে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে, সে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র স¤পর্কে সরকার যত দ্রুত সজাগ হবে ততই মঙ্গল। লেখক : রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক [email protected]
×