ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথ যামিনী রে...

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ৬ আগস্ট ২০১৯

শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথ যামিনী রে...

মনোয়ার হোসেন ॥ তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি/সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি- আহা/নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে/আসব যাব চিরদিনের সেই আমি ...। আপন সৃষ্টির আলোয় এমন করেই তিনি বাঙালীর নিত্যদিনের সহচর। ভাব প্রকাশের ভাষা ও চৈতন্যে আলো-বাতাসের মতোই মিশে আছেন মননের গভীরে। পরিণত হয়েছেন প্রাণের মানুুষে। আজ মঙ্গলবার বাইশে শ্রাবণ কবিগুরুর ৭৮তম প্রয়াণবার্ষিকী। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে ছেড়ে যান প্রিয় পৃথিবী। বর্ষণমুখর কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ঘটে তার মহাপ্রস্থান। মহাপ্রস্থানের সাত দশক পেরিয়েও সৃজনের বৈভবে তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। পরোক্ষে বেঁচে আছেন বাঙালীর আবেগ-অনুভূতির মাঝে। তাই তো প্রয়াণ দিবসে সারাবিশ্বে বাঙালীরা শ্রদ্ধা-ভালবাসায় স্মরণ করবে বিশ্ব কবিকে। নানা অনুষ্ঠান-আয়োজনে কবির প্রতি প্রকাশিত হবে হৃদয়ের অনুরাগ। এক কথায় কবিগুরুই বাঙালীর আত্মপরিচয়। বাঙালীর চলন বলন, চিন্তা মনন কিংবা অনুভবÑ এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে রবীন্দ্র সৃষ্টিশীলতার ছোঁয়া পড়েনি। বলা চলে রবীন্দ্রনাথে ভর করেই বাঙালী প্রকৃত বাঙালী হয়ে ওঠে। বাঙালীর শিল্প-সংস্কৃতি বিনির্মাণের অগ্রপথিক এই কবি। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সঙ্গীতস্রষ্টা, নট ও নাট্যকার, চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। বিস্ময়কর প্রতিভার বিচ্ছুরণে কবিগুরু থেকে বিশ্ব কবিতে পরিণত হয়েছিলেন। তাই জন্মের দেড়শ বছর পরও শিল্প-সাহিত্যের সব শাখাতেই দীপ্যমান তিনি। আজও তার সৃষ্টিসমগ্র ভাবনার বীজ বুনে দেয় সংস্কৃতি অনুরাগীর হৃদয় গহনে। অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন সমাজ ব্যবস্থার রূপকার রবীন্দ্রনাথ আজও বাঙালীকে দেখায় সঠিক পথের নিশানা। বাঙালীর সকল সঙ্কট, আনন্দ-বেদনা ও পথ চলায় তিনিই সহায়। রবীন্দ্র সংস্কৃতির বহু ধারা ও সৃজনে স্নাত হওয়ার মাঝেই দীপ্যমান বাঙালীর অগ্রযাত্রা ও বিকশিত হওয়ার সাধনা। প্রত্যয়ী বাঙালীর যাত্রাপথের সব বাঁকেই রবীন্দ্রনাথ বিরাজমান। বাঙালীর প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণের সঙ্গে মিশে আছেন তিনি। এ কথার সুর ধরেই বলতে হয়Ñ আমার চোখে ঝলমলে দিন কিংবা নিকষ রাত/কেউ থাকে না সঙ্গে শুধুই আমার রবীন্দ্রনাথ। বাঙালীর সংস্কৃতিচর্চার অনিবার্য এক বাতিঘর রবীন্দ্রনাথ। মহাসমুদ্রের মতো বিশাল ও বিস্তৃত পরিসরের সৃষ্টির আলোয় সতত আলোকিত করেছেন বাঙালীর ভাবনার ভুবন। রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ জড়িত না থেকে পরোক্ষে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। ব্রিটিশ আমলে নানাভাবে ভারতীয় মধ্যবিত্তের মাঝে জাগিয়ে তুলেছেন স্বাধীনতার স্পৃহা। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের প্রতিবাদ করেছেন। প্রত্যাখ্যান করেছেন ব্রিটিশ সরকারের দেয়া নাইট উপাধি। বাঙালীর অখ-তা রক্ষায় সক্রিয় ও সোচ্চার অংশ নিয়েছেন বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলনে। এমনকি তার অসীম সৃষ্টি থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ। সমাজকল্যাণে ব্রতী হয়ে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। গ্রামোন্নয়ন ও পল্লীপুনর্গঠনেও রোমান্টিক এ কবির সাফল্য প্রবাদপ্রতীম। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে প্রতিষ্ঠা করেন কৃষি ব্যাংক। এসবের বাইরে সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও জানিয়ে গেছেন তীব্র প্রতিবাদ। তার দর্শন চেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে মানব কল্যাণের বাণী। বঙ্গীয় শিল্প-সাহিত্যের আধুনিকীকরণে নানা রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিষয় উপজীব্য করে রচিত হয়েছে তার উপন্যাস, ছোটগল্প, সঙ্গীত, নৃত্যনাট্য ও প্রবন্ধ। কবিতায় এনেছেন নতুন মাত্রা, দিয়েছেন প্রাণের ছোঁয়া। বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্র সাহিত্য। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে ১৯১৩ সালে প্রথম এশীয় ও প্রথম বাঙালী হিসেবে জয় করে নেন নোবেল পুরস্কার। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ জন্ম নেয়া রবীন্দ্রনাথ কৈশোর পেরোনোর আগেই বাংলা সাহিত্যের দিগন্তে এঁকে দেন নতুন রেখা। নিজেকে শাণিত করার সঙ্গে সঙ্গে পরিণত করেছেন বাঙালীর শিল্প-সাহিত্যকে। বাংলা ভাষার সর্বোচ্চ সমাদৃত এই কবি ও কথাশিল্পীর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খ-ে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্যÑ ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, আধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও দারুণ কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদ ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তার রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গান বাংলা সঙ্গীত ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছে প্রবলভাবে। তাই তো শতাব্দী পেরিয়ে বদলে যাওয়া সময়েও আপন অহঙ্কার-ঐশ্বর্যে তুমুলভাবে সমাদৃত রবীন্দ্রসঙ্গীত। এর আবেদন যেন কোন দিন ফুরোবার নয়। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাণী ও সুরের ইন্দ্রজালে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে বাঙালী। তাদের আবেগ অনুভূতি কবিগুরুর গানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় সঙ্গীতেরও রচয়িতা তিনি। লিখেছেন প্রায় দুই হাজার গান। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় সত্তর বছর বয়সে নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে তার আঁকা স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। রবীন্দ্র রং-তুলির আঁচড়মাখা চিত্রপটে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই প্রস্ফুটিত হয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে রবীন্দ্র সৃষ্টিতে প্রাধান্য পেয়েছে মানবতাবাদ। মানুষের ওপর ভীষণ আস্থাশীল কবি ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে লিখেছিলেনÑ ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’। মানুষের প্রতি ভালোবাসার টানেই জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত নাইট উপাধি বর্জন করেন ১৯১৯ সালে। রবীন্দ্রনাথের বহুল সমাদৃত গ্রন্থের মধ্যে গীতাঞ্জলি, গোরা, ঘরে বাইরে, রক্তকরবী, মানসী, বলাকা, সোনার তরী, পূরবী, শেষের কবিতা ইত্যাদি। কবিগুরুর কাব্য, ছোটগল্প ও উপন্যাস গীতিধর্মিতা, সহজবোধ্যতা, ধ্যানগম্ভীর প্রকৃতিবাদ ও দার্শনিক চিন্তাধারার জন্য প্রসিদ্ধ। বিশ্ববাসীর জন্য কবিগুরু উপহার দিয়ে গেছেন হৃদয়ে অনুরণন সৃষ্টিকারী কয়েক হাজার শ্রুতিমধুর গান। এভাবেই সাহিত্য ও শিল্পের মাধ্যমে সাহিত্য ও শিল্পানুরাগীদের সর্বোপরি বাঙালীর হৃদয়ের শিকড়ে বেঁচে আছেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বকবির প্রয়াণবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানিয়ে তার কবিতার চরণ ধরেই বলতে হয়Ñ তুমি যে তুমিই, ওগো/সেই তব ঋণ/আমি মোর প্রেম দিয়ে/শুধি চিরদিন ...। লেখালেখির পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তি নিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে তিনি সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোর আর উড়িষ্যায় জমিদারির তদারকি শুরু করেন কবি। সেই সূত্রে কুষ্টিয়ার শিলাইদহের জমিদার বাড়িতে বসেই তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন বিশ্বকবি। আজ বাইশে শ্রাবণ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্র প্রয়াণবার্ষিকীর সংবাদ। সরকারী-বেসরকারী প্রতিটি টিভি চ্যানেলে দিনভর থাকবে রবীন্দ্র সৃষ্টির নির্র্মিত নাটকসহ নানা অনুষ্ঠানমালা। বিকেল চারটায় একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি। অনুষ্ঠানে একক বক্তা অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
×