ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে সভ্যতার সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৯:৪২, ৬ আগস্ট ২০১৯

রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে সভ্যতার সঙ্কট

উনিশ শতকীয় নবজাগরণ, ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্যিক বৈভবে জন্ম নেয়া কবি রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক ভারতের যে নতুন সংস্কৃতি, পাশাপাশি ঘটে যাওয়া অনেক বিপর্যয় আর বিপত্তি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সময়ের গতি প্রবাহে আজও তা অসলিন। যুগের ক্রমবর্ধমান বিবর্তনে রবীন্দ্রনাথ সমাজের নানা স্তরে নব্য সংস্কৃতির অবাধ মিলন, সঙ্গে ভেতর থেকে গেড়ে বসা অনেক অসঙ্গতি আর দুর্ভোগ দূরদর্শী সমাজ গবেষকের মতো অনুধাবন করেছিলেন, তা যেমন প্রাসঙ্গিক, অদ্যাবধি অপরিহার্যও বটে। ১৯৩৬ সালে ‘কালান্তর’ প্রবন্ধ সঙ্কলনে অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের যে পর্যায়ক্রমিক সামাজিক অবয়ব, যার একটা ঐতিহ্যিক পথপরিক্রমা আছে, তার ওপর এক বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। ৭৫ বছর বয়সে লেখা এই গ্রন্থে কবি যুগ যুগ ধরে চলে আসা এক অচলায়তন সমাজ ব্যবস্থায় কিভাবে ব্রিটিশ রাজশক্তি তার নতুন সভ্যতার ধারক হয়ে এখানে আধিপত্য বিস্তার করে, তারও একটি সুচিন্তিত অভিমত স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। বহু রাজবংশের উত্থান পতন, উপজাতীয় সর্দারদের এ দেশে আক্রমণ আর জয়ী হয়ে রাজত্ব কায়েম করা, সেও এক ঐতিহাসিক পরম্পরার বাস্তব প্রতিবেদন। মুসলিম রাজবংশ এদেশে আধিপত্য বিস্তার করলেও সাংস্কৃতিক দ্যোতনা থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা এসব রাজাধিরাজ জনগণের মধ্যে কোন নব্য চেতনার বীজ বপন করতে ব্যর্থ হয়। নতুন চৈতন্যে নব সৃষ্টির যে উদ্যম তা কোন ভাবেই এদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ে সামান্যতম প্রভাব ফেলতে পারেনি। কবির ভাষায়, বাংলা ভাষায় পার্সি শব্দের আধিক্য সত্ত্বেও সাহিত্য-সংস্কৃতিতে প্রভাব ছিল না বললেই চলে। মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্য কিংবা বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের সমৃদ্ধ অঙ্গন তৈরিতে যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখে, আজও তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে যায়নি। রাজা-বাদশারা রাজত্ব করেছে বাহুবলে, শক্তি আর সৈন্য সামন্ত দিয়ে। ভেতরের যে অন্তর্নিহিত শক্তি, মনন-দক্ষতা সেটা ছিল একেবারেই উপেক্ষিত, অবহেলিত। তারা এসেছিল রাজ্য দখলের তাড়নায়। রাজ অধিপতি হয়ে শাসন করাই ছিল তাদের মূল দায়িত্ব। আর অন্যদিকে ব্রিটিশ প্রথমবারের মতো এলো নব্য ইউরোপের চেতনার প্রতীক রূপে। ইউরোপীয় সভ্যতার নবযুগের বার্তাবাহক হয়ে ব্রিটিশ রাজশক্তি শুধু সা¤্রাজ্য দখলের দিকেই মনোনিবেশ করেনি, তার চেয়ে বেশি দৃষ্টি দেয় নবজাগরণীয় ভাব সম্পদকে এদেশের মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করতে। তবে রবীন্দ্রনাথ অভিযোগ করেছেন যে, যন্ত্র সভ্যতার নব নব উদ্ভাবনে ইংরেজরদের সমৃদ্ধি শীর্ষে আরোহণ করলেও তার ছিটেফোঁটাও হতভাগ্য জনগোষ্ঠী পায়নি। আবিষ্কারের নতুন উপকরণ আর আমাদের দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া সম্পদের বিনিময়ে ইংরেজ ঐশ্বর্যের পাহাড় গড়েছে। সেখানে আমাদের এই নিঃসহায় জনগোষ্ঠী তার সমস্ত শক্তি, সম্বল আর ঐতিহ্যিক পরিম-লকে হারাতে বসেছে। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতা একটি দেশকে উন্নততর অবস্থানে পৌঁছে দিয়ে জীবনযাত্রার মানকে সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তেমন সভ্যতারই হরেক রকম অসঙ্গতি আমাদের মতো দুর্গত দেশের সামগ্রিক অবয়বে অসভ্যতার কালিমা লেপে দেয়। মানুষের মর্যাদায়, সভ্যতার মহিমায় সিংহভাগ অসহায় জনগোষ্ঠী তার সব মৌলিক অধিকার হারিয়ে বিপন্ন অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছে। কবি এমন কথা স্মরণ করতেও ভোলেননি যে, আমাদের মতো জমিদাররা সেই নিঃস্ব প্রজাদের অন্নেই পালিত। তাদের মহামূল্যবান শ্রমশক্তির বিনিময়ে অর্জিত সম্পদের মালিক তো আমরাই, যারা যথার্থ সভ্য সমাজের উচ্চাসনে বসে থাকে। ৮০ বছর বয়সে লেখা ‘সভ্যতার সঙ্কটে’ কবির আক্ষেপ অনেক বেশি। দীর্ঘ জীবনের নানা মাত্রিক অভিজ্ঞতায় বহু উন্নত দেশ ভ্রমণ করা কবি নতুন সভ্যতার জাপান, রাশিয়া, আমেরিকা, চীন দেশের মতো উন্নত বিশ্বকে দৃষ্টান্ত হিসেবে খাঁড়া করে কিভাবে তাদের এমন সমৃদ্ধি জনগণের দ্বারে পৌঁছে বিস্ময়ে, বেদনায় অনুভব করার চেষ্টা করেছেন। বিজ্ঞানের অবিস্ময়ণীয় জয়যাত্রায় জাপানের ক্রমাগত অগ্রগতির ধারায় অতি সাধারণ জনগোষ্ঠীর নিরবচ্ছিন্ন সম্পৃক্ততা দেশটি আজ উন্নয়নের শীর্ষ শিখরে। শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য, কর্ম, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে সর্বমানুষের অংশীদারিত্ব দেশটিকে আজ সকলের জীবনমান উন্নয়নের নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে স্পষ্ট করেছে। কবির নিজে দেখে আসা জাপানের সমৃদ্ধি সম্পর্কে তাঁর অভিমত ছিল, স্বজাতির মধ্যে তার সভ্য শাসনের রূপ, যেখানে সাধারণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার বিন্দুমাত্র খর্বিত হয় না। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের মতো সূচকগুলোতে সার্বজনীন ব্যবস্থার ভিত্তিতে সুশাসনের এক অকৃত্রিম উন্নত মানের স্তর রয়েছে সেখানে। এর বিরীতে আমাদের দেশের দুরবস্থা, সাধারণ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যবিড়ম্বিত অসহায় জীবন যখন কবির মনকে কষ্টে বিবর্ণ করে দেয়, তখন তিনি যান বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায়। ১৯৩০ সালের রাশিয়া ভ্রমণ কবির জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। রাশিয়ার চিঠিতে বলেছেন, না আসলে এক বৃহৎ ও মহৎ কর্মযোগ দেখা থেকে বঞ্চিত হতাম। রাশিয়ার ১৯১৭ সালের বিপ্লব অভ্যন্তরীণ কোন্দ্বল আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ্রাসন সামলাতে আরও কয়েক বছর কেটে যায়। তার পরেও ধরে নেয়া যেতে পারে প্রায় ১৩ বছর পর সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াকে নিজের মতো করে দেখার অভিজ্ঞতা। তেমন বর্ণনা রাশিয়ার চিঠিতে আছে ব্যাপকভাবে। তবে ‘সভ্যতার সঙ্কটে’ও রাশিয়াকে উল্লেখ করে তার সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে নতুনভাবে স্মরণ করেছেন। রাশিয়ায় জাতিভেদ, বর্ণভেদের চিহ্ন একেবারে বিলুপ্ত। সবাই মিলে মিশে প্রয়োজনীয় সামাজিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে এনে নিজেদের যেভাবে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তা শুধু বিস্ময় আর মুগ্ধতার ব্যাপার। রাশিয়াতে কিছু মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা আছে যাদের সঙ্গে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কোন বিরোধ নেই। এসব নিয়ে আলাপও হয়েছে কবির সঙ্গে। সবাই বলেছে এক সময় দ্বন্দ্ব- কোন্দ্বল, সংঘাত তাদের মধ্যেও ছিল। আজ তারা সব কিছুকে জয় করেছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়। রাশিয়াও বহু জাতিক রাষ্ট্র। কিন্তু সমতার বেষ্টনীতে সেখানে আজ আর কোন কিছুর মধ্যেই ফারাক নেই। কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ শ্রমজীবী কৃষক বৃহত্তর সমাজ ব্যবস্থার সিংহভাগ জুড়ে থাকলেও নিঃসম্বল, অসহায়, নির্জীব, অশিক্ষিত অর্থাৎ সব ধরনের অধিকার থেকে প্রায়ই বঞ্চিত। অথচ ইউরোপীয় সভ্যতার নবযুগ ভারত বর্ষকে যে মাত্রায় তার অনুবর্তী হতে প্রাণিত করে সেখানে অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ সুবিধা ভোগ করলেও ভেতর থেকে তারাও দুর্বল, পরজীবী এবং স্বজাতির প্রতি উদাসীন। কিয়দংশ মানুষের জীবনে সভ্যতার রশ্মি দ্যুতি ছড়ালেও সিংহভাগ অবহেলিত। পশ্চাদপদ অংশ তার ছোঁয়াও পায় না। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যে রায়ত সবার জন্য শস্য উৎপাদন করে তার জীবন এবং মানের কদর আমরা করতে পারি না সমাজের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে। নিজেরা রাজা সেজে রায়তদের প্রজা বানিয়ে কোন কূপম-ূক অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঠেলে দিই, তা বোঝার ক্ষমতা থাকলেও এমন শৃঙ্খলিত আমরা বিশেষ করে মনোবিকাশের ক্ষেত্রে, সেখান থেকে না পারি নিজেরা বেরুতে, তার চেয়েও বেশি অক্ষমতার পরিচয় দিই তাদের প্রতি সদয় আর সচেতন হতে। এই দীনতা আমাদের নিজেদের। অন্যের ঘাড়ে অপবাদ দিলে নিষ্কৃতি মিলবে না। কারণ মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সহজ মিলন, যা কোন সভ্যতার মূল শক্তি, তারই দুর্ভেদ্য অন্তরায় আমাদের সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় নিয়ে গেছে। শক্তি আর বিত্তের ফারাকই শুধু নয়, জাতি ধর্ম আর বর্ণের শৃঙ্খলিত বিভেদে আজ আমরা যথার্থ সভ্যতাকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়েছি। যা অবলীলাক্রমে অতিক্রম করেছে উন্নত বিশ্ব। তাই সমস্যা বাইরে থেকে নয়, একেবারে অন্তর্নিহিত বোধ থেকে সেখানেই নিজেদের প্রমাণ করতে অনেক সময় লাগছে। তাই কবি মনে করতেন, ইংরেজ এই দেশ ছাড়লেও সর্ব মানুষের মুক্তি সহজে মিলবে না। পুরো সমাজের অভ্যন্তরে জগদ্দল পাথরের মতো যে ভেদবুদ্ধি, বৈষম্য, জাতিগত বিবাদ, ধর্মীয় হানাহানি, অর্থবিত্তের আকাশ ছোঁয়া ফারাক তাকে কঠিনভাবে আঘাত করতে না পারলে সর্বজনীন সামাজিক অবয়ব কখনও সভ্যতার পূর্ণ আঙ্গিকে দৃশ্যমান হবে না। দেশটা শুধু ধর্মে নয়, জাতিতে-বর্ণে আর বিত্তের যে অসম কাঠামো, তাকে কিভাবে অতিক্রম করা যাবে? জীবদ্দশায় তা তিনি দেখে যেতে পারেননি। মৃত্যুর ৭৮ বছর পরও আমরা তাঁর কোন যথার্থ প্রতিকার আজ অবধি দেখতে পাই না। অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ দীর্ঘ জীবন পাওয়া কবি গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষদের চরম দুর্গতি যেমন দেখছেন, পাশাপাশি ভারতীয় সমাজের উচ্চাসনে বসা আধিপত্যকারী গোষ্ঠীকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। আবার বিদেশ ভ্রমণ করেও সরাসরি অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উন্নত সমাজ ব্যবস্থাও দেখে এসেছেন। তুলনা করতে গিয়ে কষ্ট পেয়েছেন। এমন অভিব্যক্তিও তাঁকে বিদ্ধ করেছে যে, রাশিয়া এবং জাপানের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী কিছু আগেও আমাদের দেশের অসহায় মানুষদের মতোই ছিল। কি করে তারা সবকিছুকে জয় করল? শিক্ষা, প্রযুক্তি বিদ্যার ক্রমোন্নয়নে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সমতাভিত্তিক সর্বজনীনতার সমন্বিত বোধ, যা সর্বমানুষের মিলিত সম্পর্কের এক অবিমিশ্র কর্মদ্যোতনা। ভেদ আর পার্থক্যের পাহাড় যত কঠিন হবে, মিলনের পথও সেভাবে রুদ্ধ হয়ে যাবে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা পথনির্দেশক। কিন্তু শুধু তাদের কারণেই বৃহত্তর অর্জন হয় না। সর্বমানুষের মিলনসুরে অগ্রগতির জয়গান ধ্বনিত না হলে প্রাপ্তি কখনও সম্পূর্ণ হয় না। যা একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের ক্রান্তিলগ্নেও আমরা প্রত্যক্ষ করছি। সে জন্য আজও কবির প্রাসঙ্গিকতায় আমরা বিস্মিত হই। লেখক : সাংবাদিক
×