ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিন্দাবাদের ভূত!

প্রকাশিত: ০৯:৪০, ৬ আগস্ট ২০১৯

সিন্দাবাদের ভূত!

বাংলাদেশের পোশাক খাতের সংস্কার তথা নিরাপত্তা ইস্যুতে ইউরোপীয় ক্রেতাদের পরিদর্শক জোট এ্যাকর্ড যেন অনেকটা সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসেছে পোশাক শিল্প মালিকদের ঘাড়ে। দেশের প্রায় সব কারখানার আধুনিকায়ন তথা সংস্কার প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে এসে আরোপ করছে নতুন নতুন শর্ত। ফলে সমূহ বিপাকে পড়েছেন পোশাক শিল্পের মালিকরা। নতুন শর্ত আরোপ করায় অন্তত চার শ’টি কারখানা ব্যবসা হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছে। এমনকি আমেরিকাভিত্তিক ক্রেতাদের জোট এ্যালায়েন্স কর্তৃক সনদপ্রাপ্ত পোশাক কারখানাকেও এখন চাপ দেয়া হচ্ছে এ্যাকর্ডের নতুন শর্ত অনুযায়ী আগে স্থাপিত যন্ত্রপাতি পরিবর্তনের জন্য। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, এ্যাকর্ডের পূর্বের নতুন শর্ত অনুযায়ী অগ্নিনির্বাপণের জন্য ৫০ হাজার গ্যালন পানির রিজার্ভারের বদলে এখন বলা হচ্ছে ৭০ হাজার গ্যালন পানির রিজার্ভার নির্মাণের। ফলে নতুন করে আর্থিক ঝুঁকি ও বিনিয়োগের সম্মুখীন হতে হবে মালিক পক্ষকে। পোশাক শিল্পের সংগঠন বিজিএমইএ-এর পক্ষ থেকে স্বভাবতই আপত্তি জানানো হয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা (এমওইউ) অনুযায়ী কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পারস্পরিক আলোচনার কথা থাকলেও এ্যাকর্ড একতরফাভাবে শেষ পর্যায়ে এসে টেস্টিং কমিশনিংয়ের নামে (চূড়ান্ত পরীক্ষা) নতুন নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপনের শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। ফলে অনেক কারখানা যথাযথ সংস্কারের পরও সনদ পাচ্ছে না এ্যাকর্ডের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স ফোরাম ফর আরএমজি মনে করছে ২০২১ সাল নাগাদ পোশাক রফতানি ছাড়িয়ে যাবে ৫০ বিলিয়ন ডলার। এটি একটি আশাব্যঞ্জক খবর নিঃসন্দেহে। তবে এক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো নিরাপত্তা। রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশন্সসহ আরও দু’-একটি পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা- ও ভবন ধসের পর পোশাক শিল্পের ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতার ব্যাপারটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের। অতঃপর পোশাক শিল্পের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গঠন করা হয় বিদেশী ক্রেতাজোট এ্যাকর্ড এ্যান্ড এ্যালায়েন্স, যাদের কার্যকাল ২০১৮ সাল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। এও মনে রাখতে হবে, প্রধানত নিরাপত্তাহীনতার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা স্থগিতসহ রফতানিতে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সমস্যা। অনেকটা এই প্রেক্ষাপটেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গঠন করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স ফোরাম। পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, সময়মতো বেতন-বোনাস, ওভারটাইম প্রদান, সর্বোপরি বিদ্যুত-গ্যাসসহ অগ্নিকা- বা অন্যবিধ ঝুঁকি কমানো ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত দেখভাল ও তদারকি করে থাকে এই ফোরাম। ইদানীং ‘গ্রীন গার্মেন্টস’ কর্মসূচীও জনপ্রিয়তা পেয়েছে, মূলত যা পরিবেশবান্ধব বলেই স্বীকৃতি পেয়েছে দেশে-বিদেশে। দেশে বর্তমানে ৫ হাজার ৬০০টির বেশি পোশাক কারখানা রয়েছে। কলকারখানা অধিদফতর এবং এ্যাকর্ড এ্যান্ড এ্যালায়েন্সের দেখভাল-তদারকির পর শতকরা ৯০ শতাংশের বেশি সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে। তবে ৪০ শতাংশ গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। সম্ভবত এই সুযোগটিই নিতে চাইছে এ্যাকর্ড। অবকাঠামোগত নিরাপত্তার বাইরেও বাংলাদেশের পোশাক খাতের অন্যতম সমস্যা শ্রমিকদের আর্থিক নিরাপত্তা। তবে বর্তমান সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় গত কয়েক বছরে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বেড়েছে। পোশাক শিল্প খাত শনৈঃ শনৈঃ লাভের মুখ দেখছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল হয় মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক আন্তরিক ও পারস্পরিক নির্ভরশীল হলে। তাহলে বাইরের কোন শক্তি, সংগঠন কিংবা ইন্ধনের দরকার পড়ে না। সরকারী ফোরামের পাশাপাশি বেসরকারী পর্যায়েও গঠিত হতে পারে এই জাতীয় ফোরাম, যাতে মালিক-শ্রমিকদের প্রতিনিধিরা থাকবেন। তারাই পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা করে নিশ্চিত করবেন আর্থিক খাতসহ পোশাক শিল্পের সার্বিক নিরাপত্তা। সর্বোপরি শুধু গার্মেন্টস শিল্প নয়, বরং রফতানিমুখী অন্যান্য শিল্পেও সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়ন হওয়া আবশ্যক। সেক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ মোতাবেক বিজিএমইএ এবং এ্যাকর্ডের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা অনুযায়ী সংস্কার কার্যক্রম যথাসময়ে সম্পন্ন হবে বলেই প্রত্যাশা।
×