ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুঃস্বপ্নের সফর শেষে ফিরলেন তামিমরা

প্রকাশিত: ১১:৪৫, ২ আগস্ট ২০১৯

দুঃস্বপ্নের সফর শেষে ফিরলেন তামিমরা

মিথুন আশরাফ ॥ শ্রীলঙ্কা সফরে ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক সিরিজের তিতে স্বাদই তাহলে নিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে যে খারাপ অবস্থা কখনও হয়নি, শ্রীলঙ্কা সফরে এবার তাই হলো। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে এক এক করে তিনটি ম্যাচেই হারল বাংলাদেশ। হোয়াইটওয়াশ হলো। আর এই বাজে ফল বাংলাদেশকে দিল লজ্জা। র‌্যাঙ্কিংয়ে নিচে থাকা কোন দলের বিরুদ্ধে একের অধিক দ্বিপক্ষীয় কোন ওয়ানডে সিরিজে কখনই এর আগে হোয়াইটওয়াশ হয়নি বাংলাদেশ। এবার আট নম্বরে থাকা শ্রীলঙ্কার কাছে হোয়াইটওয়াশ হলো সাত নম্বরে থাকা বাংলাদেশ। এই দুঃস্বপ্নের শ্রীলঙ্কা সফর শেষে বৃহস্পতিবার দুপুরে দেশেও ফিরেছেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা। ভাগ্য ভাল ক্রিকেটারদের। আরেকটু এদিক-ওদিক হলে বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা বিপদেও পড়ে যেতে পারতেন। কোন দুর্ঘটনাও ঘটতে পারত। শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সের যে বিমানে চড়ে ক্রিকেটারদের দেশে ফেরার কথা সেই বিমান ছাড়ার আগেই ত্রুটি ধরা পড়ে। ত্রুটি যদি আগে ধরা না পড়ে বিলম্বে ধরা পড়ত, বিমান ওড়ার পর ধরা পড়ত তাহলেই বিপদ ঘাড়ে চাপতে পারত। ভাগ্য ভাল। তাই হোয়াইটওয়াশ হয়ে দুঃস্বপ্নের শ্রীলঙ্কা সফর শেষে দেশে ঠিকমতোই আসতে পেরেছেন তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহীম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, মুস্তাফিজুর রহমানরা। শ্রীলঙ্কা সফরজুড়ে দুঃস্বপ্ন ঘিরে থাকল বাংলাদেশ দলকে। দেশের উদ্দেশে শ্রীলঙ্কা ছাড়ার সময়ও বিপদে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে ফ্লাইট ছিল বাংলাদেশ দলের। যথাসময়ে সবাই বিমানে চড়ে বসেন। অপেক্ষা বিমান ছাড়ার। কিন্তু বিমান তো আর আকাশে উড়ছে না। কী হয়েছে? যখন সবার ভেতর এ চিন্তা তখন অনেকটা সময় পর পাইলট জানান বিমানের বাম পাশের পাখায় ত্রুটি দেখা দিয়েছে। তাতে করে বিমান থেকে সবাইকে নামিয়ে দেয়া হয়। নতুন করে একটি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়। যেটি আড়াই ঘণ্টা পর বাংলাদেশের ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। সেই ফ্লাইট আড়াই ঘণ্টা পরই ছাড়ে। এরপর ৩ ঘণ্টা ৫ মিনিট ভ্রমণের পর বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা। কি এক বিপত্তিতে পড়তে হয়েছে ক্রিকেটারদের। সফরজুড়েও বিপদ, বিপত্তিতে পিছু ছাড়েনি। সফর শেষ করে যখন দেশে ফিরবেন শুরুতেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। বিমান ত্রুটির ঘটনায় হয়তো খানিক সময় আতঙ্ক বিরাজ করে। সেই আতঙ্কে লঙ্কা সফরে যে একের পর এক ম্যাচে ব্যর্থতা মিলেছে তা ভুলে যেতে পারেন ক্রিকেটাররা। কিন্তু খুব বেশি সময় লাগেনি দুঃস্বপ্ন আবার স্মৃতিতে ফিরে আসতে। স্মৃতি বারবার এমন সফর ভুলে যাওয়ার তাড়না দেয়। কিন্তু এমন কঠিন একটি সফর কী আর ভুলে যাওয়া যায়? বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কায় তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে গিয়ে প্রথম ওয়ানডেতে ৯১ রানে হারের পর দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৭ উইকেটে হারে বাংলাদেশ। এক ম্যাচ আগেই সিরিজ হার নিশ্চিত হয়ে যায়। তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে হারলে হোয়াইটওয়াশ হবে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা আরও বেশি খারাপ খেলেন। এবার ১২২ রানের বড় ব্যবধানে হারে বাংলাদেশ। তাতে হোয়াইটওয়াশ হয় তামিমবাহিনী। এ হোয়াইটওয়াশের দুঃস্মৃতি নিয়েই দেশে ফিরেন ক্রিকেটাররা। এতটা খারাপ নৈপুণ্য আর কখনই হয়নি। এর আগে ২০১০ সালে হল্যান্ডের কাছে সিরিজ হারে বাংলাদেশ। কিন্তু সিরিজে একটি ম্যাচই ছিল। জিম্বাবুইয়ের কাছেও সিরিজ হারে বাংলাদেশ। কিন্তু কখনই হোয়াইটওয়াশ হতে হয়নি। ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ দল যেভাবে ওয়ানডেতে উন্নতির শিখরে পৌঁছে তাতে এমন ব্যর্থতা সবাইকে হতবাকই করেছে। শ্রীলঙ্কা দলের প্রধান কোচ যিনি বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ, সেই চন্দিকা হাতুরাসিংহে তাই বলতে বাধ্য হয়েছেন ‘এভাবে যে ওরা (বাংলাদেশ) সিরিজ হারবে তা ভাবিনি। আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। ভেবেছিলাম লড়াই করবে। কিন্তু তেমন কিছুই তো হলো না।’ বিশ্বকাপের ২০ দিন পরই আন্তর্জাতিক ওয়ানডে খেলতে নামে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কা একদিন আগে খেলতে নামে। দুইমাসের বেশি সময় টানা একের পর এক ভেন্যুতে যাওয়া এবং একের পর এক ম্যাচ খেলায় বাংলাদেশ ক্রিকেটাররাও যেমন ক্লান্ত ছিলেন। শ্রীলঙ্কানদের মধ্যেও ক্লান্তি থাকারই কথা। সেই ক্লান্তি শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটাররা উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশকেও উড়িয়ে দিলেন। অথচ বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা কিছুই করতে পারলেন না। লড়াইও করতে পারলেন না। প্রথম ওয়ানডেতে বোলার-ফিল্ডারদের ব্যর্থতায় ৩১৪ রান করে ফেলে শ্রীলঙ্কা। বিশ্বকাপজুড়ে ব্যাটসম্যানদের লড়াইয়ে প্রশংসা কুড়ানো বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা ৪১.৪ ওভারের বেশি খেলতে পারলেন না। ২২৩ রানের বেশি করতেও পারলেন না। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে আগে ব্যাটিং করে আবার ২৩৮ রানের বেশি করতে পারেননি বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা। শ্রীলঙ্কা ৩ উইকেট হারিয়ে ৪৪.৪ ওভারে ২৪২ রান করে সহজেই জিতে যায়। তৃতীয় ওয়ানডেতেও শ্রীলঙ্কা ২৯৫ রানের টার্গেট দিয়ে বাংলাদেশকে ৩৬ ওভারে ১৭২ রানের গুটিয়ে দেয়। শেষ ওয়ানডেতে আরও খারাপ অবস্থা হয়। সিরিজজুড়ে ব্যাটিংয়ে শুধু মুশফিকুর রহীমকেই খুঁজে পাওয়া গেছে। সিরিজে বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে তিন ম্যাচ মিলিয়ে ১০০ রানের ওপরে শুধু মুশফিকই (৮৭.৫০ গড়ে ১৭৫ রান) করতে পেরেছেন। তাতেই বোঝা যাচ্ছে ব্যাটসম্যানদের কি করুণ দশা হয়েছে। আর বোলারদের মধ্যে ৫ উইকেটের বেশি শুধু তিন বছর পর ওয়ানডেতে বল হাতে নিয়ে শফিউল ইসলামই (৬ উইকেট) একটু উজ্জ্বলতা ছড়াতে পেরেছেন। বেহাল দশায় তো বোলাররা আগে থেকেই ছিলেন। শ্রীলঙ্কা সফরেও তা দেখা গেল। নিয়মিত অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা নেই। বিশ্বসেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডার, বিশ্বকাপ কাঁপানো সাকিব আল হাসানও নেই। সঙ্গে ব্যাটসম্যান লিটন কুমার দাস ও পেস অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনও নেই। তাতে করে সফরে দল যে বিপাকে পড়বে তা আগেই বোঝা গেছে। শ্রীলঙ্কার চেয়ে দুর্বল হয়েই খেলতে নেমেছে বাংলাদেশ। কিন্তু তাই বলে এতটা খারাপ হবে তা ভাবাই যায়নি। লড়াইও করতে পারবে বাংলাদেশ? দেশের ১৪তম ওয়ানডে নেতৃত্ব দেয়া তামিম ইকবালের অধিনায়কত্বে এবং ব্যাট হাতে চরম ব্যর্থ হয়েছেন। এমনভাবে হোয়াইটওয়াশ হওয়াতে, এমন বাজে সিরিজ হওয়াতে তিনি সবার দায় দেখছেন। তিনি বলেছেনও, ‘প্রথমদিন থেকে আমি বলে এসেছি দায়িত্ববোধ হলো মূলমন্ত্র। আমি ১২ বছর ধরে খেলছি (জাতীয় দলে), অন্যরাও লম্বা সময় ধরে খেলছে। সবচেয়ে হতাশাজনক হলো, আমরা কেউই দায়িত্ব নিতে পারিনি, যখন কিনা দলের আমাদের প্রয়োজন ছিল। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে এবং ফিরে আসতে হবে শক্তিশালী হয়ে।’ অন্যের কথা বলার আগে তো তামিমকে নিজের ব্যর্থতা দেখতে হবে। তাও দেখেছেন এ ওপেনার, ‘সেই বিশ্বকাপ থেকে আমি নিজেকে শুধু নিচের দিকেই নিয়ে যাচ্ছি। ব্যাপারটা এমন নয় যে, আমি চেষ্টা করছি না। নিজের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করছি, হয়তো সেটা যথেষ্ট হচ্ছে না। পেছনে ফিরে গিয়ে ব্যর্থতার জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে হবে, সেগুলো নিয়ে কাজ করে শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়ানোটা খুব জরুরী।’ সামনে হাতে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের অফুরন্ত সময়। এ বছর হয়তো আর কোন ওয়ানডেই খেলতে হবে না ক্রিকেটারদের। শুধু টি২০’র মধ্যেই থাকতে হবে। সঙ্গে থাকবে টেস্টও। সেপ্টেম্বরের আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে হবে না। কিন্তু যে দুঃস্বপ্নের সফর গেল তা থেকে তো আগে বের হতে হবে। দেশে ফিরে সবার আগে এই চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়তে হচ্ছে ক্রিকেটারদের।
×