ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রযুক্তির সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ৫ জুলাই ২০১৯

  প্রযুক্তির সংস্কৃতি

জিন সম্পাদনা করে মানব শিশু সৃষ্টি প্রযুক্তির সব শেষ আবিষ্কার। প্রযুক্তির এই উন্নয়ন উন্নত বিশ্বে নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। চীন দেশে এই কাজটি সম্পন্ন করেছেন একজন তরুণ অধ্যাপক। এই কাজ সম্পাদন করার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরি হারিয়েছেন তিনি। আরও বড় স্বস্তি তাঁর হতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে। এ শতকের শুরুতে বিজ্ঞানী এবং চিন্তাশীল মানুষ আশঙ্কা করছেন পৃথিবীতে মানব বসতির এটাই শেষ সময়। বর্তমান প্রজাতির মানুষ আর থাকবে না। মানুষের পরবর্তী সংস্করণ চলে আসবে। বায়োলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইবর্গ ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা অর্গানিক লাইফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর যে কোন একটি সফল হতে পারে। এক সঙ্গে কিংবা কিছু সময়ের ব্যবধানে তিনটিই আলোর মুখ দেখতে পারে। সাইবর্গ ইঞ্জিনিয়ারিং হলো এমন বিষয় যা অর্গানিক এবং নন অর্গানিকের সংমিশ্রণ। ইতোমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা প্রাকৃতিক বুদ্ধির স্থান দখল করবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে পড়ানো হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও দর্শন। প্রযুক্তির দর্শনও বিশ্ববিদ্যায়ের সিলেবাসে স্থান পেয়েছে। উন্নত বিশ্বে বহু আগে থেকেই প্রযুক্তির দর্শন পড়ানো হয়। প্রযুক্তির দর্শনের একাডেমিক ভিত্তি বেশ মজবুত। বহুমাত্রায় আলোচিতা এবং সমালোচিত প্রযুক্তি এবং প্রযুক্তির দর্শন। প্রযুক্তির দর্শন এবং প্রযুক্তির সংস্কৃতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে। মানুষ প্রযুক্তি নির্ভর। জীবনকে সরল এবং সহজ করার জন্য প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছে মানুষ। মানুষের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির বন্ধনে মানুষ নির্ভরশীল। দশ হাজার বছর পূর্বে দ্রুতগতির মোরগের সঙ্গে ধীর গতির মুরগির প্রজনন ঘটিয়ে অপেক্ষাকৃত স্থ’ূল আকৃতির মুরগি সৃষ্টি করেছে মানুষ। ২০০০ সালে ইউডোরা ক্যাক নামে একজন বায়ো আর্টিস্ট উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের খরগোশ সৃষ্টির পরিকল্পনা করেন। এই শিল্পীর পরিকল্পনা অনুসারে ফরাসি বিজ্ঞানীরা সাদা খরগোশের ভ্রুণ নিয়ে এর ডিএনএ এর মধ্যে সবুজ জেলিফিসের জিন স্থাপন করে সৃষ্টি করেন উজ্জ্বল দৃষ্টিনন্দন খরগোশ। ক্যাক এর নাম দেন অ্যালবা। বর্তমানে মোবাইল ফোন, ফেসবুক, ইন্টারনেট ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর মানুষ চরম অসহায়ত্ত বোধ করে। প্রযুক্তি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বহুমাত্রায় পরিবর্তন করে। কলেরা, প্লেগ একসময় মহামারী ছিল। এখন নেই। এইডসের ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এছাড়া আরও অনেক রোগের কোন প্রতিষেধক নেই। ক্যান্সারের চিকিৎসা হলেও ব্যায়বহুল। বিজ্ঞানীরা জিন সম্পাদনা করে রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন। বিজ্ঞানীদের এই প্রচেষ্টা সফল হলে অনেক রোগের ওষুধের প্রয়োজন হবে না। ফলে বিশাল আকৃতির আজকের ওষুধ শিল্প যে পদ্ধতিতে রয়েছে আগামী শতকে তার হয়েতো প্রয়োজন হবে না। এই শতাব্দী যদি বর্তমান অবস্থায় মানুষের শেষ অবস্থান হলে পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের ওষুধের প্রয়োজন নাও হতে পারে। ওষুধের স্থান দখল করে নিবে প্রযুক্তি। ওষুধ প্রযুক্তির বিকাসের ফসল। কিন্তু উন্নত প্রযুক্তি অনুন্নত প্রযুক্তির স্থান দখল করে নেয়। দেশী জাতের ধান চাষ এখন হয় না বললেই চলে। দেশী অনেক প্রজাতীর অনেক ধান বিলুপ্ত হয়েছে। দেশী মাছের স্থান দখল করেছে জিন সম্পাদিত মাছ। হরমোন প্রয়োগে ফসলের উৎপাদন অনেকগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রযুক্তি মানুষের আচার-আচরণে, নীতি-নৈতিকতায় পরিবর্তন আনে। মানুষের সাংস্কৃতিক এবং মূল্যবোধের পরিবর্তন প্রযুক্তিনির্ভর। রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক মূল্যবোধ প্রযুক্তির উত্থান-পতনের ওপর নির্ভরশীল। সব মানুষের প্রযুক্তি সক্ষমতা সমান থাকে না। সাংস্কৃতিক, বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের মাত্রার ভিন্নতা নির্ভর করে প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর। গত শতাব্দীতে নাটকের সেট নির্মাণ পদ্ধতি বর্তমানের চেয়ে ভিন্ন। টিভি চ্যানেলের স্থান দখল করে নিচ্ছে ইউটিউব। আগে গান শোনার বিষয় ছিল। এখন মিউজিক ভিডি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মানুষের নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য নির্ভর করে প্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর। একুশ শতকে ইউরোপ আমেরিকায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে মানুষের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে। এই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে নীতি-আদর্শ এবং মূল্যবোধ। চিন্তার ইতিহাস আলোচনার সময় দেখা যায় সংস্কৃতির সমাজতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সময় সংস্কৃতির সংজ্ঞায়নের চেষ্টা হয়েছে। সংস্কৃতি সম্পর্কে মোটামুটিভাবে বলা যায় কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের সামাজিক পথ পরিক্রমায় যা কিছু ঘটে তা-ই সংস্কৃতি। সামাজিক মানুষের পথ-পরিক্রমায় প্রযুক্তি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে গত শতাব্দীর স্থানীয় ব্যক্তি মানুষ গ্লোবাল মানুষে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় সংস্কৃতির ওপর গ্লোবাল সংস্কৃতির প্রভাব পড়ছে। গ্লোবাল মানুষের বিশ্ব সংস্কৃতি হওয়া স্বাভাবিক। স্থানীয় সস্কৃতি এখন গ্লোবাল সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর সুপ্রজনন থিওরি, জার্মান চ্যাঞ্চেলর এডলফ হিটলারের টি-৪ প্রোগ্রামের ওপর ভিত্তি করে বিশুদ্ধ আর্য রক্ত সৃষ্টি নামে ইহুদী এবং নন এরিয়ানদের হত্যা করার প্রজেক্ট নন্দিত হয়নি। কিন্তু দেশে বিদেশে কখনও বিশুদ্ধ রক্ত, কখনও ধর্ম রক্ষার নামে দুর্বলের ওপর নৃশংসতা চলছেই। পোস্ট হিউম্যান এবং প্রাকৃতিক মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে সেটি এখনও আলোচনায় আসেনি তবে কিছু হাপোথিসিস দাঁড় করানো হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মোঃ নুরুজ্জামান প্রযুক্তির দর্শন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। প্রযুক্তির দর্শন, প্রযুক্তির নীতিবিদ্যা এর পর তিনি লেখেছেন প্রযুক্তির সংস্কৃতি। মোট ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত প্রযুক্তির সংস্কৃতি গ্রন্থটি। প্রথম অধ্যায়ে তিনি প্রযুক্তির সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রযুক্তির নাগরিকতা : অধিকার ও দায়বদ্ধতা সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেছেন। তৃতীয় অধ্যায়ে জীবপ্রযুক্তির বিকাশে মানববিদ্যার ভূমিকা এবং চতুর্থ অধ্যায়ে ডিজিটাল বিভাজন : সামাজিক বৈষম্যের এক নতুন দিক নিয়ে আলোচনা করে মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন করার মতো নতুন জ্ঞানের সঞ্চালনা করেছেন। ডিজিটাল বিভাজন ও নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং বিচ্ছিন্নতা প্রযুক্তি নামে আরও দুটি অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রযুক্তির সংস্কৃতি নিয়ে অধিকতর গবেষণা করার জন্য তিনি একটি মূল্যবান তথ্যপঞ্জি করে গ্রন্থটি সমৃদ্ধ করেছেন। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ প্রযুক্তির সংস্কৃতি প্রকাশ করে দায়মুক্ত হয়েছেন। প্রযুক্তির সংস্কৃতি গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় জ্ঞান অর্জনের একটি নতুন মাত্রার সংযোজন করেছে। ২২৮ পৃষ্ঠার প্রযুক্তির সংস্কৃতি গ্রন্থের মূল্য ২২৫ টাকা।
×