ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

বঙ্গের কবি ॥ মাইকেল মধুসূদন দত্ত

প্রকাশিত: ০৯:৪৯, ২৯ জুন ২০১৯

 বঙ্গের কবি ॥ মাইকেল মধুসূদন দত্ত

অনন্য বৈশিষ্ট্য ও ব্যতিক্রমী ঢঙের বাংলা কাব্য, সাহিত্য ও নাট্যকর্মের পথিকৃৎদের কথা স্মরণ করতে গেলে অনিবার্যভাবে উনিশ শতকের কাব্য ও নাট্য স্রষ্টা মধুসূদন দত্তের কথা মনে পড়ে। ট্রাজিক এপিক ‘মেঘনাদ বধ’ এর স্রষ্টা এই ব্যতিক্রমী নাট্যকার ১৮৭৩-এর ২৯ জুন ওপারে চলে যান। ইংরেজী কাব্য রচনায় প্রবল আসক্তি থাকলেও অবশেষে বাংলার জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেননি। জীবনের শেষভাগ তিনি বাংলা ভাষার মাঝেই বিচরণ করেছেন। তিনি রেখে যান বাংলায় রচিত তার অনন্য কীর্তি যা আজও আমাদের নিয়ে যায় বিষাদ, ভালবাসা ও জীবনের অতলে। বিশুদ্ধ অনেক অনুভূতি উচ্চকিত হয়ে ওঠে তার রেখে যাওয়া কাব্য ও সাহিত্যের গভীরে গেলে। আজ তার একশত ছেচল্লিশতম প্রয়াণ দিবসে তাই তাকে নিয়ে লেখার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে পারছি না। বাংলা সনেটের এই ব্যতিক্রমী স্রষ্টা এবং ইংরেজী রীতি ও ঢঙে বাংলায় রচিত নাট্যকর্মের পুরোধা মাইকেল মধুমসূদন দত্তের জন্ম আমাদের যশোর জেলার কেশবপুরে। এ আমাদের গর্ব। অনেক দিন যাবতই কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তসম্পর্কে কিছু লিখব বলে ভাবছিলাম। সম্প্রতি গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার মেহানগঞ্জ গিয়েছিলাম দুই দিনের জন্য। বাড়ি থেকে ফেরার সময় আমাদের সার্কেলের অতিঃ পুলিশ সুপার জনাব সফিউল ইসলাম আমাকে কবির লেখা ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের ওপর একটি আলোচনা ধর্মী বই উপহার দেন। ঐ পুলিশ অফিসারটি বয়সে নবীন। ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। আমি যখনই বাড়িতে যাই তিনি আমার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের ফাঁকে শিল্প সাহিত্য ও সমাজ নিয়ে কথা বলেন। সময় কাটানোর জন্য মাঝে মাঝে আমাকে বাংলা ও ইংরেজী সাহিত্যের ওপর বিভিন্ন লেখকের লেখা বই দিয়ে থাকেন। সফিউলের মতো সাহিত্যপ্রেমী পুলিশ অফিসার আমি খুব কমই দেখেছি। আল্লাহ তার মঙ্গল করুন। ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের ওপর লেখা বইটি পড়তে পড়তে ভাবছিলাম কবির জীবন, তার জন্মস্থান ও সমাধি সম্পর্কে কিছু একটা লিখব। সেই বাসনা থেকেই আমার লেখার এই প্রয়াস মাত্র। আমি এ লেখাটি লিখতে গিয়ে উক্ত বইটির কিছু সাহায্য নিয়েছি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন ‘কবির কবিত্ব বুঝিয়া লাভ আছে, সন্দেহ নাই, কিন্তু কবিত্ব অপেক্ষা কবিকে বুঝিতে পারিলে আরও গুরুতর লাভ। কবিতা কবির কীর্তি তাহা ত আমাদের হাতেই আছে, পড়িলেই বুঝি কিন্তু যিনি এই কীর্তি রাখিয়া গিয়াছেন, তিনি কি গুণে, কি প্রকারে এই কীর্তি রাখিয়া গেলেন তাহাই বুঝিতে হইবে।’ কবি মধুসূদনকে বোঝার জন্য সাহিত্য জ্ঞান আমার নেই। কেননা আমি কোন কবি বা সাহিত্যিক নই। কিন্তু কবির প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ থেকেই আমি সাগরদাঁড়িতে কবির জন্মস্থান, ফরাসী রাজ্যের ভার্সাইতে কবির সাময়িক আবাসস্থল ও কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোডে কবির সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের জন্য ছুটে গিয়েছি বিভিন্ন সময়ে। আমার মতন হয়ত প্রতিটি বাঙালীই কবিকে স্মরণ করেন বিনম্র শ্রদ্ধায়। সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে আমরা যখন স্কুলের ছাত্র তখন কপোতাক্ষ (কবতাক্ষ) নদ কবিতাটি সম্ভবত নবম বা দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই কবিতাটি পড়েই প্রথম চতুর্দশপদী কবিতার কথা শুনি ও ধারণা পাই। বাংলায় যাকে চতুর্দশপদী কবিতা বলে ইংরেজীতে সেটা হলো Sonnet। জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে ইংরেজী সাহিত্যের প্রথম প্রচলন হয়। বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতার পথিকৃৎ হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সনেট শব্দটির বাংলায় ভাষান্তর কবি মধুসূদন নিজেই করেছিলেন। ১৮৬৫ খ্রীস্টাব্দে কবি যখন ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে অবস্থান করছিলেন তখন ইতালির এক কবির লেখা একটি সনেট কবিতা পড়ে তিনি এই রীতির কাব্য রচনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে অনেকের ধারণা। সনেটের একটি বৈশিষ্ট্য হলো কবিতাটি চৌদ্দ লাইনে লিখিত এবং প্রতিটি লাইনে সাধারণত চৌদ্দটি অক্ষর থাকে। এই ধরনের কবিতাকেই সম্ভবত অমিত্রাক্ষর ছন্দের কবিতা বলা হয়। আগেই বলেছি, আমি কবি বা সাহিত্যিক নই তাই চতুর্দশপদী কবিতা বা অমিত্রাক্ষর ছন্দের কবিতা সম্বন্ধে আমি উপরে যা বলেছি তাতে যদি কোন ভুল থেকে থাকে তাহলে যে কেউ আমাকে শুধরে দিলে কৃতজ্ঞ হব। মধুসূদন আমাদের বাংলাদেশের যশোর জেলার অন্তর্গত কেশবপুর থানার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মেছিলেন ১৮২৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি। তার বাবা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন এলাকার বড় জমিদার। মায়ের নাম জাহ্নবজী দেবী। ছাত্রজীবনে মধুসূদন ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। স্কুলের পাট চুকিয়ে কলকাতার হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের সময় দুইজন ইংরেজ শিক্ষকের বেশ প্রভাব ছিল মধুসূদনের ওপর। তারা হলেন ডিরোজিও (ডি রোজারিও) ও রিচার্ডসন। ডিরোজিও তার ছাত্রদের ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি এসব বিষয়েরই দোষগুণ আলোচনা করে নিজেদের কর্তব্যপথ নির্ণয় করতে শিক্ষা দিতেন। রিচার্ডসনও কবির একজন আদর্শ পুরুষ ছিলেন। তার অনুপ্রেরণাতেই কবি কলেজজীবনে কেবল ইংরেজীতেই কাব্য চর্চায় আকৃষ্ট হন। ভেবে অবাকহই, বাংলা সাহিত্যের এত বড় মহাকবি তাঁর প্রথম জীবনে নিজ ভাষাকে উপেক্ষা করে ইংরেজী ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। হয়তবা তার ধারণা ছিল ইংরেজী ভাষায় সাহিত্যকর্মের মাঝেই তিনি কীর্তিমান হবেন এবং জশ ও খ্যাতি অর্জন করবেন। হিন্দু কলেজে অধ্যয়ন কালেই তিনি ইউরোপের বিখ্যাত কবি হোমার সহ অন্য সাহিত্যকদের লেখা পড়তেন। ইংরেজী ভাষার প্রতি তার অনুরাগতখন থেকেই। আর এ সময়ই তিনি বিলেত যাওয়ার আকাঙ্খায় প্রবলভাবে আক্রান্ত হন। সম্ভবত ইংরেজ কবিদের প্রভাবে এভাবে আচ্ছন্ন হয়েই কবি মধুসূদন বিলেত যাওয়ার অদম্য মোহে তাড়িত হয়ে ১৮৪৩ সালে হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তার নামের পূর্বে ‘মাইকেল’ শব্দটি যুক্ত হয়। তখন থেকেই তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নামে পরিচিত লাভ করে। তখনকার গোঁড়া হিন্দু সমাজ কবির এই ধর্মান্তরিত হওয়াটাকে ভালভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। পরিণতিতে কবিকে ছাড়তে হয় হিন্দু কলেজ। সেই সঙ্গে কলকাতার হিন্দু সমাজ তাকে পরিত্যাগ করে। এ ধাক্কা সামলাতে বাধ্য হয়ে কবি হিন্দু কলেজ ত্যাগ করে বিশপস কলেজে ভর্তি হন। এই সময়ে কবির এমনতর কর্ম ও ধ্যানে বিরূপ পিতা রাজ নারায়ণ দত্তও ছেলেকে অর্থ প্রেরণ বন্ধ করে দেন। বিশপস কলেজে অধ্যয়নের পাঠ চুকিয়ে ১৮৪৮ সালে কবি মাদ্রাজ গমন করেন। মাদ্রাজে এসে তিনি প্রথমে কোন চাকরি পাননি। অবশেষে অতি অল্প বেতনে একটি অনাথ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে যোগ্য দেন। পরে অবশ্য তিনি মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষকতার পদে ও স্থানীয় একটি ইংরেজী দৈনিক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিযুক্তি পান। পত্রিকাটির নাম ছিল ‘Speetator’ পত্রিকাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে তিনি মাদ্রাজের বিভিন্ন পত্রিকায় ইংরেজীতে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। ১৮৪৯ সালেই তিনি ‘Captive lady’ কাব্য রচনা করেন। কিন্তু কবির এই অনন্য প্রতিভার কথা তৎকালীন কলকাতার সংবাদপত্রসমূহ। তেমনভাবে প্রচারে আগ্রহী হতো না। এমনকি বাঙালী পাঠকরাও কবির এই কাব্য কর্মকে প্রসন্ন চিত্তে গ্রহণ করেননি। এ কারণে তাঁর গুটিকয়েক বাঙালী বন্ধু তাঁকে মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চায় নিবেদিত হওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ জানাতে থাকেন। এরই এক পর্যায়ে ১৮৫৬ সালে কবি মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং নিজ ভাষায় সাহিত্যকর্ম রচনায় নিবিষ্ট হন। এখানে উল্লেখ্য, ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজে অবস্থানকালীন রেবেকা নামে এক স্কটিশ মেয়েকে বিবাহ করেন। এই বিবাহ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিয়ের সাত বছর পর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর ১৮৫৬ সালে কবি মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজের এক অধ্যাপকের কন্যা কুমারী হেনরিয়েটাকে বিবাহ করেন। তিনিই মাইকেল মধুসূদন পত্নী হিসেবে মাসাধিক পরিচিত। (চলবে...)
×