ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

মার্কিন সমরাস্ত্র বোঝাই জাহাজ ॥ ২২ জুন, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ২২ জুন ২০১৯

 মার্কিন সমরাস্ত্র বোঝাই জাহাজ ॥ ২২ জুন, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২২ জুন দিনটি ছিল মঙ্গলবার। সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের সর্বত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা করে, ভয় দেখিয়ে নিজেদের লুটপাটে নিয়োজিত করেছে। এসব জঘন্য অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে অসহায় বাঙালী দলে দলে পালিয়ে ভারতবর্ষে যেতে শুরু করে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান উপাসনালয় আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত, মুসলমানদের মসজিদ কিছুই রেহাই পায়নি এই বর্বর অত্যাচারীদের হাত থেকে। বাঙালীদের নিশ্চিহ্ন ও নেতৃত্বশূন্য করতে যেভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে, সেখানে হিন্দু-মুসলমান সমান হারে মরেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যক্ষ ড. গোবিন্দ দেবের পাশাপাশি পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান মনিরুজ্জামান এবং অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুর, অধ্যাপক মোক্তাদিরও একই হাতের শিকার। এই দিন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতীয় পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণ দানকালে বলেন, আজ আমাদের বড় লক্ষ্য হবে মাতৃভূমিকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করে আমাদের ৬০ লাখ মানুষকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনা। দলমত নির্বিশেষে আজ বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের প্রতিটি মানুষ বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তারা বুকে তুলে নিয়েছেন ৬০ লাখ ছিন্নমূল মানুষকে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ এই বন্ধুত্বের কথা চিরদিন মনে রাখবেন। চিরকাল আমরা বন্ধুত্বের হস্ত প্রসারিত করে রাখব। কুমিল্লার মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর রাজাপুর ঘাঁটির ভেতর গোপন পথে প্রবেশ করে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ অভিযানে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। অপরদিকে ১৫ জন পাকসেনা হতাহত হয়। খুলনার বৈকরি ও যশোরের বেনাপোলে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সীমান্ত ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। বগুড়ার মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর পাঁচবিবি ঘাঁটির ওপর তুমুল আক্রমণ চালায়। এতে পাকবাহিনীর প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করে। পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি খান আবদুল কাইয়ূম খান শক্তিশালী কেন্দ্রের গ্যারান্টি দিয়ে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা সমর্থনকারী অথবা বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবাপন্ন সমস্ত দল বা গ্রুপের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানান। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্দলীয় সদস্য এসবি জামান ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিদ্রোহ দমনে পাক সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করে এ জন্য আরও শান্তি কমিটি ও ভিজিলেন্স কমিটি গঠন করার সুপারিশ করেন। এদিন ঢাকায় পাকিস্তানী সামরিক প্রশাসক ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে স্লোগান, দেয়াল লিখন, নির্বাচনী প্রতীক মুছে ফেলার নির্দেশ দেয়। না হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানানো হয়। এদিন নেজামে ইসলাম প্রধান মওলানা একে শামসুল হক সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা আরও দীর্ঘায়িত করার সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তর হলে আবার বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে। ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস’ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ‘পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র প্রেরণ’ শিরোনামে নিউইয়র্ক টাইমসের বিশেষ প্রতিনিধি ট্যাড সুলচের রিপোর্টে বলা হয়, পাকিস্তানের পতাকাবাহী একটি মালবাহী জাহাজ মার্কিন সমরাস্ত্র নিয়ে আজ নিউইয়র্ক থেকে করাচীর উদ্দেশে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আপাতদৃষ্টিতে এ ধরনের সরবরাহের ওপর এই সরকারের আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, অনুসন্ধানের প্রতিক্রিয়ায় স্বীকার করেন যে, অন্তত আরও একটি জাহাজ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানের পথে রয়েছে যা তাদের বর্ণনা অনুযায়ী ‘বৈদেশিক সামরিক বিক্রয়’-এর পণ্য বহন করছে। এই পণ্যগুলো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্বৃত্ত সরবরাহ থেকে এসেছে এবং পাকিস্তানে এ ধরনের সমরাস্ত্র প্রেরণে তিন মাস আগের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কিভাবে কার্যকর করা হবে তা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার বিভ্রান্তির ফলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এক কর্মকর্তা বলেন ‘এখানে স্পষ্টতই অসাবধানবশত কোন ধরনের বিচ্যুতি ঘটেছে।’ পদ্মা নামের যে জাহাজটি নিউইয়র্ক থেকে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেটি আটটি যুদ্ধবিমান, প্যারাসুট এবং হাজার হাজার পাউন্ড ওজনের খুচরা যন্ত্রাংশ এবং যুদ্ধবিমান এবং সামরিক যানবাহনের আনুষঙ্গিক উপকরণ নিয়ে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে করাচীতে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। জাহাজের মালামালের তালিকা এবং সঙ্গে পাঠানো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া রফতানি অনুমোদন অনুযায়ী পাকিস্তানে নিবন্ধিত জাহাজ সুন্দরবন, মে মাসের ৮ তারিখে নিউইয়র্ক থেকে যাত্রা শুরু করে পাকিস্তানের জন্য অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে, যার মধ্যে সৈন্যবাহী সাঁজোয়া যানের যন্ত্রাংশ রয়েছে। এই বুধবার জাহাজটির করাচী পৌঁছানোর কথা রয়েছে। এই সমস্ত সরঞ্জাম বৈদেশিক সামরিক বিক্রয় আইনের ধারা মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করেছে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর, মূলত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের গত ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনকে দমন করার নির্দেশ দেয়ার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয় যে পাকিস্তানের কাছে সব প্রকার সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি স্থগিত করা হলো এবং এই কার্যক্রম, যেটি ১৯৬৭ সালে শুরু করা হয় সেটি এখন ‘পুনর্বিবেচনা’ করা হচ্ছে। আজ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে, পদ্মা এবং সুন্দরবনের যাত্রা প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে বলেন যে, এটি এখনও এই সরকারের আনুষ্ঠানিক নীতিতে রয়েছে যে পাকিস্তানের জন্য সব ধরনের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি নিষিদ্ধ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী এর পরবর্তী সংঘর্ষে অন্তত দুই লাখ পূর্ব পাকিস্তানী নাগরিক নিহত হয়েছে এবং প্রায় ষাট লাখ শরণার্থী ভারতে পালিয়ে গিয়েছে। আজকের সাক্ষাতকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলেন যে ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানের জন্য কোন সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর ব্যাপারে তারা অবগত নন। তারা স্বীকার করেন যে- এ রকম কিছু পাঠানো হলে তা ঘোষিত নীতির পরিপন্থী হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের জানিয়েছে যে ২৫ মার্চের পর বৈদেশিক বিক্রয় কার্যক্রমের আওতায় কোন ধরনের সামরিক সরঞ্জাম ‘পাকিস্তানের সরকার বা পাকিস্তান সরকারের কোন প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। তারা বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আজকের আলোচনায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই নীতি মেনে চলার ব্যাপারে ‘পুনঃনিশ্চয়তা’ দিয়েছে। এখানকার নির্ভরযোগ্য সূত্র আরও জানিয়েছে যে ‘সমূহ সম্ভাবনা’ আছে সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীও পাকিস্তানের কাছে আরও সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে। ইস্ট ওয়েস্ট শিপিং এজেন্সির মুখপাত্র, যারা কিনা পদ্মা এবং সুন্দরবন জাহাজ দুটির নিউইয়র্কের প্রতিনিধি, ইঙ্গিত দেন যে পদ্মা জাহাজটি তার সাম্প্রতিক আরও কিছু যাত্রায় পাকিস্তানের জন্য সামরিক সরঞ্জাম বহন করেছে, সর্বশেষ যেটি মার্চের ২২ তারিখে করাচীতে পৌঁছে দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সৈনিকদের অভিযান চালানোর তিন দিন আগে। পদ্মা জাহাজটি যে যাত্রার জন্য এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে সেটি ২৫ মার্চের পরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর সামরিক সরঞ্জাম বহন করে করাচীতে নিয়ে যাওয়ার প্রথম সমুদ্রযাত্রা। সুন্দরবন জাহাজটির বর্তমান সমুদ্রযাত্রাটিও নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর প্রথম যাত্রা। কিন্তু নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে যে পাকিস্তানের জন্য সামরিক সরঞ্জামাদি নিয়ে অন্য আরও জাহাজ ২৫ মার্চের পরেও পূর্ব এবং পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলো থেকে যাত্রা করে থাকতে পারে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×