ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদের ছুটিতে সিলেট বিভাগে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড়

প্রকাশিত: ১০:১৪, ৮ জুন ২০১৯

 ঈদের ছুটিতে সিলেট বিভাগে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড়

সালাম মশরুর, সিলেট অফিস ॥ পর্যটন নিয়ে সিলেট বিভাগে ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন ডানা মেলছে। সম্ভাবনাময় এই খাতে ব্যবসা যেন হাতছানি দিচ্ছে। বিভাগের সর্বত্র এখন পর্যটকদের বিচরণ। পাহাড়, টিলা, নদী, আঁকাবাঁকা পথ। সবুজের সমারোহ। যতই দেখা যায় ততই ভাল লাগে। সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াইবিধৌত, দুটি পাতা একটি কুড়ির সবুজে মোড়ানো ছোট-বড় পাহাড়-টিলা, হাওর-বাঁওরবেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সিলেট বিভাগের সর্বত্র এখন পর্যটকদের আনাগোনা। ঈদের ছুটিতে দর্শনীয় স্থানে দিনভর উপচেপড়া ভিড়। এ যেন আনন্দের মাঝে মহাআনন্দ। এক সময় স্থানীয় পর্যায়ে হোটেল ব্যবসায়ী, ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টিতে পর্যটকদের আগমন ছিল নিছক বেড়ানো। হযরত শাহজালাল (র.)-এর মাজার জিয়ারত, জাফলং ও মাধবকু- যাতায়াতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পর্যটকরা এসেছেন, হোটেল বুকিং নিয়েছেন। গাড়ি ভাড়া করে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। অর্থনৈতিকভাবে বাজারে তেমন প্রভাব ফেলার মতো বিষয় ছিল না। কিন্তু কালের ব্যবধানে গত ১০ বছরে এ চিত্র অনেকটা পাল্টে গেছে। এখন শুধু জাফলং, মাধবকু- নয়, বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে থাকা অনাবিষ্কৃত সৌন্দর্যম-িত স্থানগুলো দৃষ্টির সীমানায় আসছে। সৌন্দর্য পিপাসুদের খুঁজে আনা এসব স্থানের তথ্য ইন্টারনেটের বদৌলতে মুহূর্তেই চলে যাচ্ছে দেশে-বিদেশে। আর এই মনোমুগ্ধকর স্থান দর্শনের লোভ যে কত তীব্র সেটা কেবল ভ্রমণপিপাসুরাই বলতে পারেন। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে পর্যটন সেক্টর নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা নতুন স্বপ্ন দেখছেন। সে লক্ষ্যে নিজেরা প্রস্তুত হচ্ছেন, পাশাপাশি এ খাতে বিনিয়োগও শুরু হয়েছে। সিলেট বিভাগে পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসার সাফল্য ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করছে। সম্প্রতি সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জে রুচিসম্মত, আধুনিকমানের অর্ধশতাধিক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। সারা বছর এই সকল হোটেল-রিসোর্টে পর্যটকদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বাইরে থেকে ই-মেইল, ইন্টরনেটে রুম বুকিং করে সময়মতো তারা অবস্থান নিচ্ছেন। ঈদের ছুটিসহ সাপ্তাহিক ছুটি ও বিভিন্ন দিবসে এক-দুদিনের সঙ্গে আরও এক-দুদিন যোগ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন প্রকৃতিপ্রেমিরা। আর সে লক্ষ্যে পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও পর্যটকদের যথাযথ সেবা দানে নিজেদের প্রস্তুত করে রাখেন। বিশেষ করে ঈদকে সামনে রেখে অধিকসংখ্যক পর্যটকের আগমন সামাল দিতে পূর্ব থেকেই বিশেষ নজর রাখেন। শহরের বাইরে প্রকৃতিঘেরা মনোরম পরিবেশে তৈরি রিসোর্টগুলোতে সময় কাটিয়ে বাড়তি আনন্দ উপভোগকারীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জের নামীদামী রিসোর্টে এক রাতে ২০হাজার থেকে ১লাখ টাকা পর্যন্ত ভাড়া দিয়েও পর্যটকরা বাড়তি আনন্দে মনকে তৃপ্ত করছেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো সারাবছরই মুখর থাকে পর্যটকদের পদচারণায়। আর ঈদ এলে ঢল নামে পর্যটকদের। চাঙ্গা হয়ে ওঠে পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্য। এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। ঈদে দীর্ঘ ছুটি হওয়ায় পর্যটকদের ঢল নেমেছে এই অঞ্চলে। পর্যটকদের বরণ করতে আগেভাগেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন তারা। এদিকে, পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন সেজন্য ট্যুরিস্ট পুলিশসহ পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় বিস্তৃত পর্যটন এলাকাগুলো ঘুরে দেখার জন্য পর্যটকদের কাছে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে যাতায়াত ব্যবস্থা। অধিকাংশ এলাকায় স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ানোর উপায় নেই। বর্ষাকালে নৌকাযোগে বেড়ানোর সুযোগ থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে সড়কপথে সে সুযোগ নেই। সৌন্দর্যম-িত এই সকল এলাকায় বর্ষায় এক রূপ আর শুষ্ক মৌসুমে আরেক রূপ। প্রকৃতির এই বিশাল রূপের ভা-ার ভ্রমণপিপসুদের উপভোগ করার জন্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কমতি নেই। এখন প্রয়োজন সরকারী উদ্যোগে যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। পাহাড়ের সঙ্গে মেঘের মিতালি, স্বচ্ছ জলের নিচে স্তরে স্তরে সাজানো নানা রঙের পাথর। উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণাধারা, ছোট-বড় পাহাড়ী নদীর বাঁক ধরে নৌকায় ঘন বনে হারিয়ে যাওয়া, প্রকৃতির এমন রূপ-লাবণ্য উপভোগ করার টান যেন অন্য ধরনের। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছনাকান্দি পর্যটনকেন্দ্রটি সাম্প্রতিককালে দেশের অন্যতম একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। পিয়াইনের দুই তীরে রয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি। সেখানে শত শত পাথর শ্রমিক প্রতিদিন পাথর উত্তেলন করে থাকে। বর্ষায় পাহাড়ী ঢলের স্বচ্ছ পানিতে পিয়াইন সাগরের রূপ ধারণ করে যা রীতিমতো অপরূপ। আবার বসন্তেও বিছনাকান্দি মুগ্ধ করছে হাজার হাজার পর্যটককে। তারই ঢালুতে ভারতীয় খাসিয়া পল্লী ও বাসিন্দাদের চোখে পড়ে। এখানে পর্যটকদের ছবি তুলে দিতে কাজ করছে মেঘালয়-বিছনাকান্দি সমিতির প্রায় ১০০ তরুণ সদস্য। বর্ষায় একই রূপ জাফলং জিরো পয়েন্টে। এবার সিলেট, কোম্পানিগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ সড়কটি পাকাকরণ কাজ হয়ে যাওয়ায় শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরবর্তী ভারতের সীমানাঘেঁষা এলাকাটি পর্যটকদের কাছে নতুন রূপে আবিষ্কৃত হয়েছে। দেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল, অপার সৌন্দর্যমন্ডিত সবুজ গ্রাম পান্তুমাই, জাফলংয়ের মায়াবী ঝর্ণাধারা। যেখানে পর্যটকরা মুগ্ধ হন, প্রকৃতির নির্মল প্রেমে নিজেরা হারিয়ে যান প্রকৃতি ভাবনায়। ওপারে নদীর ওপর ঝুলন্ত ব্রিজ সমতল ভূমিতে জাফলং চা বাগান, তামাবিল জিরো পয়েন্ট ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের খাসিয়া পল্লী, সব কিছুই খুব সহজেই আকৃষ্ট করে আগত পর্যটকদের। এ ছাড়াও বিজিবির সংগ্রাম সীমান্ত ফাঁড়ি এলাকায় রয়েছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড নির্মিত দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি ও জাফলং চা বাগান সংলগ্ন এলাকায় পিয়াইন নদীর ওপর জাফলং সেতু। যে সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে একই সঙ্গে দেখা যায় সমতল ভূমির চা বাগান, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ জলের স্রোতধারা ও ভারতের মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়। জাফলং ও বিছনাকান্দির আকর্ষণীয় স্থানগুলোতে পর্যটকবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি ও আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটকদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্রের বিভিন্ন স্থানে সতর্কতামূলক নির্দেশনা সংবলিত সাইনবোর্ড সাঁটানো হয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয় এলাকার জনপ্রতিনিধি পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদেরও এ বিষয়ে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। পর্যটন জেলা চায়ের রাজধানী মৌলভীবাজারের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে পর্যটকদের ভিড় এখন সারাবছর। জেলাজুড়ে শতাধিক চা বাগান, জীব্যবৈচিত্রে ভরপুর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, দেশের বৃহত্তম জলরাশি মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, দুর্গম পাহাড়ের গহিন জঙ্গলে হামহাম জলপ্রপাত, এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওর, দোসাই রিসোর্ট এ্যান্ড স্পা সেন্টার, গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট, মনু ব্যারাজ এলাকায় রাঙ্গাউটি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাধবপুর লেক, শ্রীমঙ্গলের স্বাধীনতার বধ্যভূমি, বাইক্কা বিল, আগরের কারখানা, রবার বাগান, জুড়ির কমলার বাগান, তুর্কি নক্সায় নির্মিত শ্রীমঙ্গলের দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, বীরশেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিস্তম্ভ, মনিপুরি তাঁতশিল্প, খাসিয়াদের চাষকৃত পানের বরজ, মৌলভীবাজারের বর্ষিজোড়া ইকোপার্কসহ আরও অনেক সুন্দর আকর্ষণীয় স্থান। ছোটবড় ২৩৮টি বিল নিয়ে হাকালুকি হাওরের আয়তন ২০ হাজার ৪ শত হেক্টর। নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ, পাখি, শাপলা-শালুক, ঝিনুক, শত শত প্রজাতির জলজপ্রাণি আর হিজল, কড়চ, বরুণ, আড়ং, মূর্তা, কলুমসহ সবুজের ঢেউ জাগানিয়া মনকাড়া পরিবেশ। এই মৌসুমে থৈথৈ পানি আর শীত মৌসুমে পাখির খেলা বিমোহিত রূপ মাধুর্যে কাছে টানে প্রকৃতিপ্রেমীদের। এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি মৌলভীবাজার ও সিলেটের মধ্যে বিস্তৃত। দেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত মাধবকুন্ড। বড়লেখা উপজেলার কাঁঠালতলী বাজার থেকে ৮ কি.মি. পূর্বদিকে এগোলেই কানে আসবে ক্রমাগত জল গড়ানোর শব্দ। প্রায় ২শ’ ৫০ ফুট পাথারিয়া পাহাড়ের ওপর থেকে ছোট-বড় পাথরের বুক চিরে আছড়ে পড়া জলরাশির ঝর্ণাধারার দৃশ্যে মন নাচে আনন্দ-আবেগে। তাই যে কোন প্রকৃতিপ্রেমীর জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ॥ লাউয়াছড়া রেইন ফরেস্ট হিসেবে খ্যাত এই বনে রয়েছে হরেক প্রজাতির বন্যপ্রাণী আর বৃক্ষাদি। রয়েছে ১৬৭ প্রজাতির বৃক্ষরাজি। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান শ্রীমঙ্গল হতে মাত্র ১০ কি.মি. আর ঢাকা থেকে ১৯৬ কি.মি.। এর আয়তন ১২৫০ হেক্টর। মোট ১৬টি উল্লুক পরিবার হাজারো পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভারত, চায়না, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশসহ ৪টি দেশে ওদের প্রজাতি সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করছে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গা ঘেঁষা রয়েছে ৩টি আদিবাসী পল্লী। (মাগুরছড়া ও লাউয়াছড়া) ও ১টি ত্রিপুরাদের পাড়া। আদিবাসীদের জীবনযাত্রা সাধারণত পাহাড়ী কৃষ্টি-কালচারের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠে যা সাধারণের থেকে অনেক আলাদা। আদিবাসীদের জীবনযাত্রা, কৃষ্টি, ঐতিহ্য দেখাও পর্যটকদের জন্য বাড়তি পাওনা। বড়লেখার আজীমগঞ্জ ও সুজানগর এলাকায় বিশাল বিশাল আগর বাগান আর তা থেকে নানা প্রক্রিয়ায় সুগন্ধি সংগ্রহের দৃশ্য কৌতূহল জাগায়। এখানকার উৎপাদিত আগর দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। মাধবকু- জলপ্রপাতের চেয়ে তিনগুণ বড় হামহাম জলপ্রপাত। কমলগঞ্জ উপজেলার কুরমা বনাঞ্চলের ভারতীয় সীমান্তে হামহাম জলপ্রপাত। কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কি.মি. পূর্ব-দক্ষিণে রাজকান্দি বন রেঞ্জের কুরমা বনবিট এলাকার প্রায় ১০ কি.মি.অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন হামহাম জলপ্রপাতের অবস্থান। হাইল হাওরে অবস্থিত সংরক্ষিত মৎস্য অভয়াশ্রম ‘বাইক্কা বিল’। ইউএস আইডি’র অর্থায়নে মাস প্রকল্পের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে মৎস্য ও পাখির অভয়াশ্রম। নয়নাভিরাম জলাভূমিতে হাজারও শাপলা আর পদ্মফুল ফোটে। বিলের পানির ওপর ঘুরে বেড়ায় ফড়িং। সকাল-বিকেল চলে রঙিন ফড়িংয়ের বিরতিহীন শোভাযাত্রা। বৃষ্টিহীন উষ্ণ দিনে বিলে ফুলের পাশে আসে রঙিন প্রজাপতির দল। জীববৈচিত্র্য ও মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাইক্কা বিল জলজসম্পদের অমূল্য ভান্ডার। বিলের পানিতে ফোটা হাজারো পানা, শাপলা, পদ্ম আর নীলপদ্ম শোভিত মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক শোভা দেখে পর্যটক ও প্রকৃতিপিপাসুরা বিমোহিত হন। অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত এ বিল এখন আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটে পরিণত হয়েছে। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের কুলঘেঁষা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর নৈসর্গিক দৃশ্যে প্রকৃতি তার নিজ হাতেই সাজিয়েছে হাওরের রাজধানী সুনামগঞ্জ জেলাকে। জেলার প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের ভা-ার তাহিরপুরের পাহাড়, এশিয়ার সর্ববৃহৎ জয়নাল আবেদীন শিমুল বাগান, রাজারগাঁও অদ্বৈত প্রভুর আখড়াবাড়ি, গড়কাটি ইসকন মন্দির, হলহলিয়ায় হাবেলি রাজবাড়ি, কড়ইগড়া-রাজাই আদিবাসী পল্লী, কড়ইগড়া মাঝের টিলা, রাজাই টিলা, রাজাই ঝর্ণাধারা, টেকেরঘাটের বড়ছড়া শুল্ক স্টেশন, বড়ছড়া বীর শহীদদের বধ্যভূমি, ভারতঘেঁষা ভাঙ্গারঘাট কোয়ারি, টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প, শহীদ সিরাজ বীরউত্তম লেক (নীলাদ্রী লেক), ’৭১’র মুক্তিযুদ্ধের ৪নং সেক্টরের ৫নং সাবসেক্টরের টেকেরঘাটের শহীদ স্মৃতিস্থম্ভ, কাঁচবালির টিলা, টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প, টেকেরঘাট পাহাড়ী ছড়া, লাকমা ছড়া, লালঘাট ছড়া, লালঘাট ঝর্ণাধারা, চারাগাঁও শুল্কস্টেশন, লামাকাটা গ্রাম সংলগ্ন সুন্দরবন কোয়ারি ( লেক), বাগলী ছড়া নদী, বাগলী শুল্ক স্টেশন, শনি-মাটিয়াইন হাওর ও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ রামসার সাইট মাদার ফিশারিজ অব টাঙ্গুয়ার হাওরসহ ৩১টি দর্শনীয় স্থান। এছাড়াও জেলার ছাতক উপজেলায় রয়েছে ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, চুন ফ্যাক্টরি, ব্রিটিশ আমলের ইংলিশ টিলা, লাফার্জ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, রূপওয়ে, পেপার মিল, মণিপুরী সম্প্রদায় অধ্যুষিত ছনবাড়ির লাগোয়া সীমান্তনদী সোনাইঘেঁষা বাগানবাড়ি। দোয়ারাবাজার উপজেলায় রয়েছে বাঁশতলা শহীদ মিনার ও বীর শহীদদের কবরস্থান, টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড, সীমান্ত নদী খাসিয়ামারা, আদিবাসী পল্লী ঝুমগাঁও। জেলার সদর উপজেলায় রয়েছে মরমী কবি সাধক পুরুষ হাসন রাজার বাড়ি ও মিউজিয়াম, পুরাতন কালেক্টরেট ভবনে ঐতিহ্য জাদুঘর, ডলুরা শহীদ মিনার। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের যে কোন স্থান থেকে সুনামগঞ্জ জেলা সদর হয়ে সরাসরি বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, লেগুনা, অটোরিক্সায় তাহিরপুর উপজেলা সদর কিংবা লাউড়েরগড় ও বিন্নাকুলিঘাটে পৌঁছে মোটরসাইকেল কিংবা লঞ্চ, স্পীডবোট ও ইঞ্জিন চালিত ট্রলার ভাড়া নিয়ে ইচ্ছেমতো ঘোরাফেরা যায় তাহিরপুরসহ জেলার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানে। কোন পর্যটক কিংবা দর্শনার্থী রাতে থাকতে চাইলে জেলা সদর ছাড়াও তাহিরপুর উপজেলা সদরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো, উপজেলা পরিষদের রেস্ট হাউস, হোটেল টাঙ্গুয়া ইন, টাঙ্গুয়ার হাওরে হাওর বিলাস রেস্ট হাউস, বাণিজ্যিক কেন্দ্র বাদাঘাটের তারেক আবাসিক হোটেল, বড়ছড়া শুল্ক স্টেশনের জয়বাংলা বাজারে হোটেল খন্দকার আবাসিক, টেকেরঘাটের অতিথি ভবন ও জেলা প্রশাসন কর্তৃক নবনির্মিত শহীদ সিরাজ কটেজে নির্ধারিত ভাড়ায় গ্রুপ কিংবা সপরিবারে থাকতে পারবেন। তবে এক্ষেতে বলতে হয় যে সুনামগঞ্জের দর্শনীয় স্থান টাঙ্গুয়ার হাওরসহ অন্যান্য স্থান ঘুরে দেখার জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও তৈরি হয়ে ওঠেনি। বিভিন্নস্থানে এখনও যানবাহন চলাচলের কোন সড়ক নেই। পর্যটকদের জন্য এটা অন্যতম সমস্যা। হবিগঞ্জের দর্শনীয় স্থান সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের একটি প্রাকৃতিক উদ্যান। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার রঘুনন্দন পাহাড়ে অবস্থিত এই উদ্যান । উদ্যানের কাছাকাছি ৯টি চা বাগান আছে। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে রয়েছে ২০০’রও বেশি প্রজাতির গাছপালা। ১৯৭ প্রজাতির জীবজন্তু রয়েছে। এর মধ্যে ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরিসৃপ, ৬ প্রজাতির উভচর প্রাণী। আরও আছে ১৫০-২০০প্রজাতির পাখি। এটি বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং পাখিদের একটি অভয়াশ্রম। বনে লজ্জাবতী বানর, উল্লুক, চশমা পরা হনুমান, কুলু বানর, মেছোবাঘ ও মায়া হরিণ। এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানিহীন ৭টি ছোট খাল বা ছড়া বছরের অধিকাংশ সময় শুকনো থাকে। উজান থেকে নেমে আসা পলিতে এগুলো ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষকালে শুধু বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যায় মাত্র। সে সঙ্গে রয়েছে চাপালিশ, আউয়াল, কাঁকড়া, হারগাজা, হরীতকী, পাম, লটকন, আমড়া, গামার, কাউ, ডুমরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরাজি। বিতঙ্গল আখড়া বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম তীর্থস্থান। বানিয়াচং উপজেলা সদর থেকে ১২ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিম হাওরপারে রামকৃষ্ণ গোস্বামী ষোড়শ শতাব্দীতে আখড়াটি প্রতিষ্ঠা করেন। এতে ১২০ বৈষ্ণবের জন্য ১২০টি কক্ষ রয়েছে। এ আখড়ায় বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় উৎসব পালিত হয়। আখড়ার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে ২৫ মণ ওজনের শ্বেতপাথরের চৌকি, পিতলের তৈরি সিংহাসন, সুসজ্জিত রথ, রৌপ্যপাত্র ও সোনার মুকুটসহ বিভিন্ন সামগ্রী। মধ্যযুগীয় স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে নির্মিত আখড়াটি পর্যটকদের জন্য দর্শনীয় স্থান। বানিয়াচং উপজেলায় রয়েছে ঐতিহাসিক কমলাদিঘি। হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে রয়েছে এক নয়নাভিরাম স্থান রেমা-কালেঙ্গা। এ নৈসর্গিক দৃশ্য না দেখলে কারো উপলব্ধির সুযোগ নেই: এ স্থানটি কি রকম! হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রেমা-কালেঙ্গা বনাঞ্চল ১৪ হাজার ৬শ’ ৩২ একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল। এখানে রয়েছে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, ৭ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১৮ প্রজাতির সরিসৃপ, বিলুপ্তপ্রায় উতবা, কাইম, বনমোরগ, বানর, হনুমান, হরিণ, মৌমাছি, চশমা বানরসহ ৬০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী এবং ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ। ছোট-বড় পাহাড়, টিলা, ১টি লেক, ২শ’ ফুট উঁচু পর্যবেক্ষণ টাওয়ার যা পর্যটকদের খুব সহজেই আকৃষ্ট করতে পারে। করাঙ্গী নদীর ওপর ব্রিজ না থাকায় যাতায়াতক্ষেত্রে রয়েছে ভোগান্তি।
×