ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উৎসবমুখর পরিবেশে সারাদেশে ঈদ উদ্যাপন

প্রকাশিত: ০৯:৫৫, ৮ জুন ২০১৯

 উৎসবমুখর পরিবেশে সারাদেশে ঈদ  উদ্যাপন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চাঁদ দেখা নিয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তের পরও সারাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশেই উদ্যাপিত হয়েছে ঈদ-উল-ফিতর। মুসলিম সম্প্রদায়ের পবিত্র ধর্মীয় উৎসব। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর গত বুধবার পালিত হয়েছে ঈদ-উল-ফিতর। এদিন অগণিত ধর্মপ্রাণ মুসলমান নিজ নিজ ঈদগাহ ও মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে সব ভেদাভেদ ভুলে কোলাকুলিতে মিলিত হয় মুসল্লিরা। একে অপরের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ঈদের নামাজে দেশ,জাতি ও মুসলিম উম্মাহর শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। এদিকে এবারের ঈদ-উল-ফিতর নিয়ে চাঁদ দেখা কমিটির বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে সারাদেশে মানুষ বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। নিয়ম অনুযায়ী গত ২৯ রমজানেই চাঁদ দেখা পর্যালোচনা করতে সভায় বসে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি। সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় এই সভা বসলে রাত ৯টা পর্যন্ত চাঁদ দেখা সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি কমিটি। ফলে পরের দিন বুধবার ঈদ হবে কিনা, এই নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যায় দেশবাসী। রাত ৯টার পর হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত জানানো হয় দেশের কোথাও শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যায়নি। ফলে এবার রোজা ৩০টা পূর্ণ হবে। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হবে পবিত্র ঈদ-উল- ফিতর। দেশবাসী আরও একটি রোজা রাখার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে এই সিদ্ধান্তের ফলে। তারাবি নামাজ আদায় করে অনেকে ঘুমিয়ে পড়ে। এই সময় হঠাৎ করেই জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি আগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দেশের আকাশে চাঁদ দেখা গেছে বলে ঘোষণা দেয়। এতে অনেকেই বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে অনেকে জানতে পারে বুধবার পালিত হবে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। চাঁদ দেখার এই বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে চাঁদ দেখা কমিটি এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে নানা সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। এই নিয়ে অনেকে ফেসবুকে হাস্যরস করতেও ছাড়েনি। চাঁদ দেখার এই বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে বরিশালের ২০ গ্রামের মানুষ প্রথমবারের মতো এবার একদিন পরে ঈদ-উল-ফিতর পালন করেছে। এর আগে চাঁদপুরের ৪০ গ্রামের মানুষ সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে মঙ্গলবারই ঈদ উদ্যাপন করেছে। এদিকে চাঁদ দেখা নিয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দেয়া হলেও রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ঈদ আনন্দে শরিক হয়েছে। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে রাজধানী ছেড়ে যায় লাখ লাখ মানুষ। এবার স্বস্তিতে যেমন ঘরে ফিরতে পেরেছে তেমনি সবার সঙ্গে নিয়ে ঈদ উদ্যাপনে শরিক হতে পেরে তারা খুশিও প্রকাশ করেছে। এছাড়াও মাসব্যাপী সিয়াম সাধনায় প্রকৃতির প্রচ- দাবদাহ থাকলেও ঈদের দিন আবহাওয়ার আচরণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সকাল থেকেই শুরু হয় বৃষ্টি। বৃষ্টির কারণে গরম অনুভূতি কেটে গিয়ে শীতল আমেজ শুরু হয। মুসল্লিরা বৃষ্টির মধ্যেই ঈদের নামাজ আদায় করেন। সারাদেশের ঈদের জামাতগুলোতে দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহর শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করা হয়। সারাদেশে মসজিদগুলোর পাশাপাশি ঈদের ময়দানে গিয়ে নামাজ আদায় করে তারা। সারাদেশের পাশিপাশি রাজধানীবাসী এবার স্বাচ্ছন্দ্যে ঈদ উদ্যাপন করতে পেরেছে। রাজধানীসহ বড় বড় শরে ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে বিদ্যুত সরবরাহ ছিল নিরবচ্ছিন্ন। ঈদে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিও ছিল নিয়ন্ত্রণে। ঈদে আবহাওয়াও অনুকূলে থাকায় নগরবাসীর এবার ঈদ কেটেছে উৎসবমুখর ও আনন্দঘন পরিবেশে। এদিকে দেশের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয় হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে সকাল ৮টায়। এছাড়াও বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে প্রতিবারের ন্যায় এবার ঈদের ৫টি জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানিয়েছে এবার প্রতিটি ওয়ার্ডে চারটি করে ঈদের জামাতের আয়োজন করা হয়েছিল। এর বাইরে প্রতিটি মহল্লার মসজিদেও ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই মুসল্লিরা ঈদের জামাতে শরিক হয়। ঈদের দিন ধনী-গরিবসহ প্রত্যেকের বাড়িতে বাড়িতে বিশেষ আয়োজন করা হয়। বিশেষ করে ঈদের দিন রান্না করা হয় সেমাই, জর্দা পোলাও, কোরমা, ফিরনিসহ নানা ধরনের খাবার। শিশু-কিশোররা সকাল থেকেই আনন্দে মেতে ওঠে। সবাই নতুন জামাকাপড় পরে ঈদের নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে একে অপরের শুভেচ্ছা বিনিময়, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নেয়। অনেকে মৃত আত্মীয়স্বজনদের কবর জিয়ারত করে। প্রধান ঈদের জামাত ॥ এদিকে রাজধানী ঢাকায় প্রধান ঈদ জামাত হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সাড়ে ৮টায় অনুষ্ঠিত এই প্রধান জামাতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হাসান, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্য, সুপ্রীমকোর্ট ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, সিনিয়র রাজনৈতিক নেতা, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন মুসলিম দেশের কূটনীতিকসহ সর্বস্তরের হাজারও মানুষ প্রধান ঈদের জামাতে নামাজ আদায় করেন। নামাজশেষে রাষ্ট্রপতি উপস্থিত সবার সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। জাতীয় ঈদগাহে ঈদের প্রধান জামাতে ইমামতি করেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ মিজানুর রহমান। নামাজশেষে সমগ্র মুসলিম উম্মাহসহ দেশ ও জাতির কল্যাণ, সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন জাতীয় ঈদগাহে এ জামাতের আয়োজন করে। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ঈদগাহে পৌঁছলে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন তাকে স্বাগত জানান। প্রধান জামাতে মহিলা ও বিদেশী কূটনীতিকদের নামাজ আদায়ের বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। মুসল্লিদের জন্য অজু, খাবার পানি ও মোবাইল টয়লেটেরও ব্যবস্থা ছিল। জাতীয় ঈদগাহে সুষ্ঠুভাবে ঈদ জামাত অনুষ্ঠানে নেয়া হয় তিন স্তরের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঈদগাহে সকল প্রবেশপথ এবং ভিভিআইপি ও ভিআইপিদের নামাজের স্থানসহ ঈদগাহ মাঠের গোটা প্যান্ডেলে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। মুসল্লিদের ঈদগাহে প্রবেশের আগে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশির পর আর্চওয়ে দিয়ে প্যান্ডেলে প্রবেশ করতে হয়। প্রধান এ জামাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাদা পোশাকে র‌্যাব এবং পুলিশ সদস্যরা ঈদগাহ ময়দানে সর্বক্ষণিক তৎপর ছিলেন। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এবার ৫৬৮টি স্থানে ঈদ জামাতের আয়োজন করে। দক্ষিণ সিটির ৭৪টি ওয়ার্ডের প্রত্যেকটিতে ৪টি করে এবং জাতীয় ঈদগাহ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠসহ মোট ২৯৮টি স্থানে ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয় এবং উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডে ৫টি করে মোট ২৭০টি ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম জামাত অনুষ্ঠিত হয় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে। এখানে এবারও ৫টি ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জামাত হয় সকাল ৭টায়। এর পরপর আরও ৪টি জামাত যথাক্রমে ৮টা, ৯টা, ১০টা ও পৌনে ১১টায় অনুষ্ঠিত হয়। বায়তুল মোকাররমে ঈদের প্রথম জামাতে ইমামতি করেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মুফতি মুহিবুল্লাহিল বাকী নদভী, দ্বিতীয় জামাতে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি মহিউদ্দিন কাসেম, তৃতীয় জামাতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক ড. মাওলানা মুশতাক আহমাদ, চতুর্থ জামাতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুহাদ্দিস মাওলানা ওয়ালীয়ূর রহমান খান এবং পঞ্চম ও সর্বশেষ জামাতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক মাওলানা জুবাইর আহাম্মদ আল আযহারী। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সকাল সাড়ে ৮টায় ঈদ-উল-ফিতরের জামাতের আয়োজন করা হয়। এখানে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, জাতীয় সংসদের হুইপ, সংসদ সদস্য ও সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ এলাকার মুসল্লিরা ঈদের নামাজ আদায় করেন। এদিকে সারাদেশে বিপুল উৎসহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে পবিত্র ঈদ-উল- ফিতর। প্রতিটি জেলায় প্রায় ২শ’র অধিক ঈদের জামাতের আয়োজন করা হয়। ঈদের দিন অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাতে হাজার হাজার মুসল্লি ঈদ জামাতে শরিক হয়। এবারে ঈদে কুষ্টিয়ার ২ শতাধিক মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। কুষ্টিয়ার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে সকাল ৮টায় ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ সাধারণ মানুষ ঈদের প্রধান জামাতে শরিক হয়। শরীয়তপুরে বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পাশাপাশি কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ২ শতাধিক স্থানে ঈদ-উল-ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। শরীয়তপুর কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে বুধবার সকাল ৮টায় এ জেলার প্রধান ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। নামাজ শেষে মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। এছাড়াও ঈদ উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন এতিমখানা, জেলখানা ও দুস্থদের মাঝে বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হয়। বরিশাল মহানগরীর হেমায়েত উদ্দিন কেন্দ্রীয় ঈদগাহ সকাল ৮টায় ঈদ-উল-ফিতরের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়। নামাজ শেষে দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ, শান্তি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। এদিকে ঈদে সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ছিল সন্তোষজনক। ঈদের জামাতের কোথাও কোন বড় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ঈদের কেনাকাটা থেকে শুরু করে, ঈদে বাড়ি ফেরা ও ঈদ উদ্যাপন হয়েছে নির্বিঘ্নে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবেশে স্বস্তির ঈদ উদ্যাপন করা সম্ভব হয়েছে। ঈদে ঢাকাসহ গোটা দেশেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল ছিল। পবিত্র মাহে রমজানের শুরু থেকেই সারাদেশে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ সময়ে রাজধানীজুড়ে ছিল অতিরিক্ত নিরাপত্ত ব্যবস্থা। রমজানে ও পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরকে সামনে রেখে বিভিন্ন মার্কেট, বিপণিবিতান, কাঁচাবাজার, আড়তের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। স্পর্শকাতর স্থান, সড়ক, স্থাপনা, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশন, লঞ্চ টার্মিনালে অতিরিক্ত র‌্যাব মোতায়েন ছিল। ফলে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেখা যায়নি। ডাকাতি ও ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে র‌্যাবের বিশেষ টিম সব সময়ই থেকেছে মাঠে। শহরের প্রবেশ ও বহির্গমন পথগুলোতে বাড়তি চেকপোস্ট বসানো হয়েছিল। ফলে দেশবাসী স্বস্তিতে ঈদ উদ্যাপন করতে পেরেছে।
×