ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রিয়জনের হাতের স্পর্শ হৃদয়াবেগ, শিল্প-সুষমা

প্রকাশিত: ০৯:৫৬, ২ জুন ২০১৯

প্রিয়জনের হাতের স্পর্শ  হৃদয়াবেগ,  শিল্প-সুষমা

মোরসালিন মিজান ॥ ঈদ কার্ড ফুরিয়ে গেছে, শেষ হয়ে গেছে সেই কাল, না, এমনটি বলা যাবে না। খুব যে আছে, তা-ও নয়। তবে আছে। ইন্টারনেটের যুগে কত বড় বড় ধাক্কা! অনেক কিছু উধাও হয়ে গেছে। ঈদ কার্ড, অন্তত যার চাই, হাত বাড়ালেই পাবেন। পাচ্ছেন। বাকিদের কাছে এই দেয়া নেয়া এখন স্মৃতি। ঈদ আসলে একবার হলেও মনে পড়ে যায়। মনে পড়ছে কি? কী সুন্দর ছিল এক একটি ঈদ কার্ড! যত্নে গড়া। ভালবাসার রঙে রাঙানো। হাতে নিলে মন ভাল হয়ে যেত। একটা পুলক অনুভূত হত ভেতরে। নতুন জামার চেয়ে এর আবেদন কিছু কম ছিল না। অনন্য সুন্দর এ শিল্পকর্মের মাধ্যমে ছোট ছোট কথায় ভাব ভালবাসা বিনিময় করা হতো। রঙিন খামের গায়ে সুগন্ধি কালি দিয়ে ঠিকানা লিখে পাঠিয়ে দেয়া হতো দূর-দূরান্তে। মামুলিকার্ড। কিন্তু তাতে প্রিয়জনের হাতের ছোঁয়া থাকত। থাকত শিল্প সুষমা। ঈদের অনেক আগে সুদূরের প্রিয়জনের জন্য, বন্ধুজনের জন্য পছন্দ করে গ্রীটিংস কার্ড কেনা হতো। ভেতরে পাতলা সাদা কাগজ। সেখানে রঙিন কালিতে হৃদয়ের কথাগুলো লেখা। তারপর দিন তারিখ গুণে পোস্ট অফিসে যাওয়া। নিজ হাতে বক্সে ফেলে আসা। একই সময় নিজের নামে ঈদ কার্ড এলো কিনা, সেই খোঁজ খবর করা। এভাবে পরস্পরের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতার কষ্ট ভুলিয়ে দিত ঈদ কার্ড। আর তারপর ‘আমি কেমন করে পত্র লিখি গো বন্ধু, গ্রাম পোস্টঅফিস নাই জানা...।’ আজ আর গ্রাম পোস্ট অফিস জানার প্রয়োজন হয় না। হাতের মুঠোয় ধরে রাখা স্মার্ট ফোনে সব। মুহূর্তেই অডিও কল। ভিডিও কল। অসংখ্য এ্যাপস। এসবের প্রভাবে ঈদ কার্ডের ব্যবহার অনেক কমেছে। তবে বিলীন হয়ে যায়নি। উন্নত রুচি আর সমৃদ্ধ চেতনার মানুষেরা এখনও গ্রিটিংস কার্ডের খোঁজ করেন। পোস্টঅফিসে যান না বটে, কুরিয়ারে দেয়া নেয়া চলছে। ধারাটি ধরে রাখার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বিশ্বস্থ নেতাকর্মী ও বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনদের কার্ডের মাধ্যমে ঈদের শুভেচ্ছা জানান তিনি। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যার স্বাক্ষর করা ঈদ কার্ড পৌঁছে গেছে প্রাপকের হাতে। কার্ডে সবার জন্য আনন্দঘন ঈদ প্রত্যাশা করেছেন তিনি। এখানেই ঈদ কার্ডের প্রকৃত সৌন্দর্য। অভিন্ন কারণে আর সব কেনাকাটার পাশাপাশি এখন অনেকেই ঈদ কার্ড কিনছেন। রাজধানীর পুরানা পল্টন, নিউমার্কেট, ধানম-ি, বসুন্ধরা সিটি শপিংমল, এলিফ্যান্ট রোড, হাতিরপুলসহ বিভিন্ন এলাকার গিফটশপ ঘুরে দেখা গেছে এমন দৃশ্য। ঈদ কার্ডের গায়ে আগের মতোই লতা পাতা ফুলের ডিজাইন। পাখি ছবি। ফুলের পাপড়িতে, পাখির ডানায় উজ্জ্বল রঙের পাথর, পুঁতি, জরি ইত্যাদি বসিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলা, ইংরেজী ও আরবী ভাষায় লেখা হয়েছে- ঈদ মোবারক। কোনটির গায়ে আবার মসজিদের ছবি। শক্ত কাগজ কেটে চমৎকার নক্সা করা হয়েছে কিছু কার্ডে। দোকানগুলোতে ছোট বড় এবং মাঝারি মাপের কার্ড পাওয়া যাচ্ছে। কিছু কার্ড এত বড় যে, দরজার কপাটের মতো খুলতে হয়। আর খুললেই মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়ায়। ঈদ কার্ডের জন্য আলাদা পরিচিতি আছে পল্টন এলাকার। এখানে এখন অনেকগুলো দোকান। আছে আজাদ প্রোডাক্টসও। এক সময় আজাদ প্রোডাক্টসের ঈদ কার্ড গ্রামেগঞ্জে পৌঁছে গিয়েছিল। এখন যেন নিয়ম রক্ষার চেষ্টা। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ইকবাল হোসেন জানান, তারা সারাবছর বিয়ের কার্ড ছাপানোর কাজ করেন। সামনে ঈদ। তাই কিছু ঈদ কার্ডও রেখেছেন। এবার ১৫টির মতো নতুন ডিজাইন করা হয়েছে বলে জানান তিনি। দাম অপেক্ষাকৃত কম। ১৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। কাছাকাছি দূরত্বে আইডিয়াল প্রোডাক্টসের শোরুম। ও রাখা আছে ঈদ কার্ড। ম্যানেজার নজরুল ইসলাম জানান, প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঈদ কার্ড বিক্রি হয়। খুচরা বিক্রি হয়। ঢাকার বাইরেও যাচ্ছে। তবে চাহিদা আগের তুলনায় অনেক কম বলে ছাপাও হয় কম করে। গিফটশপ হলমার্কের শোরুমগুলোতেও আছে ঈদ কার্ড। হাতিরপুলের একটি শোরুমে গিয়ে দেখা যায়, বেশ বড় পরিসর। প্রায় পুরোটাজুড়েই আকর্ষণীয় উপহার সামগ্রী সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এক পাশে পাওয়া গেল গ্রিটিংস কার্ড। ঈদ কার্ড আছে ৮ থেকে ১০ ডিজাইনের। ভেতরে ছোট ছোট কথা। মিষ্টি উচ্চারণ। শোরুমের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব কার্ডের দাম ৭০ টাকা থেকে ১১০০ টাকা পর্যন্ত। চাহিদা কেমন? জানতে চাইলে সুমন নামের এক বিক্রয়কর্মী বলেন, আগের মতো চলে না। তবে কিছু কাস্টমার এখনও আছে। তাদের জন্যই ঈদ কার্ড এখনও রাখি। অন্যান্য গ্রিটিংস কার্ড কম বেশি সারাবছরই চলে। ঈদ কার্ড বিক্রি হয় শুধু ঈদ উপলক্ষে। তাই কম করা হয় বলে জানান তিনি। বসুন্ধরা সিটি শপিংমলে আছে আর্চিসের একটি শোরুম। শোরুমটির দায়িত্বে থাকা রুবেল জানান, তারা মূলত গিফট আইটেম বিক্রি করেন। সঙ্গে কিছু কার্ডও রাখা হয়। এক সময় ঈদ কার্ড কিনতে এসে লোকে কিছু গিফট আইটেম কিনে নিতেন। এখন গিফট আইটেম কিনতে এসে ঈদ কার্ড নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি। এই শোরুমে কথা হয় সুহানা ও সাদিয়ার সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য বের হওয়া দুই বান্ধবী বেছে বেছে ঈদ কার্ড কিনছিলেন। সুহানা বললেন, ঈদ কার্ডের কথা আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম। এখানে গিফট কিনতে এসে দেখে মনে পড়ে গেল। কিছু ঈদ কার্ড কিনেছি। যাদের গিফট দেব তাদের একটি করে ঈদ কার্ডও দেবেন বলে জানান তিনি। সাদিয়া বলেন, ঈদ কার্ডের আবেদন ফুরিয়ে যায়নি। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে এসে ব্যবহার কমেছে। তবে হয়ত একদিন ফুরিয়ে যাবে। তবে ঈদ কার্ড আদান প্রদানের দারুণ সব স্মৃতি মনে গেঁথে থাকবে বলে মনে করেন তিনি।
×