ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রিড সংযুক্ত বিদ্যুত কেন্দ্রের ক্ষমতা ১৭ হাজার ৭০১ মেগাওয়াট ;###;উৎপাদন হয়েছে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৫৩৯ মেগাওয়াট ;###;পিডিবি বলছে, চাহিদা থাকলে আরও উৎপাদন সম্ভব ;###;মানসম্মত বিতরণ ব্যবস্থার অভাবে ক্ষমতার সবটা ব্যবহার করা যাচ্ছে না

বিদ্যুতে রেকর্ড ॥ চাহিদার দেড় গুণ উৎপাদন ক্ষমতা

প্রকাশিত: ১০:১১, ১ জুন ২০১৯

বিদ্যুতে রেকর্ড ॥ চাহিদার দেড় গুণ উৎপাদন ক্ষমতা

রশিদ মামুন ॥ দেশে এখন গ্রিড সংযুক্ত বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১৭ হাজার ৭০১ মেগাওয়াট। উৎপাদন ক্ষমতার বিপরীতে সর্বোচ্চ রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৫৩৯ মেগাওয়াট। পিডিবি বলছে চাহিদা থাকলে আরও বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। মানসম্মত বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থার অভাবে উৎপাদন ক্ষমতার সবটা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে খরচ কমাতেও তেল চালিত কেন্দ্র বন্ধ রাখা হচ্ছে। বিদ্যুত নিয়ে কিছুটা গ্রাহকের অসন্তোষ রয়ে গেছে একারণেই। পিডিবি বলছে, গত কয়েক বছরে দেশে বিদ্যুত উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ফলে এখন চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুত সরবরাহ কোন সমস্যা নয়। আবার বিদ্যুতের সঞ্চালন কোম্পানি পিজিসিবি বলছে দেশে এখন ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হলেও তারা সঞ্চালন করতে পারবে। তাদের মতে একটি গ্রিড সাবস্টেশন থেকে আরেক সাবস্টেশনে বিদ্যুত সরবরাহে কোন সমস্যা নেই। তাহলে গ্রাহক অসন্তোষ কেন। এমন প্রশ্নে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানসম্মত বিদ্যুত সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি এখনও। বিদ্যুত, জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিজেও বলেছেন মানসম্মত বিদ্যুত সরবরাহ এখন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার সেই লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য আরও কিছুটা সময় প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। গত ১০ বছরে সরকারের যে পরিসংখ্যান তাতে বলা হচ্ছে বিদ্যুত কেন্দ্রের সংখ্যা ২৭টি থেকে বেড়ে এখন ১৩০টি হয়েছে। এই সময় উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভসহ)। সর্বোচ্চ বিদ্যুত উৎপাদনের রেকর্ডেও অতিরিক্ত ৯ হাজার ২৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুত যোগ হয়েছে। সরকার বলছে ২০০৯ সালে সর্বোচ্চ বিদ্যুত উৎপাদন ছিল তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট আর ২০১৯ সালে এসে যা বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার ৫৩৯ মেগাওয়াট। সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ আট হাজার কিলোমিটার থেকে ১১ হাজার ৪৯৩ মেগাওয়াট অর্থাৎ তিন হাজার ৪৯৩ মেগাওয়াট বেড়েছে। বিতরণ লাইন দুই লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ১৪ হাজার কিলোমিটার। এই সময়ে গ্রিড সাবস্টেশন ক্ষমতা ১৫ হাজার ৮৭০ এমভিএ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৯ হাজার ৯৭৬ এমভিএ। বিদ্যুতের সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০০৯ সালে ছিল ৪৭ শতাংশ এখন যা ৯৩ শতাংশ। সরকার বলছে চলতি বছরের মধ্যে শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে যাবে। যদিও সরকার এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ২০২১ সালকে নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু সব সূচকে উন্নয়ন ঘটার পর এখন গ্রাহকের চাহিদা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ। বিদ্যুত বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ মেয়াদী ফলপ্রসূ পরিকল্পনার অভাবে বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থার এই দশা। আবার বিতরণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, কোন একটি এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহের শুরুতে শুধু ফ্যান আর লাইটসহ প্রয়োজনীয় কিছু বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম হিসেব করে সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। কিন্তু কয়েক বছর ঘুরতেই ওই এলাকার বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায় এতে করে সাবস্টেশন, ট্রান্সফরমার এবং বৈদ্যুতিক তার সবকিছুই ওভারলোডেড হয়ে পড়ে। ফলে বিতরণ ব্যবস্থা ত্রুটি যুক্ত হয়ে পড়ে। সৃষ্টি হয় লোভোল্টেজের এবং বিতরণ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে লোডশেডিংও করতে হয়। সরকারী হিসেবে দেশে কোন লোডশেডিং নেই। পিডিবি এবং পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি) যে দিন যতটা বিদ্যুতের চাহিদা দেখাচ্ছে সেই দিন ঠিক ততটাই উৎপাদন দেখাচ্ছে। অর্থাৎ পিডিবি এবং পিজিসিবির হিসেবে কোন লোডশেডিং নেই। কিন্তু দেশের গ্রাম পর্যায়ে এখনও প্রতিদিন নিয়ম করেই লোডশেডিং করা হয়। যার বেশিরভাগেরই খবর ওপর পর্যায়ে আসেও না। স্থানীয়ভাবে বিদ্যুত বন্ধ রাখার কারণে গ্রাহক অসন্তোষের খোঁজ রাখাটাকেও জরুরী মনে করা হয়। বিশেষ করে পল্লী বিদ্যুত এলাকার জেনারেল ম্যানেজাররা মনে করেন তার এলাকায় বিদ্যুত না থাকাটা তার এক ধরনের ব্যর্থতা। এই খবরটি নানাভাবে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে উপরমহলকে ভুলও বোঝানো হয়। এতে করে সমস্যার সমাধান হয় না। মোটামুটি উপজেলা সদর পর্যন্ত বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও গ্রামে গ্রামে এখনও বিদ্যুতের সঙ্কট রয়ে গেছে। জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, এ কথা স্বীকার করতে হবে মানুষ এখনও নিরবচ্ছিন্ন এবং মানসম্মত বিদ্যুত পাচ্ছে না। দুই ধরনের কারণে মানুষ বিদু্যুত পাচ্ছে না বলে জানান তিনি। এর একটি হচ্ছে প্রাকৃতিক। তিনি বলেন, এখন প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের বিতরণ লাইনগুলোর ওপর গাছপালা রয়েছে। এসব বিতরণ লাইনের ওপর গাছপালা পড়ে তার ছিঁড়ে যাচ্ছে। এতে করে বিদ্যুত বিতরণে সমস্যা হচ্ছে। তিনি মনে করেন এরজন মাটির নিচে দিয়ে বিদ্যুতের লাইন করতে হবে। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে সারাদেশে এভাবে বিতরণ লাইন করা ব্যয়সাপেক্ষ। যেটা চাইলেই খুব অল্প সময়ে করা সম্ভব নয়। অন্য কারণটি কারিগরি বলে মনে করেন তিনি। মোহাম্মদ হোসেন বলেন, আমাদের চাহিদার তুলনায় তার, ফিডার সবকিছুই ওভারলোডে চলছে। অনেক সময় গরমের সময় দেখা যায় তার গরম হয়ে যায়। তখন বিপত্তি ঘটার ভয়ে বন্ধ রাখতে হয়। বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটি থাকলে ক্রমে তা সারিয়ে তেলার দাবি করে পিডিবি চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ বলেন, গত কয়েকদিন ঝড় বৃষ্টির জন্য বিতরণ ব্যবস্থা খারাপ ছিল। কিন্তু গত দুই দিন ধরে বেশ ভাল দাবি করে তিনি বলেন, দেখা যায় সন্ধ্যায় ঝড় হচ্ছে। একবার ঠিক করে আসার পর আবার শেষ রাতে ঝড় হচ্ছে। এটা আবার ঠিক করতে সময় লেগে যাচ্ছে। তবে সত্যিকার অর্থে বিদ্যুতের চাহিদা হিসেব করে উৎপাদন হচ্ছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের। একটি ফিডারে কি পরিমাণ চাহিদা রয়েছে এভাবে সারাদেশে যত ফিডার রয়েছে তার দিন এবং রাতের চাহিদা হিসেব করে বিদ্যুতের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে ধারণা ভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়। আর ওই অনুপাতেই উৎপাদন হয়। এতে করে গ্রাহক সঠিক পরিমাণ বিদ্যুত পায় না। অভিযোগ রয়েছে পিডিবি তরল জ্বালানি চালিত বিদ্যুত কেন্দ্র ভর্তুকি দেয়ার ভয়ে বন্ধ রাখছে। এতেও সঙ্কট তৈরি হচ্ছে কিন্তু তা স্বীকার করছে না কেউ। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, দেশে এখন তেল চালিত বিদ্যুত কেন্দ্র শতকরা ৩০ ভাগ। যা থাকা উচিত ছিল ১০ ভাগ। এই তেল চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। ভর্তুকি বৃদ্ধির ভয়ে এসব কেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়। এতে সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। যা কেউ স্বীকার করছেন না।
×