ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একসঙ্গে আর দেখা যাবে না পঞ্চপা-বকে

প্রকাশিত: ১২:০৯, ২৯ মে ২০১৯

একসঙ্গে আর দেখা যাবে না পঞ্চপা-বকে

মাশরাফি বিন মর্তুজা, মুশফিকুর রহীম, সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের এটি চতুর্থ বিশ্বকাপ। আর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের তৃতীয়। মাশরাফির সর্বাধিক পঞ্চম বিশ্বকাপ হতে পারতো এটি। ২০০৩ বিশ্বকাপে প্রথম খেলেছিলেন, কিন্তু ইনজুরিজনিত কারণে ফিটনেস সমস্যায় তার খেলা হয়নি ২০১১ সালের বিশ্বকাপ। আর ২০০৭ থেকে টানা তিন বিশ্বকাপ খেলেছেন সাকিব, মুশফিক ও তামিম। পঞ্চপা-বের মধ্যে রিয়াদই সবার পরে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি ২০১১ বিশ্বকাপে প্রথম খেলেন। তবে পরে জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য হলেও পঞ্চপা-বের অন্যতম একজন হয়ে গেছেন দুর্দান্ত ফর্মের কারণে। এর মধ্যে ৩৫ বছর বয়সী মাশরাফি এবার দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দেবেন। আর কোন অধিনায়ক একাধিকবার বাংলাদেশ দলকে বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব করার সুযোগ পাননি। বয়সের কারণে এমনিতেই তিনি চার বছর পর আর হয়তো খেলতেই পারতেন না বিশ্বকাপ। আর নিজে থেকেই আগেভাগে জানিয়ে দিয়েছেন, এটিই তার শেষ বিশ্বকাপ। এমনকি ৩৩ বছর বয়সী রিয়াদ, ৩২ বছর বয়সী সাকিব, ৩১ বছর বয়সী মুশফিকের মধ্যে থেকেও কারও কারও পরবর্তী বিশ্বকাপ খেলা নাও হতে পারে। পঞ্চপা-বের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী বাঁহাতি ওপেনার তামিম। ৩০ বছর বয়সী তামিমের পরবর্তী বিশ্বকাপ খেলার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আগের বিশ্বকাপগুলোয় এ ৫ অভিজ্ঞ ক্রিকেটারই বাংলাদেশকে দারুণ কিছু উপহার দিয়েছেন। এবারই এই ‘ফাইভ স্টার’ একসঙ্গে শেষ বিশ্বকাপ খেলবেন এবং তাদের কাছে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের সর্বোচ্চ সাফল্যটাই পাওয়ার আশা। বাংলাদেশ দল প্রথম বিশ্বকাপ খেলে ১৯৯৯ সালে। সেই দলটির কেউ বর্তমানে নেই বাংলাদেশ দলে। তবে পরের বিশ্বকাপ খেলা মাশরাফি এবার অধিনায়ক। মাঝে ২০১১ বিশ্বকাপে ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি এ তারকা পেসার। সেবার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাকিব। তবে ২০১৫ সালের পর এবার দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে খেলতে যাচ্ছেন মাশরাফি। আর রিয়াদ জাতীয় দলে নিয়মিত হয়েছেন অনেক পরে। তাই বাকি চারজনের এটি চতুর্থ বিশ্বকাপ হলেও রিয়াদের এটি তৃতীয় বিশ্বকাপ। এই ৫ ক্রিকেটারের ওপরই নির্ভরতা বাংলাদেশ দলের। তাদের পারফর্মেন্সের ওপরই বাংলাদেশের সাফল্য নির্ভর করছে। কিন্তু প্রধান কোচ স্টিভ রোডস এমনটা ভাবছেন না। বর্তমানে ৫ অভিজ্ঞের ওপর নির্ভরতা অনেকখানিই কমে গেছে বলে দাবি তার। অবশ্য, সাম্প্রতিক সময়ে টাইগারদের নৈপুণ্য সেটাই প্রমাণ করে। রোডস বলেন, ‘আপনি যদি মোসাদ্দেককে একটি উদাহরণ হিসেবে দেখেন, সে কিন্তু প্রত্যেককে নতজানু হতে এখন বাধ্য করতে যাচ্ছে। স্কোয়াডের গভীরতা এখন এটাই যে সে হয়তো এরপরেও খেলার সুযোগ পাবে না। তাই যদি হয় তাহলেও আমরা ভাল অবস্থানে থাকতে পারব (অন্যদের পারফর্মেন্সে), কেননা আরও ভাল খেলোয়াড় দলে রয়েছে। এর মানে এটাই যে বাংলাদেশের দলের স্কোয়াড দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে এবং স্কোয়াডের এই গভীরতাটাই আমরা চাইছি। সেটি যদি আমরা অর্জন করতে পারি তাহলে মানুষ পঞ্চপা-বকে নিয়ে কথা বলা থামিয়ে দিবে। এর মানে এদের কেউ না থাকলেও আমরা শক্তিশালী দল।’ এরপরেও মাশরাফি-সাকিব-রিয়াদদের ছাড়া বাংলাদেশ দলটিকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে আগামীতে। এবারের বিশ্বকাপেও তাদের ওপর বাড়তি প্রত্যাশা থাকছে। এর কারণ তাদের বিশ্বকাপে অতীত পারফর্মেন্স। বিশ্বকাপ নৈপুণ্য বিশ্লেষণ করলেই সেটি স্পষ্ট হবে। মাশরাফি বিন মর্তুজা (২০০৩-২০১৫) ॥ ২০০৩ বিশ্বকাপে অন্যতম পেস স্তম্ভ হিসেবে খেলেছেন মাশরাফি। ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ ক্যারিয়ারের প্রথম সেই বিশ্বকাপ খেলার পর ২০০৭ ও ২০১৫ সালে আরও দুই বিশ্বকাপ খেলেন। ফিটনেস সমস্যায় ২০১১ সালে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে খেলা হয়নি মাশরাফির। তবে ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল তাদের সেরা সাফল্য পেয়েছে। মাশরাফির হাত ধরে প্রথমবার কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে টাইগাররা। এবার মাশরাফির কাছে প্রত্যাশার পরিমাণ অনেক অনেক বেশি। ৩৫ বছর বয়সী এ ডানহাতি পেসার বোলিংয়ে নিখুঁত লাইন-লেন্থে যেমন পারদর্শী তেমনি দল পরিচালনায় অধিনায়ক হিসেবে সারাবিশ্বেই বেশ প্রশংসিত। এবারই প্রথম তিনি দলকে নিয়ে বিশ্বকাপে নামবেন একটি আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতে। সম্প্রতিই ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে আয়ারল্যান্ডের মাটিতে প্রথম কোন টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে বাংলাদেশ দল মাশরাফির নেতৃত্বে। মাশরাফি বিশ্বকাপে ১৬ ম্যাচ খেলেছেন। ১৩১.২ ওভার বোলিং করে শিকার করেছেন ১৮ উইকেট। মাত্র ৪.৯৪ ইকোনমি ও ৩৬.০৫ গড়ে তিনি এই সাফল্য পেয়েছেন। সেরা বোলিং ৩৮ রানে ৪ উইকেট। ব্যাট হাতে ১৩ ইনিংসে নেমেছিলেন। সর্বোচ্চ ৩৭ রানের একটি ইনিংসও খেলেছেন। ৭৯.৩২ স্ট্রাইকরেট ও ১৫.০০ গড়ে ১৬৫ রান করেছেন। দু’বার শুন্য রানে আউট হয়েছেন। সাকিব আল হাসান (২০০৭-২০১৫) ॥ ২০০৭ বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলা সাকিব বাংলাদেশের পক্ষে তামিম-মুশফিকের সঙ্গে যৌথভাবে সর্বাধিক ২১ ম্যাচ খেলেছেন। বিশ্বের অন্যতম এ অলরাউন্ডার সব প্রতিপক্ষের জন্যই সবচেয়ে বড় লক্ষ্যস্থল। ২০১১ বিশ্বকাপে মাশরাফি না থাকায় নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ঘরের মাটিতে হওয়া সেই বিশ্বকাপে লজ্জার কিছু রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ দল। এমনকি অধিনায়ক হয়েও দর্শকদের অশোভন ইঙ্গিত করায় তোপের মুখে পড়েন সাকিব। তার বাড়িতেও ফলস্বরূপ হামলা হয়েছিল। সেই বিশ্বকাপটা সাকিবের দুঃসহ স্মৃতির হলেও বাংলাদেশ দলের অন্যতম ভরসা তিনি। ব্যাটে-বলে সমান কার্যকর হওয়াতে তিনিই সবচেয়ে অপরিহার্য ক্রিকেটার দলের। সাকিব টানা তিন বিশ্বকাপের ২১ ম্যাচ খেলেছেন। বাংলাদেশী বোলারদের মধ্যে সর্বাধিক ২৩ উইকেট তার দখলে। ১৬৪.৫ ওভার বোলিং করে ৪.৯৯ ইকোনমি ও ৩৫.৭৮ গড়ে এই বোলিং নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তিনি। আবার ব্যাট হাতে নিয়েও তিনিই বাংলাদেশের সেরা বিশ্বকাপ পারফর্মার। সব ম্যাচেই ব্যাটিং করেছেন। ৫ অর্ধশতকে ৭০.৮৬ স্ট্রাইকরেট ও ৩০ গড়ে করেছেন ৫৪০ রান। মাত্র একবার শূন্য রানে আউট হয়েছেন, ৩ বার থেকেছেন অপরাজিত। তবে বিশ্বকাপে সর্বাধিক ফিফটি বাংলাদেশীদের মধ্যে তারই ব্যাট থেকে বেরিয়েছে। তামিম ইকবাল (২০০৭-২০১৫) ॥ পঞ্চপা-বের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ তামিম। বাঁহাতি এ ওপেনার বয়সে পিছিয়ে থাকলেও দুর্দান্ত নৈপুণ্যে দলের অন্যতম টপঅর্ডার তিনি। ২১ ম্যাচ খেলেছেন চট্টগ্রামের এ তারকা। ক্যারিয়ারের চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলতে নামার আগে তামিমের ব্যাটের দিকে অনেক ভরসা নিয়ে তাকিয়ে আছে দল এবং দেশের অজ¯্র ভক্ত। সাম্প্রতিক সময়ে ফর্মের তুঙ্গে আছেন ৩০ বছর বয়সী তামিম। আগের বিশ্বকাপগুলোয় অবশ্য আহামরি কিছু করতে পারেননি। মাত্র ২৩.০০ গড় ও ৭৩.৮৫ স্ট্রাইকরেটে ৩টি ফিফটিসহ করেছেন ৪৮৩ রান। তিনবার শূন্য রানে সাজঘরে ফিরেছেন, অপরাজিত থাকতে পারেননি একটি ম্যাচেও। এবার নিশ্চিতভাবেই আগের রেকর্ড আরও সমৃদ্ধ করার সংকল্প নিয়েই নামবেন তামিম। মুশফিকুর রহীম (২০০৭-২০১৫) ॥ মিডলঅর্ডারে ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অনেক আগেই। টপঅর্ডার ব্যর্থ হলে দলকে বিপদ থেকে টেনে তুলে দারুণ অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন অতীতে। ক্যারিয়ারের চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলতে নামবেন এবার। উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান হিসেবে অন্য যেকোন দলের চেয়ে বেশি মনোযোগের কেন্দ্রে আছেন মুশফিক। ফর্মের ধারাবাহিকতা থাকার জন্য স্বীকৃত মুশফিক ২১ ম্যাচ খেলেছেন। চারটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৩১.৮৭ গড় ও ৭২.০৩ স্ট্রাইকরেটে করেছেন ৫১০ রান। বিশ্বকাপে সর্বাধিক ৮ ছক্কা হাঁকিয়েছেন তিনি বাংলাদেশের পক্ষে। ৪ বার অপরাজিত থেকেছেন, শূন্য রানে ফিরেছেন ২ বার। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ (২০১১-২০১৫) ॥ বয়সের দিক থেকে মাশরাফির পরেই রিয়াদ। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে থিতু হতে পেরেছেন অনেক পরে। এরপরও এবার নিয়ে তৃতীয় বিশ্বকাপে খেলতে যাচ্ছেন ৩৩ বছর বয়সী এ লেট মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান। শেষের দিকে বিপদে পড়া দলকে টেনে তুলে জয়ের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার কিংবা জয় এনে দেয়ার নজির অনেকবারই দেখিয়েছেন। আবার প্রয়োজনে ওপরের দিকেও ব্যাট করেছেন। বিশেষ করে গত বিশ্বকাপে চার নম্বরে ব্যাট করে টানা দুই ম্যাচে শতক হাঁকিয়ে অনেক রেকর্ডও ওলট-পালট করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে আর কোন ব্যাটসম্যান বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি হাঁকাতে না পারলেও রিয়াদের ব্যাট থেকে বেরিয়েছে দুটি শতক। এবারও তার ব্যাটের দিকে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ দল। মাত্র ১০টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। ৯ ইনিংস ব্যাট চালিয়ে ২ সেঞ্চুরি, ১ হাফসেঞ্চুরিসহ ৭৭.৬৯ স্ট্রাইকরেট ও ঈর্ষণীয় ৫৬.৭১ গড়ে করেছেন ৩৯৭ রান। শূন্য রানে ফেরেননি একবারও এবং ২ বার থেকেছেন অপরাজিত। বিশ্বকাপে অন্তত ১০ ম্যাচ খেলা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তার গড়ই সর্বাধিক। দলের প্রয়োজনে বেশ কার্যকরী অফস্পিনও করতে পারেন রিয়াদ। বিশ্বকাপে ৪৬ ওভার বোলিং করে ৪ উইকেটও ঝুলিতে পুরেছেন।
×