ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খুদে দাবাড়ু খুশবুর আহাজারি

প্রকাশিত: ১০:০৪, ২৮ মে ২০১৯

 খুদে দাবাড়ু খুশবুর আহাজারি

রুমেল খান ॥ প্রতিভা এমন একটি ব্যাপার যাকে কখনও দমিয়ে রাখা যায় না। শুধু একে সুযোগ, সহযোগিতা ও পরিচর্যা করতে হয়। নইলে তা বিনাশ হয়ে যায় অঙ্কুরেই। ওয়ারসিয়া খুশবু হচ্ছে তেমনই এক প্রতিভা। এক প্রতিভাময়ী ক্ষুদে দাবাড়ু। বয়স এখনও সাত হয়নি (জন্ম ২১ আগস্ট, ২০১২), অথচ কি দাপট-আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে খেলে প্রতিপক্ষ বাঘা বাঘা দাবাড়ুদের নাজেহাল করে ছাড়ে! ঢাকার মগবাজার (নয়াটোলা) নিবাসী এই মিষ্টি মুখশ্রীর বালিকাটির বেশ ক’দিন ধরেই মন ভাল নেই। কেননা একটি মাত্র বিমান টিকেট এবং নিবন্ধন ফি’র অর্থের অভাবে তার উজবেকিস্তানে যাওয়া হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। ওখানে তার এশিয়ান ইয়ুথ চেস চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার কথা যা অনুষ্ঠিত হবে ১৯-২৯ জুন পর্যন্ত। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাকর এই টুর্নামেন্টে অংশ নেয়ার মতো সবরকম যোগ্যতা থাকার পরও খুশবু শুধু অর্থের অভাবে উজবেকিস্তানে উড়াল দিতে পারছে না। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য বিষয়টি নিঃসন্দেহে হতাশার এবং দুঃখজনক। খুশবু নিজেও দারুণভাবে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত। সেই সঙ্গে তাকে সাহায্য করার জন্য সমাজের বিত্তবান ও ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে সাহায্যের আবেদনও জানিয়েছে খুব ছোট্ট করে, ‘কেউ কী আমাকে একটি টিকেট দিতে পারেন না!’ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দাবায় এই অল্প বয়সেই চোখ ধাঁধানো সাফল্য কুড়িয়ে নিয়েছে খুশবু। ২০১৮ সালে জাতীয় অনুর্ধ-১৬ দাবায় বয়সভিত্তিকে অনুর্ধ-৮ বিভাগে, স্বাধীনতা দিবস র‌্যাপিড দাবায় অনুর্ধ-১০ বিভাগে, গেটওয়ে আন্তর্জাতিক স্কুল দাবায়, এলিগেন্ট ঢাকা আন্তর্জাতিক স্কুল দাবায় বয়সভিত্তিক চ্যাম্পিয়ন হয় সে। একই বছরে শেখ রাসেল স্মৃতি স্কুল দাবায় এবং প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত দাবা প্রতিযোগিতায় রৌপ্যপদক লাভ করে। আন্তর্জাতিক দাবায়ও কিস্তিমাত করেছে খুশবু। ২০১৮ সালে ভারতের কলকাতায় দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল দাবায়, উজবেকিস্তানে ওয়েস্টার্ন ইয়ুথ এশিয়া চেস টুর্নামেন্টে অনুর্ধ-৬ বিভাগে এবং থাইল্যান্ডে এশিয়ান ইয়ুথ চ্যাম্পিয়শিপে অনুর্ধ-৬ বিভাগে স্বর্ণপদক জেতে। শেষের টুর্নামেন্টে অন্য দুটি ক্যাটাগরিতে দুটি রৌপ্যপদকও লাভ করে। ২০১৯ সালে এলিগেন্ট জাতীয় যুব দাবায় অনুর্ধ-৮ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন এবং সদ্য সমাপ্ত জাতীয় জুনিয়র দাবায় (অনুর্ধ-২০) তাম্রপদক লাভ করে খুশবু। এ বছরই অনুর্ধ-১৩ স্ট্যান্ডার্ড দাবা টুর্নামেন্টে এবং ভারতের মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত মুম্বাই আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতায় অনুর্ধ-৮ বিভাগে রানারআপ হয়েছে। দেশী-বিদেশী সবধরনের টুর্নামেন্ট মিলিয়ে খুশবু ৯টিতে চ্যাম্পিয়ন, ৬টিতে রানারআপ এবং ১টিতে তাম্রপদক পেয়েছে। কোন সন্দেহ নেই, মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো সাফল্য। মাত্র পাঁচ বছরেই দাবার সঙ্গে তার সখ্য গড়ে উঠে। বাবার কাছে দাবার হাতেখড়ি খুশবুর। তবে নারায়ণগঞ্জের মহিলা দাবাড়ু ইভানা কামালের উৎসাহেই দাবার ভুবনে পা রাখে খুশবু। ২০১৭ সালে প্রতিযোগিতামূলক আসরে খেলতে নেমেই ফিদে আন্তর্জাতিক রেটিং লাভ করে। আরেক ক্ষুদে দাবাড়ু আর্শিয়া দাসকে ভারতের ভবিষত্যের সেরা সম্ভাবনাময় দাবাড়ু হিসেবে ধরা হয়। ২০১৮ সালে ভারতের কলকাতায় খেলতে গিয়ে টেলিগ্রাফ স্কুল দাবায় সেই আর্শিয়াকে হারিয়ে দিয়েছিল খুশবু! দেশেও সে তার চেয়ে বয়সে বড়-সিনিয়র রেটিংধারী অনেক দাবাড়ুকে হারিয়েছে। নিজের দেশকে তিনবার আন্তর্জাতিক সাফল্য এনে দিয়েছে মাত্র ছয় বছরের ছোট্ট মেয়ে খুশবু। সংখ্যাটাকে চার-এ উন্নীত করার সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে তাকে। কিন্তু স্রেফ টাকার অভাবই তার এই সুনীল স্বপ্ন বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই আসরে যদি খুশবু অংশ নিতে পারে তাহলে শিরোপা জয়ের সম্ভাবনার পাশাপাশি খেতাব বা নর্ম অর্জনের সুযোগ রয়েছে তার। মেয়ের এই হতাশায় তারচেয়েও বেশি হতাশায় ভুগছেন তার বাবা মেহেদী কায়সার। একটি এনজিওতে প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করছেন। যা উপার্জন করেন তার সিংহভাগই মেয়ের খেলার পেছনে ব্যয় করেন। কারণ তিনি দৃঢ় আশাবাদীÑ তার মেয়েটা অনেকদূর যাবে দাবা খেলে। কিন্তু নিজের চাকরি স্বল্প টাকায় মেয়েকে বড় দাবাড়ু বানানো খুবই কষ্টসাধ্য। এ জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষক খুঁজতে, কিন্তু সেই প্রচেষ্টাও আলোর মুখ দেখছে না। উজবেকিস্তান যেতে কত টাকা লাগবে খুশবুর? মেহেদী জানান, ‘দরকার একটি বিমানের টিকেট আর রেজিস্ট্রশেন ফি। সবমিলিয়ে একলাখ দশ হাজার টাকা পেলেই চলবে। হাতে এখনও ১৫-২০ দিন সময় আছে। তবে যতই দিন গড়াচ্ছে ততই টিকেটের দাম বাড়ছে। বিমান টিকেটের মূল্য এখন ৭০/৮০ হাজার টাকা। কিন্তু ঈদের পরেই সেটা হয়ে যাবে এক লাখ টাকারও বেশি! বছর খানেক দেশের বাইরে ছয়টি টুর্নামেন্টে অংশ নিতে অনেক ঋণ নিয়ে ও বন্ধুদের সহায়তা নিয়ে খুশবুকে খেলিয়েছেন মেহেদী। কিন্তু আর পারছেন না তিনি। ফলে চোখে দেখছেন ঘোর অমানিশা! ইতোমধ্যেই বসুন্ধরা গ্রুপ এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে দেখা করে অর্থ সহায়তা চেয়েছেন মেহেদী। বসুন্ধরা গ্রুপ এবং মন্ত্রী ভবিষ্যতে তাকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। কেননা এরই মধ্যে চলতি অর্থবছর এখন শেষ দিকে। এদিকে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনও খুশবুসহ পাঁচ-ছয়জনকে পাঠানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সবার প্রচেষ্টাই যদি ব্যর্থ হয় তাহলে খুশবুর নর্ম অর্জনের সুযোগ নষ্ট হয়ে যাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এখনও সময় আছে। তাই খুশবুর আকুতিকে আমলে নিয়ে পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং ক্রীড়া অন্তঃপ্রেমী ব্যক্তিরা সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন, এটাই নিগূঢ় প্রত্যাশা।
×