ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মোবাইল কোম্পানির সীমাহীন কলড্রপ, মন্ত্রীও বিরক্ত

প্রকাশিত: ১০:১৭, ২৩ মে ২০১৯

 মোবাইল কোম্পানির সীমাহীন কলড্রপ, মন্ত্রীও বিরক্ত

ফিরোজ মান্না ॥ সীমাহীন কলড্রপ নিয়ে এবার তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক মুখ খুললেন। তিনি বলেন, কলড্রপ নিয়ে বিটিআরসি বলছে এক কথা, মোবাইল অপারেটররা আরেক কথা। আমরা যখন ডিজিটাল সার্ভিসের কোয়ালিটির কথা বলছি। তখন এই কলড্রপ নিয়ে সরকারকে নানা বিরূপ মন্তব্য শুনতে হচ্ছে। বিটিআরসি ফাইন্যান্সিয়াল অডিট করে, এর টেকনিক্যাল অডিট হওয়া প্রয়োজন। ‘থার্ড পার্টির অডিটের’ মাধ্যমে কারণ জানা প্রয়োজন। জানা দরকার ত্রুটি কোথায়? এর আগে জাতীয় সংসদে বিগত সরকারের এক সিনিয়র মন্ত্রী কলড্রপ নিয়ে কথা বলেছেন। প্রতিটি গ্রাহকই কলড্রপের শিকার। এখান থেকে গ্রাহকদের মুক্তি দেয়ার জন্য থার্ড পার্টি অডিটের প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিমন্ত্রী পলক সম্প্রতি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন। সূত্র জানায়, বিটিআরাসি মোবাইল অপারেটরদের বার বার নির্দেশ দেয়ার পরও কলড্রপ কমছে না। সবশেষ আদালতও কলড্রপ বিষয়ে নির্দেশ দিলেও ওই নির্দেশ অপারেটররা মানছে না। কলড্রপের ক্ষতিপূরণের টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়ে গত বছরের জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। প্রায় এক বছর আগে অপারেটদের এই নির্দেশ দেয় বিটিআরসি। কিন্তু অপারেটররা ক্রমাগত বিটিআরসির নির্দেশ উপেক্ষা করে যাচ্ছে। তারা গ্রাহকের কলড্রপের ক্ষতিপূরণের নির্দেশ বাস্তবায়ন বিষয়ে কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। বিটিআরসির ১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত হিসাবে দেশে চারটি মোবাইল ফোন অপারেটরের মোট গ্রাহক সংখ্যা ১৫ কোটি ৪১ লাখ ৭৯ হাজার। এ সময়ে গ্রামীণফোনের কলড্রপের সংখ্যা ১০৩ কোটি মিনিট। দ্বিতীয় স্থানে থাকা রবির কলড্রপ ৭৬ কোটি মিনিট, বাংলালিংকের কলড্রপ ৩৬ কোটি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটর টেলিটকের কলড্রপ ৬ কোটি মিনিট। মোবাইল ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য করে সম্প্রতি পলক বলেন, ‘ফাইভজি আমদানি করতে চাই না আমরা। যখন আমরা এ দেশে ফাইভজি নেটওয়ার্ক রুল আউট করব, তখন চাইব মোবাইল ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে আরএনডি সেন্টার স্থাপন করুক।’ ফাইভজি অনাবল মোবাইল সেট এখানে উৎপাদন করুন। তারা এ দেশে এসে মুনাফা করবে, আর কোন আরএনডি সেন্টার স্থাপন করবে না, তা হবে না। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্র মতে, মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কলড্রপ (কথার মাঝে কল কেটে যাওয়া) হয়েছে গ্রামীণফোনের। এই অপারেটরের গত এক বছরে ১০৩ কোটি ৪৩ লাখ বার কলড্রপ হয়েছে। বিটিআরসি ১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের সবগুলো মোবাইল ফোন অপারেটররের কলড্রপের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। বিটিআরসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, কলড্রপের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রবি, কলড্রপ হয় ৭৬ কোটি ১৮ লাখ। বাংলালিংকের কলড্রপ হয়েছে ৩৬ কোটি ৫৪ লাখ আর টেলিটকের আনুমানিক ৬ কোটি বার। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রকৃত কলড্রপের অভিযোগ বিষয়ে মোবাইল অপারেটরদের ব্যাখ্যা পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিল বিটিআরসি। কিন্ত অপারেটররা ওই সময় পার হয়ে গেলেও কোন ব্যাখ্যা দেয়নি। সূত্র মতে, কলড্রপের কারণ হচ্ছে একটি অপারেটরের যতটুকু স্পেকট্রাম থাকা দরকার তা নেই তাদের। কোয়ালিটি অব সার্ভিস নীতিমালা অনুমোদন হয়েছে। এখন বিটিআরসি সব অপারেটরকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেবে কোয়ালিটি সার্ভিস দিতে এবং বিটিআরসি সর্বক্ষণিক মনিটরিং করবে। কলড্রপ নিয়ে বিটিআরসি থেকে সব মোবাইল অপারেটরদের গত ৩০ জুন একটি নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। নির্দেশে বলা হয়েছে, কোন মোবাইল অপারেটর দিনে একের অধিক প্রতিটি কলড্রপের জন্য এক মিনিট টকটাইম গ্রাহককে ফেরত দিতে হবে এবং তা এসএমএসের মাধ্যমে অপারেটররা জানিয়ে দেবে। গ্রাহকদের কলড্রপের টাকা বা ‘টকটাইম’ ফেরত দেয়ার নির্দেশটি বাস্তবায়নের জন্য মোবাইল অপারেটরদের গত বছরের জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু জুনের মধ্যে অপারেটররা এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করেনি। সম্প্রতি বিটিআরসি কলড্রপের ক্ষতিপূরণ নিয়ে অপারেটরদের আবার চিঠি দিয়েছে। এবারের চিঠিতে বলা হয়েছে, কলড্রপের ক্ষতিপূরণ গ্রাহককে না দিলে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমন নির্দেশের পরও মোবাইল অপারেটররা এ বিষয়ে কোন উদ্যোগই নিচ্ছে না। কলড্রপ হতে পারে। তবে তা হতে হবে সহনীয় মাত্রায়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কলড্রপ হলে গ্রাহক টাকা বা সমপরিমাণ টকটাইম ফেরত পান। বিশ্বের অনেক দেশেই এই নিয়ম চালু আছে। আমরা কলড্রপের টাকা গ্রাহকদের ফেরত দেয়ার জন্য কয়েক বছর ধরে অপারেটরদের বলে যাচ্ছি। কিন্তু তারা নানা কারণ দেখিয়ে এটা বাস্তবায়ন করছে না। বিটিআরসি বলছে অপারেটরদের দেয়া হিসাবের বাইরে অনেক বেশি কলড্রপ হচ্ছে। অপারেটররা বলছে, ইন্টার-কানেকশন এক্সচেঞ্জের (আইসিএক্স) ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের দুর্বলতায়ও কলড্রপ হচ্ছে। এর বাইরে ফাঁকা স্থানে হঠাৎ উঁচু ভবন নির্মাণ এবং থ্রিজি নেটওয়ার্ক কার্পেটিংয়ের কারণেও কলড্রপ হচ্ছে। কলড্রপ একদম হবে না একথা বলা যাবে না। নেটওয়ার্কের কারিগরি ত্রুটি কখন দেখা দেবে তাও বলা যাবে না। যে কোন সময় এই ত্রুটি দেখা দিতে পারে। তখন কম বেশি কলড্রপ হবে। আইটিইউর বেঁধে দেয়া নিয়মেও কলড্রপ স্বীকৃত। কলড্রপ নিয়ে মোবাইল অপারেটররা বলছে, নেটওয়ার্ক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রতিবন্ধকতায় কলড্রপের বড় কারণ। যেমন ঢাকার একটি স্থানে গ্রাহক বেড়ে গেছে কিংবা বড় বড় উঁচু দালান ওঠায় উন্নত সেবা ধরে রাখতে সেখানে আরও বেশি বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস) বসানো প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে বিটিএস বসানোর জন্য উপযুক্ত জায়গা পাওয়া যায় না। এখন বেশিরভাগ বাড়িওয়ালা, এমনকি সরকারী অফিসের কর্মকর্তারাও বিটিএস বসানোর জন্য ভবনের ছাদ ব্যবহার করতে দিতে চান না। আবার যেখানে স্থান পাওয়া যায়, সেখান থেকে পুরো এলাকায় বৃত্তাকারে সমমানের নেটওয়ার্ক সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে কলড্রপ হচ্ছে।
×