ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সমাজের কল্যাণকর যে ক্লাবটি...

প্রকাশিত: ১৩:০৮, ২২ মে ২০১৯

সমাজের কল্যাণকর যে ক্লাবটি...

ফুটবলপ্রেমী পাঠকদের আজ শোনাব ঢাকার একটি ফুটবল ক্লাবের সংগ্রাম ও ধীরে ধীরে ওপরে ওঠার কাহিনী। ঢাকা শহরে যতগুলো ওয়ার্ড আছে, তার একটি হচ্ছে মুগদাপাড়া (৬ নং ওয়ার্ড, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন)। কিছুদিন আগে মুগদা থানাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘মুগদাপাড়া’ নামটির উদ্ভব কোত্থেকে-কিভাবে হলো, তার সুস্পষ্ট কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও অনেকের মতে ‘মুগ ডাল’ থেকেই মুগদাপাড়া শব্দটি এসেছে। ব্রিটিশ আমল এবং পাকিস্তান আমলের শুরুতে এই অঞ্চলটি বলতে গেলে ছিলই না! পুরো এলাকাজুড়ে ছিল অসংখ্য জলাশয় বা ঝিল। ধীরে ধীরে মাটি ফেলে, ঝিল ভরাট করে (কয়েক বছর আগেও এলাকার সবচেয়ে বড় ঝিলটি ভরাট করে নির্মিত হয় সরকারী একটি হাসপাতাল) জায়গা উঁচু করা হয় এবং বিভিন্ন ঘরবাড়ি, ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। মুগদাপাড়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ক্র্যাক প্লাটুনের কনিষ্ঠ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা শহীদ বকরের একটি ঘটনার স্মৃতি। বকর খবর পেলেন- ওখানকার স্থানীয় এক রাজাকার সাধারণ মানুষের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে আর লুটপাট করে বেড়াচ্ছে। এই খবর জানার পরই দু-একজনকে সঙ্গে নিয়ে বকর চলে যান মুগদাপাড়ায়, এক সন্ধ্যায় চাদরের ভেতরে স্টেনগান পেঁচিয়ে একটি ব্রিজের পাশে অপেক্ষায় থাকেন, অন্য সঙ্গীরা ব্যাকআপ হিসেবে কিছু দূরে। হাঁট-ফেরত সেই রাজাকার ব্রিজের কাছে চলে আসলেই বকর বেরিয়ে এসে চাদরের আড়ালে বের করে আনেন স্টেনগান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যায় পাকিস্তানী দালাল রাজাকারটা। একাত্তরে পাকিস্তানী বাহিনী এবং রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত আরও ২৪ বীরাঙ্গনাকে ২০১৬ সালে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয় সরকার। ঢাকার মুগদাপাড়ার মোছাম্মৎ হনুফা বেগম তাঁদেরই একজন। একসময় মুগদাপাড়ার মা-া বিলে দেশীয় ‘বালিহাঁস’ বর্ষাকালে দেখা যেত। এগুলো বাদ দিলে অতীতে কখনই এই এলাকার কোন সুনাম ছিল না। মশার উৎপাত, বিদ্যুত বিভ্রাট, ভাঙা পথঘাট, মূল সড়ক থেকে অনেক নিচু হওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই রাস্তা ডুবে যাওয়া বা জলাবদ্ধতা, ছিনতাইকারী-মাদকসেবীদের অভয়ারণ্য ... এই ছিল দুরবস্থার চিত্র। তবে সময়ের পরিক্রমায় আজ এই অবস্থার অনেকখানিই ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। এই অঞ্চলে আগে উল্লেখ করার মতো ছিল না কোন স্থাপনা বা দর্শনীয় বস্তু। তবে মুগদাপাড়া বিশ্বরোডের পাশেই কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামটি নির্মাণের পরেই মুগদাপাড়ার গুরুত্ব বেড়ে যায়। তারপর ঝিলপাড়ের ওপর ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মুগদা জেনারেল হাসপাতাল ও নার্সিং ইনস্টিটিউট (উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) প্রতিষ্ঠিত হবার পর গুরুত্বের পরিধি দ্বিগুণ হয়। এখন মুগদাপাড়ায় মুগদা আইডিয়াল, মুগদা মহানগর, এশিয়ান আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ, ওয়েসিস চিলড্রেন্স হোম ও লিটিল এ্যাঞ্জেলস লার্নিং হোমের মতো উন্নতমানের স্কুল, একটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের শাখা কেন্দ্র, কম্পিউটারভিত্তিক আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুলসহ বিভিন্ন বিপণি কেন্দ্র আছে, যা আগে ছিল না। খেলাধুলাতেও মুগদাপাড়ার কোন সুনাম বা ঐতিহ্য ছিল না। যদিও একাধিক ক্লাব ও সংগঠন ছিল ঠিকই, কিন্তু ছিল না গর্ব করার মতো কোন সাফল্য। তবে এখন আছে। আর সেটা মুগদা সমাজ কল্যাণ ও ক্রীড়া সংসদের কল্যাণে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগরী ফুটবল লীগ কমিটির দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে উঠছে মুগদা সমাজ কল্যাণ ও ক্রীড়া সংসদ। কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে গত ৯ মে অনুষ্ঠিত খেলায় তারা বিকেএসপিকে। আর এই জয়ের ফলেই তারা বাজিমাত করে। নাম লেখায় প্রথম বিভাগে। তাও আবার তিন ম্যাচ হাতে রেখেই! সর্বশেষ ম্যাচটাও তারা শেষ করে জয় দিয়েই, ১৭ মে তারা হারায় শান্তিনগর ক্লাবকে। ১২ ম্যাচে ২৬ পয়েন্ট নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় মুগদার এই ক্লাবদলটি। জেতে ৮ ম্যাচেই। ড্র করে ২ ম্যাচে, হারেও ২ ম্যাচে। জেতে ৪-১ গোলে বিজি প্রেসকে, ২-০ গোলে সিটি ক্লাবকে, ৪-০ গোলে লিটিল ফ্রেন্ডস ক্লাবকে, ৩-১ গোলে উত্তরা আজমপুর ফুটবল ক্লাবকে, ৩-১ গোলে পূর্বাচল পরিষদকে, ৩-০ গোলে গৌরিপুর স্পোর্টিং ক্লাবকে, ২-০ গোলে বিকেএসপিকে এবং ৫-১ গোলে শান্তিনগর ক্লাবকে হারিয়ে। ড্র করে ইস্ট এন্ড ক্লাবের সঙ্গে এবং টঙ্গী ক্রীড়া চক্রের সঙ্গে গোলশূন্যভাবে। আর হেরে যায় খিলগাঁও ফুটবল একাডেমি (০-৩) এবং দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের (০-১) কাছে। লীগে পয়েন্টের মতো সমান ও সবচেয়ে বেশি ২৬ গোলও করেছে মুগদার এই ক্লাবটি। ইস্ট এ্যান্ড রানার্সআপ হয়ে এবং দিলকুশা তৃতীয় হয়। এই দুটি দলও প্রথম বিভাগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। মজার ব্যাপারÑ মুগদার এই ক্লাবের কোন ফুটবলারই কিন্তু মুগদাপাড়ার নন! এই দলে সবচেয়ে বেশি খেলেছেন সিলেটের ফুটবলাররা (৯ জন) এবং এরা প্রত্যেকেই খেলেছেন সেরা একাদশে। আরও মজার ব্যাপার- দলটির কোচের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক জাতীয় দলের ফুটবলার সিলেটের ইকরামুর রানা! দলটির হয়ে অংশ নেয়া সিলেটের ফুটবলাররা হলেন : হিলাল, বিপ্লব, মাজেদ, মাইকেল রুম্মান, তারেক, মানিক, নূর, অভি এবং শাকিল। ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মুগদা সমাজকল্যাণ ক্লাবের। মজার ব্যাপারÑ ক্লাবটির অবস্থান ছিল এলাকার বাইরে, কমলাপুর ফুটওভার ব্রিজের (পুরাতন) নিচে! আরও অবাক হবেন, যখন শুনবেন সে সময় ক্লাবটি তৈরি হয়েছিল ¯্রফে বেড়ার একটি ছোট্ট ঘর হিসেবে! এখন অবশ্য ক্লাবটির অবস্থান উত্তর মুগদাপাড়ায়। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় পাইওনিয়ার ফুটবল লীগের আসর। সেই আসরে অংশ নেয় মুগদা সমাজকল্যাণ। সেবার লীগে ভাল ফল করতে পারেনি দলটি। করতে পারেনি তার পরের ৩০ বছরেও! শেষমেশ তাদের ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে ২০১০-১১ মৌসুমে। তৃতীয় স্থান অধিকার করে তারা। সেই সুবাদে ছাড়পত্র পায় তৃতীয় বিভাগ লীগে খেলার। মাত্র দু’বছর অপেক্ষা-চেষ্টার পর রানার্সআপ হয়ে নিশ্চিত করে দ্বিতীয় বিভাগ লীগে খেলা। কিন্তু এরপর দুটি লীগ খেলেও কিছুতেই আরও ওপরে ওঠার সিঁড়ি খুঁজে পাচ্ছিল না তারা। তবে সেই অপেক্ষার যাতনা বেশিদিন সহ্য করতে হয়নি তাদের। পাঁচ বছর পরেই, মানে এবার তারা তৃতীয় বা দ্বিতীয় নয়, একেবারে প্রথম অর্থাৎ চ্যাম্পিয়ন হয়েই উন্নীত হয় প্রথম বিভাগে। পূরণ হয় দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। কথা হয় জাকির হোসেনের সঙ্গে। ১৫ বছর ধরে সামলাচ্ছেন ক্লাবটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। একটু পুরনো দিনের ফুটবলপ্রেমীরা হয়তো চিনে থাকবেন তাকে। কারণ জাকির নিজেও ছিলেন একজন কুশলী ফুটবলার। ১৯৯২ সালে খেলেছেন বাংলাদেশ অ-১৯ জাতীয় ফুটবল দলে। ৫৫ বছর বয়সী এই ক্রীড়া সংগঠক নব্বইয়ের দশকে ডাক পেয়েছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় লাল দল, জাতীয় সবুজ দল এবং অ-২৩ জাতীয় ফুটবল দলেও। কিন্তু প্রতিবারই চূড়ান্ত স্কোয়াড ঘোষণার সময় বাছাইয়ে বাদ পড়েন। খেলোয়াড়ী জীবনে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলা জাকিরের জীবনের প্রথম ক্লাবই ছিল মুগদা সমাজকল্যাণ ও ক্রীড়া সংসদ। ১৯৮১ সালে এই ক্লাবের হয়েই পাইওনিয়ার লীগ খেলেন। পরের বছরও তাই। এরপর পাইওনিয়ার পর্যায়ে খেলেন ১৯৮৩-৮৪ পর্যন্ত পূর্বাচল পরিষদে এবং ১৯৮৫-৮৬ দিলকুশায়। ১৯৮৭-১৯৯৭ সাল পর্যন্ত প্রথম বিভাগে খেলেন যথাক্রমে ভিক্টোরিয়া, ফরাশগঞ্জ এবং ওয়ারী ক্লাবের হয়ে। জনকণ্ঠকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে জাকির জানান, ‘আল্লাহ্র কাছে লাখো শুকরিয়া আমাদের মুগদা সমাজকল্যাণ দ্বিতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে ওঠায়। নয় মাস আগে দল গুছিয়ে আমরা অনুশীলন শুরু করি। মাঝে বিভিন্ন কারণে লীগের খেলা পিছিয়ে গেলে ক্যাম্প বন্ধ হয়ে যায়। তারপর লীগ শুরুর মাত্র ১০ দিন আগে তড়িঘড়ি করে আবারও ক্যাম্প শুরু করে অনুশীলন করাই খেলোয়াড়দের।’ এত স্বল্প প্রস্তুতির পরেও কিভাবে সম্ভব হলো শিরোপা জেতাটা? ‘আমাদের খেলোয়াড়দের ক্যালিভার ছিল। আর ছিলেন অভিজ্ঞ কোচ ইকরান রানা। তার কারণেই এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে।’ ঢাকা মহানগরী ফুটবল লীগ কমিটির সদস্য জাকিরের ব্যাখ্যা। দল গঠন করতে ১৭-১৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান জাকির, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে ৫৫ খেলোয়াড় বেছে নেই। সেখান থেকে বাছাই করে চূড়ান্ত স্কোয়াডে রাখি ৩০ জনকে। এদের খেলা দেখে তখনই মনে হয়েছিল আমরা সফল হব। কিন্তু সেটা তখনই প্রকাশ্যে মুখ ফুটে বলিনি ইচ্ছে করেই।’ কেন? ‘আমি দেখেছি তখনই দ্বিতীয় বিভাগের অনেক দলের কোচই রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে ও গর্ব করেই বলেছিলেন তারাই চ্যাম্পিয়ন হবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারোর দলই প্রথম বিভাগে যেতে পারেনি। আমি চাইনি আমার ক্লাবেরও একই দশা হোক। কাজেই মনের কথা মনেই রেখে দিয়েছিলাম।’ জাকির আরও জানান, ‘আমাদের পরিকল্পনা ছিল ধাপে ধাপে এগুনো। শুরুতে চেয়েছি রেলিগেশন এড়াতে। তারপর সেরা তিনে থাকতে। শেষে তো সেরা দলই হয়ে গেলাম।’ মুগদা সমাজকল্যাণের টার্নিং পয়েন্ট ছিল টানা আট ম্যাচে অপরাজিত থাকাটা। এই আট ম্যাচের মধ্যে ছয়টিই ছিল জয়। এই ছয় জয়ের আবার চারটিই টানা। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দ কিভাবে উদযাপন করেছেন? জাকির বলেন, ‘রমজান মাসের কারণে এখনও কোন উদযাপন বা আনন্দ করিনি আমরা। ঈদের পরেই জাঁকজমকভাবে করার পরিকল্পনা আছে। ক্লাবের সব ফুটবলারকেই সংবর্ধনা ও পুরস্কার দেয়ার ইচ্ছে আছে। এজন্য আগে থেকেই মাইকিং করা হবে।’ আক্ষেপ করে জাকির বলেন, ‘মুগদার অনেক লোকই এখনও জানে না মুগদা সমাজকল্যাণ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এমনটা হয়েছে প্রচারের অভাবে। অবশ্য যারা জেনেছেন, তারা বেশ অবাক হয়েছেন।’ সামনের মৌসুমে নতুন লীগ, নতুন চ্যালেঞ্জ ... সেটা নিয়ে বেশ চিন্তিতও বটে জাকির, ‘আমরা অনেক কষ্ট করে ক্লাবটি চালাই। ক্লাবের কোন পৃষ্ঠপোষক নেই, আয়ের কোন উৎস নেই। এই দলটির খরচ জোগাতে বলতে পারেন একপ্রকার ভিক্ষা করেই টাকা সংগ্রহ করতে হয়েছে। আগামীতেও যদি এভাবে চলে, তাহলে ক্লাবের ভবিষ্যত অন্ধকার! ভালমানের দল গঠন করাই মুশকিল হয়ে যাবে।’ বহুদিন পর মুগদাপাড়া-সমাজের জন্য আনন্দ বয়ে আনলো যে কল্যাণকর ক্লাবটি, আগামীতে তাদের পথচলা কতটা মসৃণ হবে, সেটা সময়ই বলে দেবে।
×